সপরিবারে অদূরবর্তী স্থানে ভ্রমণে আনন্দলাভ। কাজকর্মে কমবেশি ভালো। সাহিত্যচর্চায় আনন্দ। ... বিশদ
খুব শীঘ্রই দায়িত্ব নেবে নতুন সরকার। এবার যে সরকারই ক্ষমতাসীন হোক, তাদের কাছে প্রত্যাশা থাকবে, তারা যেন গণতন্ত্রের মর্যাদা রক্ষায় যত্নবান হয়। প্রথম দুটি মোদি সরকার মূলত চমক প্রদর্শনের উপরই সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করেছিল। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল—নোট বাতিল এবং রেল বাজেট ও পরিকল্পনা কমিশন তুলে দেওয়া। গুরুত্ব পেয়েছিল সেন্ট্রাল ভিস্তা এবং অযোধ্যায় রামমন্দির নির্মাণ। প্রথম তিনটি পদক্ষেপ থেকে দেশ কতটা উপকৃত হয়েছে তা নিয়ে বিতর্কের অবকাশ রয়েছে। সেন্ট্রাল ভিস্তা রূপায়ণের ফলে রাজধানী নয়াদিল্লি নিশ্চয় একটু বেশি ঝাঁচকচকে হয়েছে, কিন্তু একটি কল্যাণকামী রাষ্ট্রের উন্নয়ন কনসেপ্টের সঙ্গে তার সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। এছাড়া রামমন্দির নির্মাণের সঙ্গে ভারতের মতো একটি সুবিশাল ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র এবং তার সরকারের কোনও সম্পর্ক থাকায় উচিত ছিল না। এতে যে জিনিসটা সবচেয়ে বেশি ইন্ধন পেয়েছে সেটা নিঃসন্দেহে ধর্মীয় মেরুকরণ। বিজেপিকে জব্দ করতে নেমে অন্য দলগুলিও যেন একটি পলিটিক্যাল কম্পালশনের জায়গা থেকে মেরুকরণেরই উল্টো ফাঁদে পা দিয়েছে। তার ফলে যে চূড়ান্ত মেরুকরণ ঘটে গিয়েছে তার ফায়দা, নিঃসন্দেহে সবচেয়ে বেশি পেয়েছে সঙ্ঘ পরিবারের রাজনৈতিক শাখাটি এবং তার মিত্র দলগুলি।
সব মিলিয়ে এক দশকে যে ভোট রাজনীতির চর্চা দেশজুড়ে পুষ্ট হয়েছে তাতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ‘উন্নয়ন’ প্রসঙ্গ। স্বাধীনতার আট দশক পূর্তি আসন্ন। এমন ‘অমৃতকালে’ পৌঁছেও দেশে নিরক্ষর, ক্ষুধার্ত, বেকারত্বের জ্বালায় জর্জরিত সামাজিক সুরক্ষাহীন শ্রমিক বাহিনী এবং প্রবীণ নাগরিক সমাজ অসহায়ের মতো বেঁচে আছে। কৃষিপণ্যের ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের (এমএসপি) জন্য মাথা কুটছেন কৃষকরা। অথচ তারাই এদেশের অর্থনীতির সবচেয়ে বড় ভরসা। আমরা বরাবর লক্ষ্য করেছি, ভারতের অর্থনীতি যতবার বড় বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে তাকে আগলে রেখেছে কৃষিক্ষেত্র। তাদের টাটকা অনস্বীকার্য অবদান আমরা দেখেছি কোভিড ১৯-এর তিনটি বছরে। বিশেষ করে ২০২০ ও ২০২১ সালে যখন বেশিরভাগ উৎপাদন ও পরিষেবা ক্ষেত্র অসহায়ের মতো মুখ থুবড়ে পড়েছিল, ভারতীয় অর্থনীতিকে বরাবরের মতোই সচল রেখেছিল সেই এক ও অদ্বিতীয় কৃষি। ২০১৬ সালে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নরেন্দ্র মোদি ঘোষণা করেছিলেন, ২০২২-এর ভিতরে কৃষকের আয় দ্বিগুণ হবে। কিন্তু অর্থনীতির উপর মুদ্রাস্ফীতির প্রভাব মিলিয়ে দেখা যায়, কৃষকের আয় তার পরিবর্তে কমেই গিয়েছে। একইভাবে বাস্তব আয় হ্রাস পেয়েছে সাধারণ শ্রমিকদেরও।
অন্যদিকে এই মোদি জমানাতেই বেড়ে চলেছে গুটিকয়েক ধনাঢ্য (মিলিয়নেয়ার) ব্যক্তি ও পরিবারের সংখ্যা। সার্বিকভাবে বেড়ে গিয়েছে ধনবৈষম্য, ভারতের অর্থনীতির বিকাশের পথে যেটা বরাবরের অন্তরায়। আরও পরিতাপের বিষয় এই যে, একটি দেশের মানুষ কতটা উন্নত এবং সুখী তা বিশেষভাবে নির্ভর করে সেখানে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে কী পরিমাণ অর্থ ব্যয় করা হয় তার উপর। কোনও সন্দেহ নেই, যেকোনও মাঝারি আয়ের দেশের তুলনায় ভারতে স্বাস্থ্য খাতে কেন্দ্রীয় বাজেট বরাদ্দ সর্বনিম্ন। ২০২০ সালে গালভরা ‘জাতীয় শিক্ষা নীতি’ চাপিয়ে দিয়েছেন নরেন্দ্র মোদি। এই নয়া নীতিতে শিক্ষা খাতে জিডিপির অন্তত ৬ শতাংশ বরাদ্দের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। সর্বশেষ বাজেটেও পরিষ্কার, শিক্ষা খাতে ব্যয়ের পরিমাণ শিক্ষা নীতিতে গৃহীত লক্ষ্যমাত্রার ধারেকাছেও নয়। সোজা কথায়, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা দুটি দিকই আজও পর্যন্ত সরকার বাহাদুরের কাছে প্রাপ্য গুরুত্ব পায়নি।
ভারতের জনসংখ্যা চীনকে ছাপিয়ে গিয়েছে এবং সেটা ১৫০ কোটির দিকেই দ্রুত ছুটছে। এই বিপুল জনসংখ্যার বেনিফিট পেতে গেলে মানুষকে অবিলম্বে ‘মানবসম্পদে’ (হিউম্যান রিসোর্স) উন্নীত করাটা জরুরি। সুস্বাস্থ্য ও সুশিক্ষা ছাড়া একজন মানুষ কখনও মানবসম্পদে উন্নীত হতে পারে না। এই প্রশ্নে ভারত প্রতিদিন পদে পদে নিজের ব্যর্থতার দিকটি প্রকট করে চলেছে। অথচ বিপুল জনসংখ্যারই ‘আশীর্বাদে’ শ্রমশক্তি ও মেধাসম্পদের সদ্ব্যবহারের মাধ্যমে, নিজস্ব প্রাকৃতিক সম্পদ দিয়ে ঈর্ষণীয় উন্নতি করা যেত। নরেন্দ্র মোদি ভারতকে তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি হিসেবে গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। অর্থাৎ মোদির ভারতের অর্থনীতি—মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের পরেই জায়গা করে নেবে দাবি করেছিলেন তিনি। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় এই যে, ভারতের অর্থনীতি বিশ্বে তিন নম্বর জায়গা পেলেও এখানকার সাধারণ মানুষের আর্থিক উন্নতি আহামরি দেখতে পাওয়ার সম্ভাবনা কম। তার কারণ তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির বিপরীতে হাত পেতে থাকবে দেড়শ কোটি মানুষও! ফলে এমন ‘চমকপ্রদ’ অর্থনীতিকেও ক্ষুদ্র প্রতিবেশী বাংলাদেশের চেয়ে খুব একটা উজ্জ্বল দেখাবে না।
তাই শুধু সংকীর্ণ রাজনীতি করতে গিয়ে তথাকথিত ‘সিঙ্গল ইঞ্জিন’ রাজ্যগুলিকে যেভাবে পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে, সেই ভুল আর করা যাবে না, এমনকী ‘ডাবল ইঞ্জিন’ রাজ্যেও যে ধরনের ধর্ম, জাতি ও বর্ণগত বৈষম্য হয়েছে বন্ধ করতে হবে সেগুলিও অচিরে। কারণ কোনও একটি রাজ্য বা কোনও একটি অঞ্চলকে পিছিয়ে রেখে ভারতের জাতীয় আয় বা জাতীয় উৎপাদন কখনোই কাঙ্ক্ষিত চেহারা নিতে পারবে না। তাই নতুন শাসক শ্রেণির কাছে প্রত্যাশা থাকবে—তারা সংকীর্ণ রাজনীতি, ঘোড়া কেনাবেচা, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের দলবদলে ইন্ধন-উৎসাহ প্রদানের মতো নিকৃষ্ট মানের রাজনীতি থেকে নিজেদের অবিলম্বে দূরে রাখার সংকল্প নেবে। নতুন সরকার প্রথম দিন থেকেই বিশেষ গুরুত্ব দেবে ‘উন্নয়ন এবং উন্নয়ন’-এর উপরে, সেখানে অবশ্যই অগ্রাধিকার পাবে দারিদ্র্যসীমার নীচের মানুষগুলি এবং জনসংখ্যার শেষ ৫০ শতাংশ নরনারী। কারণ সমাজের অর্ধেক মানুষকে পিছিয়ে রেখে এই দেশ কোনোদিনই ‘সকল দেশের রানি’ হতে পারবে না।
একই সঙ্গে দূর করতে হবে নারী-পুরুষে বৈষম্যও। মোট ভোটারের প্রায় অর্ধেক নারী। একাধিক রাজ্যে পুরুষের চেয়ে মহিলা ভোটদাতা সংখ্যায় বেশি এবং দেশের শতাধিক লোকসভা আসনে মহিলারাই বস্তুত নির্ণায়ক শক্তি। প্রার্থী মনোনয়নের ক্ষেত্রে মহিলারা এখনও অঘোষিতভাবে ব্রাত্য। তার ফলে দেশজুড়ে মোট প্রার্থীর মধ্যে মহিলা এবারও ১০ শতাংশের নীচে। আইনসভায় মহিলাদের জন্য ৩৩ শতাংশ আসন সংরক্ষণের পরও এই করুণ হাল! নয়া আইন দ্রুত কার্যকর করার ব্যাপারে নতুন সরকারকে বিশেষভাবে যত্নবান হতে হবে, শুধু মুখে ‘নারীশক্তি’র জয়গান গাওয়াই যথেষ্ট নয়। বিশেষ মতলবের এনপিআর এবং এনআরসির প্ল্যান অবিলম্বে বাতিল করা দরকার। দেশের কিছু মানুষকে ‘অনাগরিক’ প্রমাণ করার পদক্ষেপ মোটেই স্বাস্থ্যকর নয়। দেশের সমস্ত মানুষ যদি নিশ্চিন্তে সুখে-শান্তিতে বসবাসেরই সুযোগ না পান, তাহলে তাঁরা উন্নয়নের ডাকে সাড়া দেবেন কী করে? তাই, এনপিআর, এনআরসির হিড়িক ছেড়ে, শীঘ্রই শেষ করে ফেলতে হবে সেন্সাস বা জনগণনা। কারণ জনগণনার বিস্তারিত তথ্য হাতে না নিয়ে তৈরি কোনও পরিকল্পনাই দেশকে তার লক্ষ্যে পৌঁছে দিতে পারবে না।
অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়ে এই যে, টানা ১৩ বছর দেশের যাবতীয় পরিকল্পনা গৃহীত হয়েছে যথাযথ জনগণনার পরিসংখ্যান ও তথ্য ছাড়াই। দেশকে সংরক্ষণ বিবাদে নতুন করে জড়ানোও বাঞ্ছনীয় নয়। অভিন্ন দেওয়ানি বিধি (ইউসিসি) নিয়েও সময় ও উদ্যম নষ্ট করা অনুচিত। তার পরিবর্তে জম্মু ও কাশ্মীর এবং লাদাখে যত দ্রুত সম্ভব রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিক পরিসর ফিরিয়ে দেওয়া দরকার। মণিপুরসহ উত্তর-পূর্ব ভারতের উপদ্রুত এলাকার সুস্থিতি ফেরানোও জরুরি।
একই সঙ্গে নজর দিতে হবে পরিবেশের সুরক্ষার উপর। নগরায়ণের নেশায় আমরা কৃষিজমি, জলাভূমি, অরণ্য, পাহাড় প্রভৃতির অপূরণীয় ক্ষতি ইতিমধ্যেই করে ফেলেছি। এই ‘আত্মঘাতী’ কাজ-কারবারে এখনই লাগাম না পড়লে আমাদের ভবিষ্যৎ যে অন্ধকার তাতে কোনও সংশয় নেই। কিন্তু কোনও রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী ইস্তাহারে পরিবেশের সুরক্ষার দিকটি আজ পর্যন্ত বিশেষ গুরুত্ব পায়নি। কোনও কোনও দলের নির্বাচনী দলিলে হয়তো নিয়মরক্ষার মতোই তার উল্লেখটুকু রয়েছে। নতুন সরকারের কাছে প্রত্যাশা, এই মারাত্মক ভুলটির সংশোধনে তারা প্রথম থেকে এবং আন্তরিকতার সঙ্গেই যত্নবান হবে।