সপরিবারে অদূরবর্তী স্থানে ভ্রমণে আনন্দলাভ। কাজকর্মে কমবেশি ভালো। সাহিত্যচর্চায় আনন্দ। ... বিশদ
যদিও এনডিএ নামে একটি জোট আপনি চালান, কিন্তু এতদিন সেখানে আপনিই ছিলেন সংখ্যাধিক্য। তার জোরে দাদাগিরি চালাতেন। শরিক নেতাদের দাস বলে মনে করতেন। এখন আর সেসব চলবে না। শরিক নির্ভরতার জন্য আপনাকে তাঁদের তোয়াজ করতে হবে। আপনি এখন সম্পূর্ণ শরিকদের কৃপাপ্রার্থী। আর মনে রাখা দরকার, দশ শরিকের প্রধানমন্ত্রীর ছাতির মাপ কখনওই বত্রিশ ইঞ্চির বেশি হতে পারে না। এই শিক্ষাটুকুও যা হোক হয়ে গেল। হে পরমাত্মা, এই ট্রিপল ইঞ্জিন সরকারে আপনি এখন একজন নিতান্তই পরজীবী প্রধানমন্ত্রী। কতদিন থাকবেন, তা ভবিষ্যৎই বলবে। তবে আপনাকে এখন অন্যের কৃপাপ্রার্থী হয়ে ক্ষমতার লাড্ডু খেতে হবে। আপনিই বলতে পারবেন, এই স্বাদটুকু সত্যিই মিষ্টি, না অত্যন্ত তেতো।
আপনি ক্ষমতায় আসীন হলেও আসলে এই মুহূর্ত থেকে সূচিত হল আপনার পতনের কাউন্টডাউন। আগামী দু’বছর ভারতীয় রাজনীতিতে অনেক বড় বড় নাটকের অভিনয় হবে। দেখা যাবে অনেক উত্থান, অনেক পতন, বিশ্বাসঘাতকতার অনেক চমকপ্রদ নাটক। আপনাকে সিংহাসন বাঁচাতে গেলে একেবারে অনুগত হয়ে থাকতে হবে। পরমাত্মার অংশ হয়েও আপনি তার একচুল বদলাতে পারবেন না। কেননা আপনার চলন বলনের রিমোট এখন নী-না’র হাতে, মানে নীতীশ ও নাইডু। এঁরা দু’জনেই পোড় খাওয়া নেতা। জানি না, এঁরা আপনাকে সংসদে মুজরো করিয়ে ছাড়বেন কি না! তবে একটা বিষয় পরিষ্কার, ধর্মকেন্দ্রিক রাজনীতির এক্সপায়ারি ডেট চলে গিয়েছে। আশা করি, এখনই আপনি বিদ্বেষ ছড়ানোর পথে হাঁটবেন না। মুসলিমদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ানোর ফল যে ভালো হয়নি, তা তো ভোটের ধাক্কাতেই পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে। কিছু হিন্দু ছাড়া অন্যরা আপনার পাশ থেকে সরে গিয়েছেন। রামের জন্মভূমি অযোধ্যায় আপনি রামমন্দির নির্মাণ করে ভেবেছিলেন বিরাট এক উইনিং স্ট্রোক মারলেন, কিন্তু সেখানকার ভোটাররাই আপনাকে হুক করে মাঠের বাইরে পাঠিয়ে দিলেন। ‘রাম রাম’ করে সারা দেশ কাঁপিয়েও সেখানে হেরে গেলেন। তারপর সীতাপুর, পুরাণ মতে এখানে জড়িয়ে রয়েছে রামসীতার বহু স্মৃতি। সেখানে হেরে গিয়েছে বিজেপি। নাসিকের কথাই ধরুন, এখানে নাকি লক্ষ্মণ শূর্পণখার নাক কেটে দিয়েছিলেন। এখানেও ভোটাররা বিজেপির নাক কেটে দিয়েছেন। রামেশ্বরম— রামচন্দ্রের আর এক স্মৃতি বিজড়িত স্থান। সেখানে মানুষ বিজেপির ভিত উপড়ে দিয়েছে। প্রয়াগরাজেও পোঁতা হয়েছে বিজেপির পরাজয়ের মাইলস্টোন। বস্তি, সুলতানপুর, রামটেক, কোপ্পল, এগুলি রামচন্দ্রের সঙ্গে নানাভাবে সম্পর্কযুক্ত স্থান। সব জায়গাতেই বিজেপি হেরেছে। আসলে এই হার বিজেপির নয়, আপনার। আপনার উগ্র রামচেতনাকে মানুষ প্রত্যাহার করে শিক্ষা দিতে চেয়েছেন।
হে পরমাত্মা, এক্সিট পোলের ক্ষণে দেশের মানুষ আপনাকে নবরূপে আবিষ্কার করলেন। সেখানে আপনি ও আপনার ডেপুটিকে আমরা শেয়ার বাজারের দালালরূপে প্রত্যক্ষ করলাম। ইলেকশন বন্ডের টাকার জোরে এক্সিট পোলকে প্রভাবিত করে দেশের মানুষের কাছে ভুল বার্তা পাঠানো হল। নিজেরা বিপুলভাবে ক্ষমতায় আসছেন দেখিয়ে শেয়ার বাজারে ব্যাপকভাবে বিনিয়োগ করতে বললেন। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে আপনার দোস্ত আদানিদের ঘরে দু’লক্ষ ষাট হাজার কোটি টাকা ঢুকে গেল। আদানিদের প্রতিটি শেয়ারের দর সাত-আট শতাংশ করে বেড়ে গেল। আর পরদিন কী হল? দেশের মানুষের বিনিয়োগ করা তিরিশ লক্ষ কোটি টাকা শেয়ার বাজার থেকে হাপিশ হয়ে গেল। এই গ্যাম্বলিংটা কি আপনি জেনে বুঝেই করেছিলেন? সুতরাং ক্ষমতায় আসার আগেই শুরু হয়ে গিয়েছে আর এক জুমলা। তাই আপনার তৃতীয়বারের ক্ষমতায় আসাকে ‘জুমলা.৩’ হিসাবে চিহ্নিত করা যায়।
কিন্তু আপনি যে মানসিকতার মানুষ, তাতে বেশিদিন আপনি প্রতিবন্ধী হয়ে সরকার চালাতে চাইবেন না। তাই জানি, পাশাপাশি আপনার ‘প্ল্যান বি’ রেডি রয়েছে। সেটা হল, এতদিন যে খেলা আপনি খেলেছেন, সেটাই। অন্যের ঘর ভেঙে নিজের ঘরকে শক্তিশালী করা। এমনও হতে পারে নীতীশ ও নাইডুর এমপিরাই একদিন দলের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে বেরিয়ে এসে আপনাকে সমর্থন জোগাল কিংবা কংগ্রেসের এমপি ভাঙিয়ে নিলেন। যে করেই হোক আপনি এককভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হাসিল করবেনই। এ খেলা আপনি ও আপনার ডেপুটি বিভিন্ন রাজ্যে কতবার খেলেছেন, তা দেখে দেখে আমরাও অভিজ্ঞ হয়ে গিয়েছি। তবে প্রথম দিন থেকেই যে আপনি ধাক্কা খেতে শুরু করেছেন, সেটাও দেখা যাচ্ছে। মহারাষ্ট্রের একনাথ সিন্ধে বেঁকে বসেছেন। তিনি তাঁর দলের থেকে একাধিক পূর্ণমন্ত্রী চান। বেঁকে বসেছেন অজিত পাওয়ার। তিনি পূর্ণমন্ত্রীই হবেন। ‘হাফপ্যান্ট’ মন্ত্রিত্বে তাঁকে রাজি করানো যায়নি। এসব তো ছোটখাটো ব্যাপার, আসল খেলা তো ১৮ জুন থেকে শুরু হবে। সেদিন সংসদ বসতে চলেছে। ২০ জুন নির্বাচিত হবেন লোকসভার স্পিকার। চন্দ্রবাবু নাইডু আগে থেকেই স্পিকারের পদ দাবি করে রেখেছেন। কিন্তু আপনি জানেন, স্পিকারের পদ অন্যের হাতে গেলে সংসদে মনোমতো খেলা যাবে না। দলবদলুর খেলায় স্পিকারের সিদ্ধান্তের বিশাল ভূমিকা থাকে। আর যদি বিজেপি সত্যিই স্পিকার পদ না পায়, তবে প্রথম রাউন্ডেই বিজেপির হার বলে ধরে নেওয়া যায়। সেক্ষেত্রে অধিবেশনজুড়ে বিজেপিকে নাস্তানাবুদ হতে হবে, সেটা আপনিও জানেন পরমাত্মা।
চন্দ্রবাবু নাইডুকে এর আগেও বিজেপি বেশ কয়েকবার গাড্ডায় ফেলেছে। নাইডু তা ভুলে গিয়েছেন বলে মনে হয় না। সুতরাং আর কিছুদিন অপেক্ষা করতেই হবে। মনে রাখবেন এনডিএর শরিকরা মোটেই আপনাকে বন্ধু বলে মনে করেন না। ওড়িশার নবীন পট্টনায়েক কতদিন ধরে আপনার বন্ধু। আপাদমস্তক ভদ্র, শিক্ষিত মানুষটি আপনাকে বন্ধু ভেবে বিশ্বাস করেছিলেন, তাকে আপনি ফিনিশ করে দিলেন। এখন ঘরে বসে নবীন পট্টনায়েক শুধু বলছেন, ‘তুমিও ব্রুটাস!’ আপনার পরবর্তী লক্ষ্য নাইডু ও নীতীশদের ফিনিশ করা। সেটা বুঝেই স্পিকার পদ তাঁরা চেয়ে বসে আছেন, যাতে সাংবিধানিক কলকাঠি বিজেপি নাড়াতে না পারে।
এর মধ্যে নীতীশকুমারও গুগলি দিয়েছেন, তিনি বলেছেন, হরিয়ানা, মহারাষ্ট্র সহ যে ক’টি বিধানসভায় ভোট হতে চলেছে, তার সঙ্গে বিহারের ভোটও করিয়ে নিতে হবে। অর্থাৎ নীতীশকুমার বিধানসভার নির্বাচনের ফল দেখে সমর্থনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে চান। কেন্দ্রে সমর্থন পেতে গেলে বিজেপিকে নীতীশকুমারের দাবি মেনে তাঁকে মুখ্যমন্ত্রী করতেই হবে। সুতরাং আপনার পদে পদে প্রচুর কাঁটা! এতদিন প্রত্যেকটা মন্ত্রক বকলমে চালাতেন আপনার পিএমও। পিএমও-র নির্দেশেই চলত সব মন্ত্রক। এখন জোট শরিকরা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, তাঁদের মন্ত্রক নিয়ে পিএমওর কোনওরকম খবরদারি চলবে না।
অবশ্য শুধু জোটেরই ধাক্কা নয়, দলের ভিতরেও আপনাকে ধাক্কা খেতে হবে। আরএসএস সুযোগ পেলেই আপনাকে প্রধানমন্ত্রীর আসন থেকে সরিয়ে দেবে, সেটা আপনি ভালো করেই বুঝতে পেরেছেন। তাই আদবানি লবিকে তুষ্ট করতে আপনি উঠেপড়ে লেগেছেন। জয়ের পরই দৌড়ে গিয়েছেন আদবানির বাড়ি, মুরলী মনোহর যোশির বাড়ি। প্রাধান্য দিচ্ছেন রাজনাথ সিং কিংবা নীতীন গাদকারিকে। এই ভোল আপনার থাকবে না। পাল্টে যাবে। শুধু একটু সময়ের অপেক্ষা। তবে নিশ্চিত করে বলা যায়, আপনার ট্রিপল ইঞ্জিন সরকারের মধ্যে শুরু হয়ে গিয়েছে নার্ভের লড়াই।
হে পরমাত্মা, আপনি চারশো সিট চেয়েছিলেন। না পাওয়ায় দেশের মঙ্গলই হয়েছে। কেননা এই বিপুল ক্ষমতা নিয়ে আপনি প্রধানমন্ত্রী হলে দেশের আরও সর্বনাশ হয়ে যেত। বিজেপি দেশের সংবিধান বদল করতে চায়, বিজেপি হিন্দুরাষ্ট্র চায়, সিএএ চায়। আপনি জানেন, এগুলির জন্য সংখ্যার জোর দরকার। সেই ক্ষমতার জন্য দলভাঙার খেলা আপনাকে খেলতেই হবে। গোপনে শুরু হয়েছে তার সলতে পাকানো। হে পরমাত্মা, আপনি জওহরলাল নেহরুকে স্পর্শ করেছেন, কিন্তু ইতিহাস কাজের নিরিখে কখনওই আপনাকে তাঁর উপরে স্থান দেবে না। এটাই নির্মম ইতিহাসের বিচার।