সপরিবারে অদূরবর্তী স্থানে ভ্রমণে আনন্দলাভ। কাজকর্মে কমবেশি ভালো। সাহিত্যচর্চায় আনন্দ। ... বিশদ
‘ভোটের রেজাল্টের দিনই কি গ্যাসের দাম বাড়ছে?’
‘পেট্রলের দাম কি সত্যিই ৪০০ টাকা হচ্ছে?’
এই প্রশ্নগুলো বাংলার আম জনতার। আর সেটাও এক্সিট পোলের সংখ্যাতত্ত্ব সামনে আসার ঠিক পর! বুথফেরত সমীক্ষা যদি একরাশ কৌতূহল মেটানোর মাধ্যম হয়ে থাকে, তাহলে একঝাঁক প্রশ্নও শুরু হচ্ছে ওই মুহূর্ত থেকে। কেন? প্রথমে দেখা যাক, বিভিন্ন সমীক্ষক সংস্থা বাংলা নিয়ে কী ভবিষ্যদ্বাণী করেছে। ৪২টি আসনের মধ্যে এনডিটিভি বিজেপিকে দিয়েছে ২৩টি, আর তৃণমূলকে ১৮টি। জন কী বাত বিজেপির জন্য বরাদ্দ করেছে ২১-২৬টি আসন। তৃণমূলের জন্য ১৬-১৮। ইন্ডিয়া টুডে অ্যাক্সিস সমীক্ষা বলছে, বাংলায় বিজেপি পাবে ২৬-৩১টি আসন, আর তৃণমূল ১১-১৪টি। অর্থাৎ, এই সমীক্ষাগুলির ফল যদি সত্যি হয়, তাহলে নরেন্দ্র মোদির দলের ২৪টির কম আসন পাওয়ার কথা নয়। কংগ্রেসের জন্য একটি আসন ছাড়লেও তৃণমূল ১৭টির বেশি কিছুতেই আসন পাবে না। এখানেই কয়েকটি প্রশ্ন উঠছে। একবার দেখে নেওয়া যাক। ১) লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের কোনও প্রভাব কি বাংলার ভোটারদের মধ্যে পড়ছে না? এবারের ভোটে দেখা গিয়েছে, অধিকাংশ কেন্দ্রেই মহিলা ভোটারের সংখ্যা পুরুষ ভোটারের তুলনায় বেশি। এখানেই শেষ নয়, প্রায় প্রত্যেক দফাতেই বহু কেন্দ্রে মহিলারা পুরুষদের থেকে বেশি সংখ্যায় ভোট দিয়েছেন। জেলার গ্রামে-গঞ্জে এখনও যদি কোনও মহিলাকে প্রশ্ন করা হয়, কাকে ভোট দিলেন? উত্তর আসে, ‘দিদিকে’। তৃণমূল কংগ্রেসকে ভোট দেওয়ার কথা কিন্তু তাঁরা বলেন না। ২০২১ সালেও এই মহিলা ভোটারকুলই নির্ণায়ক শক্তি হয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ২০০ অঙ্কের গণ্ডি পার করিয়ে দিয়েছিলেন। এক্সিট পোল সঠিক হলে ধরে নিতে হবে, রাজ্যের মহিলা ভোটাররা জনমোহিনী মমতাকে স্রেফ উড়িয়ে দিয়েছেন। ২) মূল্যবৃদ্ধি কি আম জনতা মেনে নিয়েছে? এই প্রশ্নটা অবশ্য শুধু রাজ্যের জন্য নয়, গোটা দেশেই প্রযোজ্য। গত কয়েক বছর ধরে মূল্যবৃদ্ধির জ্বালায় লাগানোর মতো মলম খুঁজে পাচ্ছে না সাধারণ মানুষ। আয় যত, ব্যয়ের অঙ্ক তার থেকে অনেক বেশি। পরিস্থিতি এমন জায়গায় চলে গিয়েছে যে, মধ্যবিত্তের সঞ্চয়ের পরিমাণ মোদি জমানায় সর্বনিম্ন। এক্সিট পোলের রায় মিলে গেলে বুঝতে হবে, আম জনতা মনে করছে, মূল্যবৃদ্ধি বলে কিছুই নেই। মোদি সরকার যেভাবে সব সামলেছে, সেটা যথাযথ। ৩) বেকারত্বের জ্বালা বলেও কি কিছুই নেই? এই ফল হলে বুঝতে হবে, না নেই। চাকরির প্রয়োজনই নেই যুব সম্প্রদায়ের। বছরে দু’কোটি চাকরি? না হলেও চলবে। অন্তত ১০ লাখ? সেটা না হলেই বা কী? নরেন্দ্র মোদি বাস্তবিকই আচ্ছে দিন এনে দিয়েছেন দেশে। তাই ঢালাও ভোট তাঁরই প্রাপ্য। ৪) ধর্মের রাজনীতিতেই ভরসা রাখছে দেশ? কারণ, প্রথম দু’দফার ভোটের পর বিকাশ, উন্নয়ন, অর্থনীতি, সরকার কী করেছে, আর কী দিতে চলেছে... এইসব গল্পকথা থেকে অনেক দূরে সরে গিয়েছে বিজেপি। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সরাসরি হিন্দু-মুসলিম বিভাজনের খোল-করতাল বাজাতে শুরু করে দিয়েছিলেন। বিরোধীরা জিতে এলে হিন্দুদের সম্পত্তি কেড়ে মুসলিমদের দিয়ে দেওয়া হবে, মঙ্গলসূত্র কেড়ে নেবে... এই ধরনের মন্তব্য বারবার করেছেন মোদি। এক্সিট পোল অনুযায়ী, ধর্মের বিভাজন একেবারে মোক্ষম জায়গায় আঘাত করেছে। তাই এনডিএ ড্যাংড্যাং করে জিতে যাবে। এখানে একটা প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে, মেরুকরণ বিজেপিকে ডিভিডেন্ড দিয়ে থাকলে সংখ্যালঘু ভোটের কী হল? তাঁদের তো এরপর আর চোখ বন্ধ করে নরেন্দ্র মোদিকে বিশ্বাস করার কথা নয়! আর সংখ্যালঘু ভোট গেরুয়া শিবিরের পক্ষে না গেলে কিছুতেই এনডিএর পক্ষে ৩৭০ পার করা সম্ভব নয়। দুর্নীতির ভিত্তিতে ভোট হয়েছে এবং এক্সিট পোল সেই মতো রায় দিয়েছে—এমনটাও মনে করা যাচ্ছে না। কারণ, তাহলে রাফাল যুদ্ধবিমান কেনা, বা এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণে হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ পাবলিক উড়িয়ে দিত না। উল্টে বেছে বেছে বিজেপি-বিরোধী নেতাদের ইডি ও সিবিআই দিয়ে গুঁতো দেওয়াটা দেশের শিক্ষিত সমাজ ভালোভাবে মেনে নেয়নি। মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালের গ্রেপ্তারি এই ক্ষোভে আর একটু ঘি মাখিয়ে দিয়েছিল। সেই শিক্ষিত সমাজও কি তাহলে ভোটের লাইনে দাঁড়িয়ে নরেন্দ্র মোদি ছাড়া আর কাউকে দেখতে পায়নি?
মোদির ভোট, মোদির অ্যাসিড টেস্ট আর নয়। সপ্তম দফার নির্বাচন শেষ হতে না হতে ওই শব্দবন্ধগুলো পিছনের সারিতে চলে গিয়েছে। আজ অগ্নিপরীক্ষা এক্সিট পোলের। রাজ্যে রাজ্যে বিজেপির অন্ধ সমর্থকরাও যে ফল কষ্ট করে মেনে নিচ্ছে, তা কীভাবে একাধিক সমীক্ষক সংস্থার মন কী বাত হয়ে গেল? দেখে মনে হচ্ছে, একজন আর একজনকে ফটোকপি করে রিপোর্ট দিয়ে দিয়েছে। কত নমুনা নেওয়া হয়েছে, কতজনের সঙ্গে কথা বলা হয়েছে, সে সব না হয় সংস্থাগুলির নিজস্ব ব্যাপার। কিন্তু যে ঝড়ের এফেক্ট রিপোর্টে দেখানো হয়েছে, তেমনটা কি আদৌ ছিল? হয়তো ছিল। তাই তেনারা চ্যানেলে চ্যানেলে তা ফুটিয়ে তুলেছেন। প্রত্যেক দফা ভোটের পর ফাইনাল ফিগার দিতে নির্বাচন কমিশন দেরি করেছে। আর তারপর দেখা গিয়েছে, আগের দিনের তুলনায় ভোটদানের চূড়ান্ত হার পাঁচ-ছয় শতাংশ বেশি। সমীক্ষক সংস্থাগুলি যদি সেই ‘অতিরিক্ত ভোটদান’কে বিজেপির পক্ষে বলে ধরে নিয়ে থাকে, তাহলে এই ফল হতেই পারে। না হলে গতবারের তুলনায় ভোটদানের হারে চার-পাঁচ শতাংশ ঘাটতি সত্ত্বেও অঙ্ক বদলাল না কেন? অতীত বলছে, ভোটদানের গড় হার দুই শতাংশ কমলেই সরকারের পক্ষে তা বিপজ্জনক। এবার তো হার প্রায় পাঁচ শতাংশ। তার উপর মহিলাদের ভোটদান বেড়েছে, নতুন ভোটারও যোগ হয়েছে প্রায় পাঁচ কোটি। সেই সমীকরণটা কীভাবে মিলল? নতুন ভোটাররা কি সবাই নরেন্দ্র মোদিকে ভোট দিয়েছেন? আর যাঁরা এবার বুথমুখো হননি, তাঁরা সবাই কংগ্রেস, তৃণমূল, সমাজবাদী পার্টির ভোটার? কোন অঙ্কে এনডিএ শরিক চিরাগ পাসোয়ানের দল বিহারে পাঁচটি আসনে প্রার্থী দেওয়ার পরও ছ’টি আসনে জেতার সম্ভাবনা দেখায়? কীভাবে হিমাচল প্রদেশ বা হরিয়ানায় মোট আসনের থেকে বেশি বিজেপি পায়? এমন সমীক্ষক সংস্থাকে আজ তো পরীক্ষায় বসতেই হবে। আর মনে রাখতে হবে কয়েকটি বছর। প্রথমেই ২০০৪। অটলবিহারী বাজপেয়ির জনপ্রিয়তায় ভেসে আগেভাগেই লোকসভা ভোট করিয়েছিল বিজেপি। এক্সিট পোল বলেছিল, হেসেখেলে ২৭৫ আসন নিয়ে ক্ষমতায় আসবেন বাজপেয়ি। তা কিন্তু হয়নি। এনডিএ থেমে গিয়েছিল ১৮৭তে। কিংবা ২০২০ বিহার বিধানসভা নির্বাচন। সেবারও বিভিন্ন সংস্থার বুথফেরত সমীক্ষা বলেছিল, তেজস্বী যাদব হেলায় জিতে যাবেন। কিন্তু তা হয়নি। বিজেপি-জেডিইউ জোটই ক্ষমতায় এসেছিল। আর সাম্প্রতিকতম উদাহরণ হিসেবে একুশে বাংলার বিধানসভা নির্বাচন তো রয়েছেই। এবারও কি তেমন কিছুই অপেক্ষা করে আছে? এই প্রশ্নের উত্তরের উপর সমীক্ষক সংস্থা এবং চ্যানেলগুলির বিশ্বাসযোগ্যতা নির্ভর করে রয়েছে। আজকের ফলের সঙ্গে মানুষ শনিবার রাতের হিসেবও মেলাবে। যদি সম্পূর্ণ উল্টো ফল হয়, তাহলে ভবিষ্যতে এক্সিট পোলের টিআরপি এতটা থাকবে কি না, তা ঘোর সন্দেহজনক।
তাই এক্সিট পোলকে আজ পরীক্ষায় বসতেই হবে। সাধারণ মানুষকেও আজ জানাতে হবে, তারা কি এক্সিট পোলেই সায় দিয়েছে? নাকি সম্পূর্ণ উল্টো ফলের অপেক্ষায় আছে ৪ জুন? দুপুরের মধ্যেই পরিষ্কার হয়ে যাবে ছবিটা। ছেলেবেলায় শুনতাম, রেজাল্টের দিন টেনশন করে লাভ নেই। পরীক্ষার আগে টেনশন করতে হয়। এখন আর ব্যাপারটা তেমন মনে হচ্ছে না। পরীক্ষা যেমনই হয়ে থাকুক না কেন, রেজাল্ট ভালো হওয়ার ব্যাপারটা ঠিক ওইদিনের উপরই নির্ভর করে। কাউন্টিং ঠিকমতো হল কি না, স্ট্রংরুম থেকে সুষ্ঠুভাবে ইভিএম গণনাকেন্দ্রে এসে পৌঁছল কি না, লোডশেডিং হল কি না... এমন হাজারো শর্ত অপেক্ষায় থাকে গণনা-দিবসের। তীর্থের কাকের মতো তাকিয়ে থাকেন দেশের ভোটাররাও। একটি মাত্র ভোট। তার জন্য তাঁরা কেউ হাসপাতাল থেকে ছুটি নিয়ে এসেছেন, কেউ দিনমজুরি ছেড়েছেন, কেউ হাজার হাজার কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে পৌঁছেছেন ভোটকেন্দ্রে। ভোটের লাইনে দাঁড়িয়ে কেউ ভেবেছেন, এবার চাকরি পাব। কেউ ভেবেছেন, এবার ডিজেলের দামটা ৬০ টাকার নীচে নামবে। কেউ আবার ভেবেছেন, ৪০০ টাকায় আগের মতো গ্যাসটা পেলে আর কয়লা বা কাঠ জ্বালাতে হবে না। এটাই যে আসল ভারত। ভোট দেওয়াটা তাদের কাছে বিলাসিতা নয়, সত্যিই আচ্ছে দিনের চাবিকাঠি। তাঁরা প্রতিবাদ করতে জানেন না। সইতে জানেন। আর পারেন মুখ বুজে ফুরিয়ে যেতে। ভোট দেওয়াটাই যে তাঁদের কাছে একমাত্র মাধ্যম... গণতন্ত্র নামক দেবতার কাছে পৌঁছনোর।
ভীষণ যজ্ঞে প্রায়শ্চিত্ত/পূর্ণ করিয়া শেষে/নূতন জীবন নূতন আলোকে/জাগিবে নূতন দেশে।
আজ যে অগ্নিপরীক্ষা ভারতেরও।