সপরিবারে অদূরবর্তী স্থানে ভ্রমণে আনন্দলাভ। কাজকর্মে কমবেশি ভালো। সাহিত্যচর্চায় আনন্দ। ... বিশদ
ভাষা ভাব প্রকাশের মাধ্যম। আনুমানিক প্রায় ১০ হাজার বছর আগে ভাষার জন্ম। তারপর নানা ভাঙা-গড়া বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে এগিয়েছে ভাষার ইতিহাস। যেমন সংস্কৃত ভারতের অন্যতম সুপ্রাচীন ভাষা। তবে, ভাষাতাত্ত্বিকদের কাছে সংস্কৃত ‘মৃত ভাষা’ হিসেবে পরিচিত। কিন্তু বেশ কয়েকটি সুপ্রাচীন ভাষা আধুনিক বিশ্বে বর্তমান। যে ভাষাগুলিতে আজও মানুষ কথা বলেন।
ম্যান্ডারিন: পর্তুগিজ শব্দ ‘মাঁদারিঁ’ থেকে ইংরেজি ‘ম্যান্ডারিন’ শব্দটি এসেছে। যার অর্থ ‘উপদেষ্টা’। ‘মাঁদারিঁ’ শব্দটি মালয় ভাষার মেন্তেরি বা মান্তেরি থেকে পর্তুগিজ ভাষায় প্রবেশ করেছে। আবার এই মান্তেরি শব্দের মূল উৎস সংস্কৃত শব্দ ‘মন্ত্রিন্’- মন্ত্রী বা উপদেষ্টা। চীনা সাম্রাজ্যের উচ্চপদস্থ শিক্ষিত সরকারি কর্মচারীদের নয়টি শ্রেণি ছিল। তাদের মধ্যে একটি হল মাঁদারিঁ। প্রাচীন চীনের ধ্রুপদী সাহিত্যের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে এই মাঁদারিঁ উপাধি তাঁরা অর্জন করতেন। চীনা ভাষার একটি বিশিষ্ট উপভাষায় কথা বলতেন মাঁদারিঁরা। এই উপভাষাটি ম্যান্ডারিন চীনা নামে বর্তমান গণপ্রজাতান্ত্রিক চীনের জাতীয় সরকারি ভাষার মর্যাদা লাভ করেছে। ভাষাটির আনুমানিক বয়স ৩ হাজার ৩০০ বছর। ১২৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে চীনের শাং রাজবংশের সময় এই ভাষার জন্ম ।
হিব্রু: সুপ্রাচীন জীবিত ভাষার তালিকায় ম্যান্ডারিনের পরই হিব্রুর স্থান। বর্তমানে হিব্রু ইজরায়েলের সরকারি ভাষা। প্রায় তিন হাজার বছর আগে ভাষাটির জন্ম। কথ্য ভাষা হিসেবে যে হিব্রু ভাষার প্রচলন ছিল, তা ২০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে বন্ধ হয়ে যায়। সেই সময় শুধু লেখ্য ভাষা হিসেবে এর ব্যবহার হতো। উনিশ শতকের শেষ ও বিংশ শতকের প্রারম্ভের সন্ধিক্ষণে এলিয়েজের বেন ইয়েহুদা নামক রুশ বংশোদ্ভূত এক ইহুদির উদ্যোগে এই ভাষা কথ্য ভাষা হিসেবে পুনঃপ্রতিষ্ঠা লাভ করে। বর্তমানে প্রায় ৯০ লক্ষ মানুষ এই ভাষা ব্যবহার করেন।
তামিল: ভারতের পাশাপাশি শ্রীলঙ্কা ও সিঙ্গাপুরের সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃত তামিল। একসময়ে প্রাচীন দ্রাবিড় ভাষাই ভারতের দাক্ষিণাত্যে প্রধান কথ্য ভাষা ছিল। তবে দ্রাবিড় ভাষাগুলির মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিস্তৃতি লাভ করেছে তামিল ভাষা। এই ভাষায় রচিত সাহিত্য সর্বাধিক সমৃদ্ধ ও সুপ্রাচীন। তামিল ভাষার ধ্বনি প্রকরণ ও ব্যাকরণের সঙ্গে প্রত্ন দ্রাবিড় ভাষার অনেকাংশে মিল রয়েছে। ৬ কোটিরও বেশি মানুষ এই ভাষায় কথা বলেন। তামিল ভাষার বয়স প্রায় দু’হাজার বছর।
ফার্সি: পারস্যের প্রাচীন জনগোষ্ঠীর ভাষা ফার্সি। মধ্য এশিয়ার ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা পরিবারের ইরানীয় শাখার অন্তর্ভুক্ত এই ভাষা। আবেস্তান ও ফার্সি ভাষা প্রাচীন ইরানীয় ভাষার অন্তর্ভুক্ত। প্রায় দুই হাজার বছরের প্রাচীন এই ভাষার সাহিত্যে অতুলনীয় অবদান। আফগানিস্তান ও তাজাকিস্তানে এই ভাষা ব্যবহৃত হয়। সেখানে ভাষাটি তাজিকি ও দারি নামে পরিচিত। কাশ্মীরিও এই ভাষা থেকে উদ্ভুত। সমগ্র বিশ্বে প্রায় ১১ কোটি মানুষ ফার্সি ভাষাভাষী। যার মধ্যে পার্সিয়ান, লুরস, তাজিক, হাজারাস, ইরানি জালিস , ইরানি কুর্দি, বালুচ, তাত ,আফগান পাশতুন ও আইমাক বিশেষ উল্লেখযোগ্য।
আরবি: সৌদি আরব অর্থাৎ আরব উপদ্বীপ খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতাব্দীতে এই ভাষার উদ্ভব হয়েছিল। সেমেটিক ভাষা পরিবারের সদস্য এই ভাষাটির প্রাচীনতম রূপকে বলা হয় ওল্ড আরবি। খ্রিস্টপূর্ব প্রথম থেকে ষষ্ঠ শতাব্দী পর্যন্ত আরব উপদ্বীপের কথ্য ভাষা ছিল এটি। প্রোটো আরবি থেকে বিবর্তিত হয়ে এই ভাষাটি এসেছে। আরবি ভাষার অনেক উপভাষা রয়েছে— সুদানি, মিশরীয় আরবি ও ইয়েমেনি আরবি। বর্তমানে ২৮টি দেশের প্রায় ৪২ কোটি মানুষ এই ভাষা ব্যবহার করেন।
গ্রিক: প্রাচীন ইউরোপের উল্লেখযোগ্য সাম্রাজ্যগুলির অন্যতম গ্রিস। আর এখানকার ভাষা গ্রিক । ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা পরিবারের একটি ভাষা এটি। খ্রিস্টের জন্মের ১ হাজার ৫০০ বছর আগে থেকেই এই ভাষার ব্যবহার চলছে। বর্তমান গ্রিক ভাষায় রয়েছে ২৪টি বর্ণ। যার মধ্যে ৭টি স্বরবর্ণ ও ১৭টি ব্যঞ্জনবর্ণ। প্রাচীন গ্রিসের (খ্রিস্টপূর্ব ১৪০০ থেকে ৩০০অব্দ) মাইসেনীয় অঞ্চলে একটি বিশেষ ভাষারীতি গড়ে উঠেছিল। খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ থেকে ১২০০ অব্দের মধ্যে এই ভাষা বিকাশ লাভ করে। উনিশ শতকে একটি কাদামাটির ফলকে প্রাচীন গ্রিক লিপি আবিষ্কৃত হয় এবং তার পাঠোদ্ধার হয়। মাইসেনীয় গ্রিকের পরেই পাওয়া যায় হোমারীয় গ্রিক অর্থাৎ হোমারের রচিত ইলিয়াড ও ওডিসি মহাকাব্য। ইয়োনীয়, আয়েওলীয় এবং অন্যান্য উপভাষায় সংমিশ্রণে আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৮০০ অব্দে এই ভাষারীতি গড়ে উঠেছিল। সম্রাট আলেকজান্ডারের সময় প্রভূত বিস্তারলাভ করেছিল যে প্রাচীন গ্রিক ভাষা তার নাম হেলেনীয় গ্রিক। যা কোইনি গ্রিক নামেও পরিচিত। কনস্ট্যান্টিনোপল, এশিয়া মাইনর ও কৃষ্ণসাগর অঞ্চলে প্রচলিত ছিল মধ্যযুগীয় গ্রিক ভাষা। এই ভাষাটি বাইজেন্টীয় গ্রিক নামেও পরিচিত। আধুনিক গ্রিক ভাষার জন্ম ১২০০ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে।
লাতিন ভাষা: খ্রিস্টের জন্মের আনুমানিক ৭৫০ বছর আগে এই ভাষার উদ্ভব। এই সময় রোমের পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলোকে বলা হতো লাতিনাম। এই অঞ্চলের মানুষেরা যে ভাষায় কথা বলতেন তা হল লাতিন। খ্রিস্টপূর্ব ১৫০ থেকে ১০০ অব্দে লাতিন ভাষায় ধ্রুপদী সাহিত্য রচনা শুরু হয়। সংস্কৃত ভাষার মতোই সাহিত্যের লাতিন ভাষাটি অপরিবর্তনশীল হিসেবে থেকে যায়। অপরিবর্তনীয় সংস্কৃত ভাষার বিপরীতে যেমন সাধারণ মানুষের কথ্য ভাষা হিসেবে পালি ও প্রাকৃতের উদ্ভব হয়, তেমনই লাতিনের ভাষার বিপরীতে গড়ে ওঠে প্রাকৃত লাতিন। প্রাকৃত লাতিনের বিবর্তনে রোমান্স ভাষার উদ্ভব। ‘রোমান্স’ কথাটির অর্থ ‘কথা বলা’। ইতালীয় ভাষার অন্তর্গত লাতিন ভাষাটি ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষারই উপ পরিবার। রোমানদের আধিপত্যের যুগে সমগ্র ইউরোপে ও ভূমধ্যসাগরের উপকূল অঞ্চলে এই ভাষাটি ছড়িয়ে পড়ে। কালক্রমে একসময় এই ভাষাটি মৃত ভাষাতে পরিণত হয়েছিল। ঊনবিংশ শতকের রোমে এই ভাষা সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। বর্তমানে ভ্যাটিকান সিটির প্রধান সরকারি ভাষা লাতিন। যাকে পোল্যান্ডও স্বীকৃতি দিয়েছে।
বাস্কো: দক্ষিণ-পশ্চিম ইউরোপীয় নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী ইউস্কাদি যাদের আরেক নাম বাস্ক। এদের মাতৃভাষা ইউস্কেরা স্থানীয়দের কাছে বাস্কো নামে পরিচিত। ইন্দো- ইউরোপীয় সংমিশ্রণের প্রায় ছ’হাজার বছর আগে এই ভাষার বিকাশ। বর্তমানে সাড়ে ৭ লক্ষ মানুষ এই ভাষা ব্যবহার করেন। স্পেন এবং দক্ষিণ ফ্রান্স এই ভাষার জন্মস্থান । ইউরোপে জন্ম হলেও এই ভাষাটির সঙ্গে অন্যান্য ইউরোপিয়ান ভাষার কোনও অংশেই মিল নেই । মূলত আদিবাসীরা এই ভাষা ব্যবহার করেন।
লিথুয়ানিয়ান: প্রাচীন প্রোটো ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্গত এই ভাষা। উৎসস্থল লিথুয়ানিয়া হলেও সমগ্র বাল্টিক অঞ্চলেই এই ভাষার প্রভাব রয়েছে। লিথুয়ানিয়া সাধারণতন্ত্র ১৯৯১ সাল থেকে এই ভাষাকে সরকারি ভাষা হিসেবে মনোনীত করেছে। সমগ্র বিশ্বে এই ভাষা ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ২৮ লক্ষ। ভাষাটির আনুমানিক বয়স প্রায় দেড় হাজার বছর।