ভেবেছিল, সবকিছুই হয়তো বদলে যাবে। চিনতে পারবে না কিছু। অথর্ব নিজেও তো কম বদলায়নি। গ্রাম ছাড়ার পর বিগত পঁচিশ বছরে চুলে পাক ধরেছে, চোখে চশমা উঠেছে। এমনকী...। যাইহোক, তবে গ্রামটা সেভাবে বদলায়নি। চিনতে অসুবিধা হল না। গাছে ঘেরা আঁকাবাঁকা রাস্তা, দু’পাশের বসতি, আর সবশেষে বুড়ো বটের সামনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকা প্রকাণ্ড ইশকুল। গ্রামের পাহারাদার। ব্যস এইটুকুই। গ্রামটাকে এইভাবে কোনওদিনও দেখেনি অথর্ব। দেখতে চায়ওনি। তবে আজকে দেখল। কে যেন বলল, ‘আয়। কতদিন বাদে এলি। দু’দণ্ড বোস।’ কিন্তু বসার সময় কই! আসলে কাজটা ভীষণ জরুরি। ব্যস্ততার সঙ্গে এগিয়ে গেল নিজেদের বাড়ির দিকে। সামনে দাঁড়িয়ে মন দিয়ে দেখল। একই আছে। ঠিক যেন ওর চাকচিক্যে ভরা জীবনের তলায় লুকিয়ে রাখা একখণ্ড অতীত। ইটের গাঁথনির মাথায় টিনের চাল। জং ধরেছে টিনে। ভিতরে জলও পড়ে হয়তো। আলকাতরা মাখানো সদর দরজা। অবস্থা তথৈবচ। ভিতরটা ছ্যাঁত করে উঠতেই চাবি খুঁজল। কিন্তু সে কি আর আছে! দরজার উপরে শিকলে আটকানো তালা। জং ধরে যাচ্ছেতাই অবস্থা। হালকা হ্যাঁচকাতেই শেষ। কিন্তু ভাঙল না। পিছন থেকে তখনই হারুকাকার ডাক, ‘হ্যাঁ রে, কবে এলি? বলছি ক’দিন থাকবি তো?’ অথর্ব ভেবেছিল এই সুযোগ। কেউ তো ওকে চিনতে পেরেছে। কাজের কথাটা বলেই ফেলবে। কিন্তু হারুকাকা ততক্ষণে বলে ফেলেছে এখানে খাবি আজ। পুকুরে মাছ ধরেছে। অথর্ব চেয়েও বলতে পারল না। হারুকাকার হাসি মাখা মুখটা থামিয়ে দিল। চুপচাপ ‘হ্যাঁ’ বলে এগিয়ে গেল গ্রামের সেই পাহারাদারের দিকে। রাস্তাতে চোখে পড়ল নিতাই মাঝি, নাপিত জ্যাঠা এমনকী ইশকুলের অনেক বন্ধুও। সকলেরই মুখে সেই একই উচ্ছ্বাস। অথর্ব যেন কাজের নয়, কাছের লোক। গ্রামের ছেলে। কাজের কথাটা বলে মুখগুলোকে আর বিকৃত করল না। যদিও এই মানুষগুলোকেই দূরছাই করত একদিন। জনসমক্ষে পরিচয় দিতে লজ্জা পেত। অতীতের এই অধ্যায়টাকে ধুয়েমুছে সাফ করে ফেলতে চেয়েছিল। পারেনি যদিও। তবে লুকিয়ে রেখেছিল বেশ। ‘কোথা থেকে এসেছ?’ প্রশ্নটার উত্তরে নাম নিত কাছাকাছি একটা মফস্সলের। ‘বাঁশঝাড়’ নামটা যেন লজ্জার। ভাবতে ভাবতেই চোখের সামনে পাহারাদার। দু’চক্ষের বিষ এই ইশকুল। বাঁশঝাড় মোহনবিলাসী বিদ্যালয়কে আড়াল করতে বলত, ‘বিএম স্কুল’। তবে এখন যেন প্রাণ খুলে নামটা বলতে ইচ্ছে হচ্ছিল। বললও। কিন্তু কেউ শুনল না। ইশকুলের জানলায় মুখ রাখলে দূরদূরান্ত থেকে ভেসে আসত ধানজমির বুকে আগলে রাখা জোলো হাওয়া। ঠান্ডা করে দিত সব। অথর্ব অবশ্য সেসবের ধার ধারেনি কখনও। কিন্তু আজকে ভীষণ ইচ্ছে হচ্ছিল। যদি জ্বালাটা একটু কমে। ফাঁকা ইশকুল। ছুটি হয়তো। চারপাশটা ঘুরে জোলো হাওয়া চোখেমুখে লাগাতেই পশ্চিমের আকাশটাকে কে যেন রং করে দিল। সেদিকেই চোখ রেখে পা বাড়াল ফিরতি পথে। বড় রাস্তা পার করে গ্রামের মুখোমুখি একটা জঙ্গল। এই জঙ্গলেই গাছে ঘেরা মাঠে খেলতে যেত ওরা। ইশকুল থেকে ফিরে মুখে কিছু গুঁজেই দৌড়। সেদিকেই পা চালাল। কিন্তু খেলে খেলে বানানো মাঠের যে পিচে এককালে প্লাস্টিকের বলও ড্রপ খেয়ে উঠে যেত কাঁধে সেই পিচটাতেই এখন ঘাস আর চোরকাঁটার রাজত্ব। দু’চারটে ছেলে তন্ময় হয়ে মোবাইল ঘাঁটছিল। মুখই তুলল না। সন্ধে নামছিল। টুকটুক করে তারার মতো ফুটে উঠছিল জোনাকি। ঠিক সেই সময়েই চোখে পড়ল মানুষটা। জঙ্গলের রাস্তা ধরে লাঠি হাতে গ্রামের দিকে যাওয়া একটা মানুষ। সাদা ধুতি, খদ্দরের পাঞ্জাবি, চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা আর মুখে একরাশ প্রসন্নতা। যেন গলা ফাটিয়ে বলতে চাইছে, ‘সব ঠিকই হয়েছে, নিয়ম মেনেই হয়েছে।’ চিনতে অসুবিধা হয়নি অথর্বর। তারিণী স্যর। ইতিহাসের মাস্টারমশাই। ক্লাস সিক্সের ইতিহাসের প্রথম ক্লাস সেদিন। ‘অতীত মানেই সত্য, স্থির। বদলানোর উপায় নেই। ভবিষ্যতের কোনও স্থিরতা আছে নাকি! ও তো সম্ভাবনার একটা ধোঁয়াশা। সবকিছুই হতে পারে।’ তারিণী স্যর বললে অথর্ব আপন খেয়ালেই বলেছিল, ‘কেন স্যর? সূর্য কি কাল পশ্চিমে উঠবে? পূর্ব দিকেই তো উঠবে।’ স্যর তখন চোখ দুটো জ্বলজ্বলে করে বলেছিলেন, ‘নাই উঠতে পারে। যদি পৃথিবী উল্টো দিকে ঘুরতে শুরু করে, কিংবা অন্য কিছু এসে যদি পৃথিবী আর সূর্যের টানটাকে ছিঁড়ে দেয়। কে বলতে পারে?’ অথর্ব অনেক কিছুই ভেবেছিল। কিন্তু গুছিয়ে বলতে পারেনি। তারিণী স্যরকে দেখতেই কথাগুলো হোঁচট খেল মনে। আর তখনই, ‘অথর্ব নাকি রে!’ বলেই ধড়ফড় করে এগিয়ে এলেন স্যর। বললেন, ‘কবে এলি? কতদিন বাদে! কেমন আছিস? এরকম মোটা হয়ে গেলি! এই বয়সেই চুলে পাক ধরিয়ে ফেললি!’ অথর্বকে উত্তরও দিতে দিলেন না। বিদেশের কেউ যেখানে ওর অস্তিত্বই বুঝতে পারেনি, সেখানে এঁরা ওকে বুঝছে কীভাবে! যদিও সংশয়টা মিটিয়ে দিলেন তারিণী স্যর নিজেই। ‘মায়া, বুঝলি। সব মায়া। ইশকুলের পাট চুকিয়ে দিলেও ছেলেপুলে সব মায়ায় বেঁধে রেখেছে। দিনরাত তোদের কথাই ভাবি। তোকে নিয়ে আমার বড্ড দুশ্চিন্তা। হ্যাঁ রে, ভালো আছিস তো?’ আশি ছুঁইছুঁই মানুষটাকে আর কষ্ট দিতে ইচ্ছে হচ্ছিল না। তবুও মাস্টারমশাই তো। তাই বলেই ফেলল, ‘না স্যর। আমি ভালো নেই।’ অন্ধকারটা ততক্ষণে জাপটে ধরেছে। ঝিঁঝিঁর সুরে মায়াজাল বুনছে জোনাকিরা। স্যর বললেন, ‘কী হয়েছে?’ অথর্বও আর ভাবেনি, বলল, ‘শহরে তখন আমি একাই। বাবা চলে গেলে মাকে আমি অনেকবার যেতে বলেছিলাম। কিন্তু শুনলই না। তারপর মাও চলে গেল। আমি আর মায়া করিনি। এদেশের চাকরি ছেড়ে সোজা বিদেশে। টাকা-পদ-বিলাসিতা কোনওকিছুর অভাব ছিল না। দিনরাত কাজ করতাম। এতটুকু ফাঁকি দিইনি। কিন্তু কোপটা পড়ল আমারই ঘাড়ে। মন্দার অজুহাতে মোটা বেতনের কর্মচারী বলে একেবারে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে...। আর বের করতেই সব যেন বদলে গেল। আশেপাশের কেউ যেন চেনেই না। কাজের কী কোনও দাম নেই স্যর?’ গ্রামের সবকিছুই সত্যিকারের। অন্ধকারও। ‘কাজের আবার দাম!’ বলতে বলতেই বললেন, ‘জীবনেরই কোনও নিশ্চয়তা নেই, সেখানে চাকরি। যাকগে মুখচোখ তো শুকিয়ে গিয়েছে। ঘরে চ। খেয়েদেয়ে কথা হবে।’ তবে অথর্ব রাজি হল না। বলল, ‘আমার খিদে নেই স্যর। আমি একটা কাজে এসেছি।’ কিন্তু স্যর গুরুত্বই দিলেন না। বাপমায়ের মতো স্যরদের কাছেও ছাত্রদের বয়স বাড়ে না। শাসিয়েই বললেন, ‘মশকরা হচ্ছে! খিদে নেই মানে! আমি দেখছি চোখমুখ শুকনো।’ পা বাড়াতে একপ্রকার বাধ্যই হল। ‘গ্রাম নিয়ে এককালে আমি লজ্জা পেতাম স্যর। ভাবতাম গ্রাম, ইশকুল আমার নামযশ কমিয়ে দেবে।’ অথর্বর কথাটাতে স্যর বেশ অবাক হলেন। তবে কিছু বললেন না। অথর্বই বলল, ‘কিন্তু অস্তিত্ব হারানোর পরে দেখলাম অতীতটাই সত্য। কেবল মাত্র একটা কাজের জন্য গত তিনদিন ধরে বিদেশের কত পরিচিতর কাছে ছুটেছি। কেউ বুঝতেই পারেনি আমাকে। তবে গ্রামে...।’ তারিণী স্যর এবারে থামালেন। বললেন, ‘অস্তিত্ব আবার হারিয়েছিস কীরে! এই গ্রামের রসদেই তো তোর সব। এই তোর অস্তিত্ব। আর শোন, ঘরের খেয়ে বিদেশের মোষ অনেক তাড়িয়েছিস। এবারে এখানকার গাধাগুলোকে পিটিয়ে ঘোড়া কর। দু’বেলা দুটো করে ব্যাচ পড়া।’ কাজের কথাটা এইবারে বলে ফেলতেই চেয়েছিল অথর্ব। কিন্তু স্যরের ওই সহজ-সরল জীবনটা লোভ দেখিয়ে দিল। ‘যাইহোক কী কাজের কথা বলছিস তখন থেকে? কী এমন কাজ?‘ স্যর জিজ্ঞেস করলেও অথর্ব চুপ। স্যরের বাড়ি পৌঁছতে দেরি হল না। দরজা ধাক্কা দিয়ে তারিণী স্যর যখন বলছেন, ‘কই রে কে আছিস। দরজাটা খোল। দেখ কাকে এনেছি।’ অথর্ব তখনও চুপ। চুপচাপ চলে এসেছিল নিজের সেই জং ধরা তালার ঘরে। ভেবে রাখলেও বলতেই পারেনি, ‘যেদিন আমার চাকরিটা গেল সেই রাতে আমার শরীরটা ভীষণ খারাপ লাগছিল স্যর। পাশে কাউকে পাইনি। গ্রামে ফিরতে ইচ্ছে হচ্ছিল। কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে সবকিছু কেমন যেন অবশ হয়ে গেল। কাউকে ডাকতেও পারলাম না। লন্ডনের বাইরন অ্যাভেনিউয়ের ঘরটাতে আমার দেহটা বিগত তিনদিন ধরে পড়ে রয়েছে। আমি সৎকারের জন্য ওদেশের অনেককেই বলতে চেয়েছি। কিন্তু কেউ দেখতেই পেল না। আপনি একটু ব্যবস্থা করে দেবেন? যদি
মুক্তি পাই!’
‘কাকে এনেছ? কাউকে তো দেখছি না।’ স্যরের স্ত্রী বললেও শুনতে পায়নি অথর্ব। তবে গ্রামের লোকে পেয়েছিল। তারপর থেকে রাত হলেই অথর্বদের ঘর থেকে অদ্ভুত সব আওয়াজ আসে। আজও আসে। যদিও কেউ কিচ্ছুটি বলে না। কিছু করেও না। সবাই জানে অথর্ব এই গ্রামেরই ছেলে। গ্রামের প্রতি ওর বড্ড মায়া। মায়াটা কাটাতে পারেনি।