উচ্চবিদ্যার ক্ষেত্রে বাধার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হতে হবে। উচ্চতর বিদ্যার ক্ষেত্রে শুভ ফল পাবে। কর্মপ্রার্থীদের ... বিশদ
‘‘...মধ্যরাত্রে, যখন জগৎ নিদ্রায় মগ্ন, ভারত জাগবে জীবন ও স্বাধীনতায়—।’’ এই কথাগুলো বলেছিলেন জওহরলাল নেহরু ১৯৪৭ সালের ১৪ ও ১৫ আগস্টের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে কনস্টিটুয়েন্ট অ্যাসেমব্লির সভায়। স্বাধীন ভারতবর্ষের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর জন্মদিন ১৪ নভেম্বর। এই দিনটি সর্বসম্মতিতে ‘শিশুদিবস’ হিসেবে পালিত হয় ১৯৬৪ সালে তাঁর মৃত্যুর পর থেকে। কারণ, জওহরলাল নেহরু যেমন ভালোবাসতেন শিশুদের, তেমনি শিশুরাও তাঁকে নিজেদের আপনজন জ্ঞান করত। আজ তোমাদের শোনাব সেই মানুষটির কথা, যিনি ভারতবর্ষের প্রধানমন্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও শিশুদের কাছে ছিলেন তাদের পরমপ্রিয় ‘চাচা নেহরু’।
জওহরলাল নেহরুর বাবা ছিলেন এলাহাবাদ হাইকোর্টের প্রখ্যাত আইনজীবী মতিলাল নেহরু। মায়ের নাম স্বরূপরাণী। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দেবার ফলে বহুবার মতিলালকে বন্দিজীবন যাপন করতে হয়েছে। ১৮৯৮ সালের ১৪ নভেম্বর জওহরলাল এই এলাহাবাদ শহরেই জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর দুই বোন বিজয়লক্ষ্মী ও কৃষ্ণা। ‘আনন্দভবন’ নামক এক বিশাল বাড়িতে থাকতেন তাঁরা। বাড়িতেই মিস্টার ব্রুকস্ নামে একজন অতি সুযোগ্য ইংরেজ শিক্ষকের হাতে জওহরলাল ও তাঁর বোনদের শিক্ষার ভার তুলে দেন মতিলাল। তাই ছোটবেলা থেকেই ইংরেজি লেখায় বিশেষ পারদর্শী হয়ে ওঠেন জওহরলাল। পাশাপাশি হিন্দি ও সংস্কৃত ভাষাও শেখেন। বাড়িতে বাল্যশিক্ষার শেষে জওহরলাল বিলেতের সেরা বিদ্যালয় ‘হ্যারো’ স্কুলে ভর্তি হলেন ১৯০৫ সালে। এখানকার পড়া কৃতিত্বের সঙ্গে শেষ করে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ট্রিনিটি কলেজ’ থেকে তিনি কুড়ি বছর বয়সে গ্র্যাজুয়েট হলেন। বিজ্ঞানে একই সঙ্গে তিনটি বিষয়ে অনার্স (ট্রাইপস্) পেয়েছিলেন তিনি। এরপর জওহরলাল কেমব্রিজে ব্যারিস্টারি পড়েন এবং ভারতে ফিরে নিজেকে একজন আইনজ্ঞ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। ১৯১৬ সালে তাঁর বিয়ে হয় কমলা কাউলের সঙ্গে। তাঁদের একমাত্র সন্তান হলেন ইন্দিরা, যিনি পরবর্তীকালে ভারতবর্ষের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন।
বিলেত যাবার আগের বছর যদিও জওহরলাল বাবা মতিলালের সঙ্গে জাতীয় কংগ্রেসের বোম্বাই অধিবেশনে যোগ দিয়েছিলেন, কিন্তু তখনও পর্যন্ত তাঁর মধ্যে স্বাদেশিক চেতনার কিছুমাত্র বিকাশ ঘটেনি। ছোটবেলা থেকেই তিনি অ্যানি বেসান্তের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। ১৯১৭ সালে যখন ব্রিটিশ সরকার বিশিষ্ট সমাজতান্ত্রিক অ্যানি বেসান্তকে নিপীড়ন করেন, তখন জওহরলাল নেহরু সর্বপ্রথম তীব্র প্রতিবাদ করেন। এইভাবেই রাজনীতির আঙিনায় তাঁর পা পড়ে। ঠিক এই সময়েই ঘটে যায় ‘জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ড’। ভারতের রাজনীতিতে প্রবল আলোড়ন ওঠে। বিক্ষুব্ধ জওহরলাল, মতিলাল নেহরু প্রতিষ্ঠিত ‘দ্য ইন্ডিপেনডেন্ট’ পত্রিকার কর্ণধার হিসেবে এইসব ঘটনার বিরুদ্ধে জ্বালাময়ী ভাষায় প্রতিবাদ করেন। শুরু হয় মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলন। এবার জওহরলাল মন থেকে সায় দেন এই আন্দোলনকে। এবং গান্ধীজিকেই অনুসরণ করবেন স্থির করে ফেলেন। ১৯২১ থেকে ১৯২২ সাল পর্যন্ত কারাদণ্ড ও জরিমানা দণ্ড ভোগ করেন তিনি। এর আগে উত্তরপ্রদেশের কৃষকদের নিয়ে আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে প্রথম দেশের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ার সুযোগও পান তিনি। ১৯২০ সালে এলাহাবাদ কংগ্রেস কমিটির সহসভাপতি হন। ১৯২৩ সালে সর্বভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সম্পাদক ও ১৯২৯ সালে কংগ্রেস সভাপতি নির্বাচিত হন। জওহরলাল জীবনে বহুবার কারাবাস করেছেন। তাঁর বিখ্যাত বই “An Autobiography” তিনি কারাগারে বসেই রচনা করেছিলেন যা প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৩৬ সালে। ১৯২৩ সালে তিনি এলাহাবাদ পৌরসভার সভাপতি নির্বাচিত হন। জনস্বাস্থ্য, শিক্ষা ইত্যাদি বিভাগে গড়ে তোলেন নিয়মশৃঙ্খলা। জওহরলালের জীবনে এরপর পরপর আসে মৃত্যুশোক। বাবা, স্ত্রী এবং মা মারা যান। এর ফলে তিনি আরও বেশি করে দেশের সেবায় নিজেকে জড়িয়ে ফেলেন।
১৯৪২ সালের ঐতিহাসিক আগস্ট বিপ্লব শুরু হবার আগেই আবারও ব্রিটিশ সরকার কারারুদ্ধ করল তাঁকে। কিন্তু তিনি দমেননি। মহাত্মা গান্ধীর আদর্শে অনুপ্রাণিত জওহরলাল নেহরু ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের অন্যতম প্রধান নেতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট স্বাধীন ভারতের পতাকা তাঁর হাতেই উত্তোলিত হয়েছিল।
ব্যক্তিজীবনে অত্যন্ত রুচিবান এবং একজন সুলেখক ছিলেন তিনি। তাঁর বিখ্যাত বইগুলির অন্যতম হল— ‘দ্য ডিসকভারি অফ ইন্ডিয়া’, ‘লেটারস্ ফ্রম এ ফাদার টু হিজ ডটার’, ‘গ্লিমসেস অফ ওয়ার্ল্ড হিস্ট্রি’, ‘সোভিয়েত রাশিয়া, চায়না, স্পেন অ্যান্ড দ্য ওয়ার’, প্রভৃতি। মানবতা, ধর্মনিরপেক্ষতা, অনুভূতিপ্রবণতা, চিন্তাশীলতা এই সমস্ত ক্ষেত্রেই মহাত্মা গান্ধীর পরেই দেশের অন্যতম বরেণ্য নেতা হলেন তিনি। গান্ধীজির প্রভাবে তাঁর পরিবার ভোগবিলাসের জীবন ত্যাগ করেছিলেন। তখন থেকেই জওহরলাল খাদির তৈরি কাপড় পরতেন। গান্ধীজির প্রভাবে তিনি ভগবত গীতাপাঠ ও যোগব্যায়ামের অভ্যাস শুরু করেন।
আগে ২০ নভেম্বর পালিত হতো ‘শিশুদিবস’ হিসেবে। কিন্তু ১৯৬৪ সালের ২৭ মে জওহরলাল নেহরুর মৃত্যুর পর শিশুদের ভবিষ্যতের জন্য তাঁর অবদানের কথা মনে রেখে তাঁর জন্মদিনের দিন পালিত হয়ে আসছে ‘শিশুদিবস’। তাঁর সময়েই দেশে বহু গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পথচলা শুরু হয়েছিল। তেমনি সুচিকিৎসার কথা মাথায় রেখে ‘আইএমএস’-এর সূচনা করেছিলেন তিনিই। ‘আইআইটি’ও তাঁর উর্বর মস্তিষ্কের ফসল। এছাড়া ‘ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ ম্যানেজমেন্ট’ তৈরি করার সিদ্ধান্তও তাঁরই। তিনি চাইতেন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি যেন মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে, যাতে আগামীদিনে আরও উন্নত হয় মানুষের প্রতিদিনের জীবন।
‘আজ আমরা যেভাবে শিশুদের বড় করব, কাল সেভাবে এরা দেশ চালাবে’— বলেছিলেন জওহরলাল, কারণ, তিনি জানতেন শিশুরাই দেশের ভবিষ্যৎ। প্রতি বছর ১৪ নভেম্বর যখনই আসবে, আজকের শিশুরা তাঁকে স্মরণ করতে করতে মনে মনে নিশ্চয়ই শপথ করবে তাদের ‘চাচা নেহরু’র এই ভাবনাকে ভাবীকালের শিশুদের কাছে পৌঁছে দেবার।
ছবি: সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে