উচ্চবিদ্যার ক্ষেত্রে বাধার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হতে হবে। উচ্চতর বিদ্যার ক্ষেত্রে শুভ ফল পাবে। কর্মপ্রার্থীদের ... বিশদ
তিনি আরও বলেছিলেন, জাতপাতের বিভাজন প্রবণতা বহু প্রাচীন এক শত্রু ভারতে। এই চেনা শত্রুদের পাশাপাশি, এখন ভারতে এসেছে নানাবিধ বৈচিত্র্যের রাজনৈতিক দল, যারা পরস্পরবিরোধী রাজনৈতিক নীতির অনুসারী। আম্বেদকর প্রশ্ন করেছিলেন, দেশবাসী কি সেই সব নীতির ঊর্ধ্বে রাখবে দেশকে? নাকি দেশের ঊর্ধ্বে রাখবে নিজেদের বিশ্বাস ও নীতিকে? আমার জানা নেই। কিন্তু এটা নিয়ে
সন্দেহ নেই যে, যদি রাজনৈতিক দলগুলি নিজেদের দলীয় নীতি আদর্শকে দেশের স্বার্থেরও উপরে স্থান দেয়, তা হলে আমাদের স্বাধীনতা দ্বিতীয়বারের
জন্য আবার সঙ্কটে পড়বে। হয়তো চিরকালের মতো সেই স্বাধীনতা লুপ্ত হবে।
ইংরেজিতে একটি শব্দ আছে। এথনিক ডেমোক্রেসি। অর্থাৎ বিশেষ সম্প্রদায়ের গণতন্ত্র। এই এথনিক ডেমোক্রেসির আদর্শ রূপ হিসাবে বলা হয় ইজরায়েলকে। সেখানে ডেমোক্রেসি থাকলেও ইহুদিদের সুযোগ সুবিধা অধিকার তুলনামূলকভাবে বেশি হিসাবেই অঘোষিত রীতি। সেটা অবশ্যই কোনও সরকারি নির্দেশিকায় পাওয়া যাবে না। তবে সমাজজীবনে পরিলক্ষিত। ভারত সম্পর্কে আন্তর্জাতিক মহলে দীর্ঘকাল ধরে যে ইমেজ রয়েছে সেটি হল বিশ্বের সবথেকে বৃহৎ একটি বহুত্ববাদী সংস্কৃতি। বস্তুত সেটাই ভারতের আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে যে, সেই ইমেজটি সরিয়ে দিয়ে ভারতের সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের জনগণ এবং শাসকগোষ্ঠী কি আদতে এথনিক ডেমোক্রেসির পথেই হাঁটতে আগ্রহী? নাকি ভারতের সংবিধান নির্দেশিত পথটিই অক্ষরে অক্ষরে পালিত হবে? এই প্রশ্নের উত্তরের উপর অনেক কিছুই নির্ভর করছে। একটি দেশের সংখ্যাগুরু শ্রেণী যদি সেই দেশের শাসককে স্পষ্ট ভাবে বুঝিয়ে দেয় যে, তারা এটা দেখে মনে মনে অত্যন্ত আনন্দিত হয় যখন বিশেষ কোনও সংখ্যালঘু শ্রেণীর স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হচ্ছে কিংবা ওই শ্রেণীকে সামাজিকভাবে কোণঠাসা হতে দেখা যাচ্ছে কিংবা সেই শ্রেণী যদি সরকার বা আইনের সহায়তা কম কম পাচ্ছে ইত্যাদি। সংখ্যালঘুদের এই সঙ্কট দেখে মনে চাপা আনন্দ হয় অনেকের। আর জনতার এই মনোভাব যদি সরকার বা শাসক জেনে যায়, তা হলে অনেক গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা থেকে জনতার দৃষ্টি সরিয়ে নেওয়া সহজ হয়। কাশ্মীরের ৩৭০ নং ধারার অবলুপ্তিকরণকে যদি নীতিগত ভাবে ভারতের ঐক্যের জন্যই প্রয়োজন বলে মনে করা হয় (অবশ্যই সমর্থনযোগ্য), তা হলে সেই একই কারণে নাগাল্যাণ্ড, মণিপুর, অরুণাচল প্রদেশের বিশেষ বিশেষ
অধিকার বা আইন নিয়েও আপত্তি বা ক্ষোভ থাকা উচিত ছিল সংখ্যাগুরুর। তা কিন্তু হচ্ছে না। যত ঐক্যের আবেগ কাশ্মীরকে ঘিরে দেখা গেল। কেন? উত্তরটা জানা সকলের।
এ ভাবে জনগণের মনের অনুভূতিকে বুঝতে পেরে যে জ্বলন্ত বিষয়গুলি জনগণকে প্রতিনিয়ত সঙ্কটে ফেলছে, অসুবিধার মুখোমুখি করাচ্ছে, আর্থিক ভাবে বিপদে ফেলছে, সেই ইস্যুগুলির তুলনায় শাসক সামনের সারিতে নিয়ে আসতে সুযোগ পায় ধর্মীয় অথবা সম্প্রদায়গত অ্যাজেণ্ডাকে দৈনন্দিন চর্চা বা পাবলিক ডিসকোর্সের মধ্যে নিয়ে আসতে।
আর এথনিক ডেমোক্রেসির বন্দনাকারী জনতাও আরও বেশি করে মশগুল হয়ে পড়ে। ৩৭০ নিয়ে আনন্দ হয়। রামমন্দির নিয়ে আনন্দ হয়। সংখ্যাগুরুর মনোভাবে এমনিতে দ্বিচারিতা মিশে থাকে।
যেমন সংখ্যাগুরু শ্রেণী অত্যন্ত খুশি হয়, যখন দেখা যায় একজন মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ হিন্দুদের পুজোয় অংশ নিয়েছে, কিংবা দুর্গাপূজায় আয়োজনে যুক্ত হয়েছে কিংবা কোনও মন্দিরের রক্ষণাবেক্ষণে এক মুসলিম জড়িত। তখন এই সংখ্যাগুরু শ্রেণী সেটিকে সর্বধর্মসমন্বয়ে, প্রকৃত ভারত, উদার
ভারত ইত্যাদি আখ্যায় ভূষিত করে। অথচ ঠিক বিপরীত যখন ঘটে, অর্থাৎ কোনও হিন্দু যদি মুসলিমদের পরবে অংশ নেয় অথবা কোনও বিতর্কে তাদের পক্ষে কথা বলে, তখন সেই লোকটিকে তকমা দেওয়া হয় তোষণকারী।
ভারতের মতো বৈচিত্র্যময় একটি দেশ যদি সার্বিকভাবে সংখ্যাগুরুর ডেমোক্রেসিতে পরিণত হয়, তা হলে সেই দেশের জনতার একটা সময় পর কিন্তু ক্লান্ত লাগবে। কারণ আমাদের দেশের অভ্যাসই হল সর্বধর্মসমন্বয়, বছরভর নানাবিধ পরবে মেতে থাকা। সেই কারণেই আজমির শরিফকে পাশ কাটিয়ে কেউ নিছক পুষ্করে পুজো দিয়ে আবার ফিরে আসে এমন নয়। আজমির শরিফেও একবার ঢুকে একটা চাদর চড়িয়ে আসেন হিন্দুরাও।
প্রতি বৃহস্পতিবার দিল্লির নিজামউদ্দিন দরগার কাওয়ালি অনুষ্ঠানে নিয়ম করে সব সম্প্রদায়ের মানুষই সমবেত হয়ে ওই ধর্মসঙ্গীত উপভোগ করেন হৃষ্ট চিত্তে। ক্রমেই যদি দেখা যায় গোটা দেশে সংখ্যাগুরুদের দাপটই বেশি এবং অন্য ধর্মাবলম্বীরা সম্পূর্ণ আড়ষ্ট ও নীরব জীবনযাপন করছেন, তা হলে আজ যারা এথনিক ডেমোক্রেসিকেই নিজের শক্তি হিসাবে কল্পনা করছে তাদের ভুল ভাঙবে এক সময়। কারণ যদি এটাই একটি দেশের প্রকৃত শক্তি বা উন্নয়নের রূপরেখা হতো, তা হলে পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, বাংলাদেশ এতদিনে অনেক এগিয়ে যেত। এমনকী চীনকে এ ভাবে নিজেদের গোপন করে রাখতে হতো না। তাদের অভ্যন্তরে কী চলছে, কত মানুষ যে অপরিসীম দারিদ্র্যে বাস করছে সেটা যাতে বহির্জগৎ জানতে না পারে, তা নিশ্চিত করতে এত কাঠখড় পোড়াতে হতো না চীনকে। দরজা খুলে দিত। এথনিক ডেমোক্রেসির লক্ষ্য হল সর্বদাই যে কোনও সমস্যার জন্য একটি বিশেষ শ্রেণীকেই দোষারোপ করার দিকে জনতাকে ঠেলে দেওয়া। এর ফলে সরকারের দিকে আঙুল তোলে না কেউ।
কিন্তু আশার কথা হল ভারতের একটা অত্যাশ্চার্য ব্যালান্স করার চরিত্র আছে। বিশেষ করে গ্রামীণ ভারতের। ঠিক যখন মনে হচ্ছে ভারত বোধহয় ক্রমেই সংখ্যাগুরুর ডেমোক্রেসিতে পরিণত হতে চলেছে, তখনই আচমকা একের পর এক রাজ্য বিধানসভা ভোটে দেখা যাচ্ছে বিজেপি ধাক্কা খাচ্ছে। গত বছর এক সঙ্গে মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, ছত্তিশগড়ে বিজেপির পরাজয় হওয়ার পরও বিজেপি শীর্ষ নেতৃত্ব কিংবা কর্মী সমর্থকরা সেই ফলাফলকে সেভাবে গুরুত্ব দেয়নি। ভাবা হয়েছিল ওটা বোধহয় সাধারণ অ্যান্টি ইনকামবেন্সি। কিন্তু এবার হরিয়ানা এবং মহারাষ্ট্রে বিজেপি একক গরিষ্ঠতা না পাওয়া আরও বড় বার্তা। অর্থাৎ হাইপার ন্যাশনালাইজেশন কিংবা হিন্দুত্ববাদী অ্যাজেণ্ডা তীব্র হলেও বিজেপি বিপুল ভাবে জয়ী
হচ্ছে না। উল্টে কোনও কেন্দ্রীয় বা রাজ্য নেতা, শক্তিশালী সংগঠন না থাকা সত্ত্বেও কংগ্রেস বা বিরোধীরা অনায়াসে প্রচুর আসনে বিজেপিকে
হারিয়ে দিচ্ছে। এটা অবশ্যই এক অন্যরকম মনোভাব বদলের আভাস।
আর এই সমীকরণটির জন্ম হচ্ছে গ্রামীণ ভারতে। দেখা যাচ্ছে প্রধানত গ্রামাঞ্চলেই এভাবে বিজেপি ধাক্কা খাচ্ছে। অর্থাৎ যে গ্রামজীবনের সঙ্গে সরকারের প্রত্যক্ষ ভাবে রোটি কাপড়া মকানের সম্পর্ক, তারা কোনও কারণে ক্ষুব্ধ। তারা মনে করছে না যে তাদের সব কিছু ভালো আছে। তাই তারা সরকারি পার্টিকে ভোট দিচ্ছে না রাগ করে। এই রাগকে সংখ্যাগুরুর ডেমোক্রেসি কমাতে পারছে না। শিবসেনা এতকাল পর হঠাৎ কেন বিজেপির হাত ছেড়ে দেওয়ার সাহস পেল? তারা চূড়ান্ত প্রফেশনাল একটি পলিটিক্যাল পার্টি। তারা জানে কীভাবে কখন সুবিধা আদায় করতে হয়। সুতরাং নেহাত ইগো নয়। শিবসেনা হয়তো আঁচ পেয়েছে যে, বিজেপি দুর্বল হচ্ছে। এই প্রতিটি বার্তাই অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। কেন্দ্রে মনে করা হচ্ছে নরেন্দ্র মোদি অপরাজেয়। তাঁর তুলনীয় কোনও জনপ্রিয় নেতাই নেই বিরোধী শিবিরে। অথচ সেই মোদির নির্বাচনী প্রচার সত্ত্বেও রাজ্যে রাজ্যে বিজেপি আগের তুলনায় আরও শক্তিশালী হওয়ার তুলনায় বরং ক্রমেই দুর্বল হচ্ছে। কেন? এই উত্তরটি খুঁজতে হবে বিজেপি শীর্ষ নেতৃত্বকে। বস্তুত মোদি সরকারকে বেছে নিতে হবে যে কোনও একটি পথ। হয় সংখ্যাগুরুর ডেমোক্রেসির পথকে আরও প্রশস্ত করা অথবা গণতন্ত্রের মূল স্ট্রাকচার অক্ষুণ্ণ রেখে অবিলম্বে রোটি কাপড়া মকান, বিজলী পানি সড়কের সেই চিরাচরিত লক্ষ্যপূরণে ডুবতে বসা অর্থনীতিকে শক্তিশালী করে রাজনৈতিক গণতন্ত্রকে সামাজিক গণতন্ত্রেও সম্প্রসারিত করা। কারণ, বিগত ৩০ বছরে সব থেকে বেশি যে ইন্ডাস্ট্রি দ্রুত হারে বেড়েছে সেটি হল, বৈষম্য। ইনইকোয়ালিটি।
সর্বশেষ যে ন্যাশনাল স্যাম্পল সার্ভের হেলথ রাউণ্ড সমীক্ষা পাওয়া যাচ্ছে সেখানে একটা অদ্ভুত তথ্য পাওয়া গিয়েছে। যত দিন যাচ্ছে, ততই গরিব মানুষ চিকিৎসার কাছে যাচ্ছে না। অর্থাৎ প্রথাগত চিকিৎসার খরচ এতই বেড়ে গিয়েছে যে, ভারতের গরিব মানুষের বিপুল অংশ অনেক জটিল রোগ শরীরে পুষে রেখেই টোটকা বা ধামাচাপা দেওয়া ব্যবস্থায় থেকে যাচ্ছে। ১৯৮৬ সালের রাউণ্ড সার্ভের পর ২০১৬ সালের রাউণ্ড সার্ভে পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে যে প্রবণতা কমার কথা, সেটি আদতে বেড়ে যাচ্ছে বছর বছর। অর্থাৎ গরিব মানুষের চিকিৎসা ব্যবস্থা থেকে দূরে থাকা।
সমীক্ষায় জানা গিয়েছে, এটা স্রেফ টাকার অভাবে। এটা হল স্বাস্থ্য। এবার শিক্ষা। একটিমাত্র রাজ্য নিয়ে ছোট একটি তথ্য। যেখানে আগামী ৩০ নভেম্বর বিধানসভা ভোট। ঝাড়খণ্ড। এই রাজ্যে প্রতি ১০০ টি ছাত্রছাত্রীর মধ্যে মাত্র ৩০ জন শেষ পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষার গণ্ডিটি পেরোয়। ৭০ জনই প্রাইমারি লেভেলেই ড্রপ আউট হয়ে যায় স্কুল থেকে। যার মধ্যে আবার সিংহভাগ বালিকা। ঝাড়খণ্ডের পাকুড় জেলায়
এই বালিকাদের স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে যায় দুটি কারণে। হয় খেতমজুরি করতে পাঠানো হয় অথবা ওই বাল্যকালেই বিয়ে দেওয়া হয়! দুই ক্ষেত্রেই টাকা
পায় গরিব বাবা মা!
সংখ্যাগুরুর ডেমোক্রেসি নয়। বরং অনেক
জরুরি কাজ হল সংবিধান অনুসরণ করা। যেখানে রক্ষা করতে বলা হয়েছে, জাস্টিস, লিবার্টি, ইকোয়ালিটি! ওটাই পথ!