উচ্চবিদ্যার ক্ষেত্রে বাধার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হতে হবে। উচ্চতর বিদ্যার ক্ষেত্রে শুভ ফল পাবে। কর্মপ্রার্থীদের ... বিশদ
তিনবছর আগে প্রথমে নোটবন্দির ধাক্কা, আর তার পরে জিএসটির সাঁড়াশি চাপে সেই যে বাজার ঘুমিয়ে পড়েছে, তা আজও কাটেনি। সব হাতে কাজ নেই। সদ্যসমাপ্ত অক্টোবর মাসের বেকারত্বের হার রেকর্ড পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮.৫ শতাংশে। ঠিক তার আগের মাসে এই হার ছিল ৭.২ শতাংশ। নোটবন্দির পর ২০১৭ সাল থেকেই দেশে বেকারত্বের হার ক্রমে বাড়তে থাকে। ওই বছর হার ছিল ৬.১ শতাংশ। একটি পরিসংখ্যান বলছে ৪৫ বছরে দেশে এমন বেকারত্ব দেখা যায়নি। এমনকী, জিএসটি থেকে আদায় প্রথম দিকে কিছু বাড়লেও এই উৎসবের মাসে সেটাও ৫.৩ শতাংশে নেমে এসেছে। আর এইখানেই সবচেয়ে বেশি উদ্বেগ দেখা দিচ্ছে। অথচ, সরকারটা কিন্তু বেমালুম চলছে বিরোধীদের সবক্ষেত্রে কোণঠাসা করে। এমনকী, খোদ গান্ধী পরিবারের এসপিজি নিরাপত্তা পর্যন্ত পত্রপাঠ প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে, যা নিয়ে বিতর্ক কিছু কম হচ্ছে না। বিরোধীদের অসম্মান করে, কোণঠাসা করে প্রকৃত গণতন্ত্র
বাঁচতে পারে না। একদা কংগ্রেসও এই একই ভুল করেছে। আজও সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে। সেটাই একান্ত দুঃখের।
তবে ধুরন্ধর শাসক যতই ফন্দি ফিকির করুন না কেন রাজনীতির সাফল্য তখনই সম্ভব হয় যখন অর্থনীতি চাঙ্গা থাকে। মরা, এমনকী ঝিমিয়ে পড়া অর্থনীতিও দেশকে, দেশের মানুষকে কোনওদিন ভালো রাখতে পারে না। দেশকে ভালো রাখতে শিল্পোৎপাদন বাড়ানো তাই একান্ত জরুরি। আর সামগ্রিক চাহিদা বাড়লে তবেই উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব। একমাত্র তখনই নতুন করে বিনিয়োগে আগ্রহী হন লগ্নিকারীরা। লগ্নি বাড়লে কর্মসংস্থানের পরিবেশও সুগম হয়। কিন্তু, নোটবন্দি ও জিএসটির জোড়া সঙ্কটে শিল্পের পরিবেশ ক্রমেই সঙ্কটজনক হয়ে দাঁড়াচ্ছে। শিল্পোৎপাদন কমছে। চাহিদা কমছে। এর ফলে মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন আর বৃদ্ধির জায়গায় নেই। শিল্প ও উৎপাদন মার খেলে দেশের খেটে-খাওয়া শ্রমিক-কর্মচারীরা কোনওভাবেই ভালো থাকতে পারে না। অর্থনীতির এটাই সহজ পাঠ। তাই বিশ্বব্যাঙ্ক, আইএমএফ, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক কেউই এই কঠিন সময়ে কোনও স্বস্তি দিতে পারছে না। হঠাৎই গাড়ি শিল্পে এক ভয়ঙ্কর মন্দা নেমে এসেছে। কয়েক লক্ষ লোক এই উৎসবের মরশুমেই কাজ হারিয়ে বেকার। একই অবস্থা নির্মাণ ও আবাসন শিল্পেও। সেখানেও হাজার হাজার অসমাপ্ত প্রকল্প শত শত শ্রমিক কর্মচারীর মুখের গ্রাস কেড়ে নিয়েছে। বোনাস পাওয়া তো দূর অস্ত, প্রতি মাসে তাঁরা বেতনটুকুও পাচ্ছেন না। বিরোধীদের অভিযোগ, আসল সমস্যার সমাধান করতে না পেরেই ক্রমাগত অন্যদিকে নজর ঘুরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে সরকার। এবারও একদিকে যখন কাশ্মীরি ৩৭০ ধারার অবলুপ্তি ঘিরে মোদি সরকার স্বপ্ন দেখাতে শুরু করেছে, তখনই আবাসন শিল্পের এই মন্দা হাজার হাজার শ্রমিককে বেকারত্বের দিকে ঠেলে দিয়েছে। বহু প্রথম সারির কর্পোরেট সংস্থায় ব্যাপক ছাঁটাই পর্যন্ত শুরু হয়ে গিয়েছে।
মাঝেমধ্যে শেয়ার বাজার চাঙ্গা হওয়ার খবরে একশ্রেণীর বড়লোক খুশি হলেও এর কোনও প্রভাব খেটে খাওয়া আম জনতার কাছে পৌঁছয় না। গাড়ি শিল্পে যেমন ব্যাপক কর্মচ্যুতির সঙ্কট নেমে এসেছে, তেমনি নির্মাণ ও আবাসনের মতো অসংগঠিত ক্ষেত্রেও অবস্থা তথৈবচ। এমএ, পিএইচডি করেও বহু কৃতী ছেলেমেয়ে কম বেতনে অল্প যোগ্যতার চাকরিতে যোগ দিতে বাধ্য হচ্ছে। এই অবস্থায় সরকার ও রিজার্ভ ব্যাঙ্ক ২৫ হাজার কোটি টাকার একটি তহবিল তৈরি করছে নির্মাণ ও আবাসন শিল্পকে কিছুটা চাঙ্গা করতে। এই প্রকল্পে কেন্দ্রীয় সরকার সরাসরি দেবে ১০ হাজার কোটি টাকা। আর স্টেট ব্যাঙ্ক ও এলআইসি দেবে বাকি ১৫ হাজার কোটি টাকা। অর্থমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী, সারা দেশে আটকে থাকা বা অসমাপ্ত ১৬০০টি আবাসন প্রকল্পে প্রায় সাড়ে চার লক্ষ ফ্ল্যাট এই নয়া প্রক্রিয়ায় সম্পূর্ণ হতে পারবে। কিন্তু, এনপিএ বা দেউলিয়া হয়ে যাওয়া আবাসন প্রকল্পে টাকা ঢেলে নতুন করে কি কোনও সুরাহা মিলবে, নাকি ফের ওই টাকাও জলে যাবে—তা নিয়ে প্রশ্ন কিন্তু থেকেই যাচ্ছে। এর উপর বেসরকারি ক্ষেত্রে যখন পরিস্থিতি সঙ্কটজনক তখনই বিএসএনএল-কে বাঁচাতে কেন্দ্রীয় সরকার এক স্বেচ্ছাবসর কর্মসূচি চালু করেছে। এটা একদা সরকারের অত্যন্ত লাভজনক সংস্থা বিএসএনএল-কে বাঁচানোর শেষ চেষ্টা। এই পদক্ষেপ যদি ব্যর্থ হয়, তাহলে সামগ্রিকভাবে সরকারের মুখ পুড়তে বাধ্য। সব হাতে কাজ না-থাকলে সবার বিকাশ সম্ভব নয়। কাশ্মীর, ৩৭০ ধারা ও ৩৫এ ধারার অবলুপ্তি গত আগস্ট মাস থেকে কেন্দ্রীয় সরকারকে নিঃসন্দেহে একটা গতি দিয়েছে, তার সংস্কারমুখী ভাবমূর্তিকে উজ্জ্বল করেছে। যদিও ব্যাপক প্রচার চললেও তার কোনও প্রতিফলন আমরা মহারাষ্ট্র ও হরিয়ানার নির্বাচনের ফলে দেখিনি। এখন আবার অযোধ্যার রায় এসে গিয়েছে। আগামী কিছুদিন তাই অযোধ্যা নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের রায়ই জাতীয় রাজনীতির মূল চালিকা শক্তি হয়ে দাঁড়াবে। মানুষ ভুলে যাবে অর্থনীতির সঙ্কটের কথা। ব্যাপক মূল্যবৃদ্ধির কথা। পেঁয়াজের দাম যে কোন জাদুতে ৮০ টাকা কেজি হল, সেই রহস্যের কথা। বেকারত্ব, কাজহারা মানুষের বিলাপ, আর্তনাদ
এসব ছাপিয়ে আবার মন্দির-মসজিদ নিয়ে আমরা মেতে উঠব! রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীরাও তার ফায়দা তুলতে কসুর করবেন না। কিন্তু, সাধারণ খেটে-খাওয়া মানুষ যে তিমিরে সেই তিমিরেই দিন কাটাবে। এই পরিস্থিতিতে অর্থনীতি আগামী তিন-চার মাস কোন পথে চলে, তা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ এক প্রতীক্ষা।
নরেন্দ্র মোদি-অমিত শাহ জুটি মুখে যাই বলুন, বেকারত্ব বৃদ্ধি নিয়ে তাঁরাও যে উদ্বিগ্ন তার হাতে গরম প্রমাণ ইতিমধ্যেই মিলেছে। আর সেই উদ্বেগের ধাক্কাতেই চাকরি ও কর্মসংস্থান নিয়ে মোদি সরকার সম্প্রতি ব্যাংককে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তিতে সই করা থেকে পিছু হটেছে।
১৬টি দেশের গুরুত্বপূর্ণ ওই সম্মেলনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী উপস্থিত হয়েও শেষ পর্যন্ত ওই চুক্তিতে সই করবেন না বলে জানিয়ে দিয়েছেন। সবাইকে অবাক করেই তিনি জানিয়ে দিয়েছেন, অন্তরাত্মার ডাকেই একাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রী যতই জাহির করুন না কেন, বিরোধীদের চাপ এবং অর্থনৈতিক মন্দার কারণেই তিনি যে শেষ পর্যন্ত পিছু হটতে বাধ্য হয়েছেন, তা দিনের আলোর মতোই পরিষ্কার। অন্যথায় চীনাসহ অন্যসব বিদেশি সামগ্রীতে বাজার আরও ছেয়ে যেত। ভারতীয় জিনিস কেনার আর কেউ থাকত না। কাজ হারাত এ দেশেরই অসহায় শ্রমিকরা। যে ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’র ডাক দিয়ে নরেন্দ্র মোদি দেশীয় শিল্পকে নতুন করে উৎসাহ দেওয়ার কৌশল নিয়েছিলেন তা মাঠে মারা যেত। তবে আগামী দিন যে অত্যন্ত ভয়ঙ্কর হতে চলেছে তার ইঙ্গিত দেশের আম জনতা, খেটে-খাওয়া মানুষ ইতিমধ্যেই পেতে শুরু করে দিয়েছে। অযোধ্যা বা মন্দির-মসজিদ দিয়ে ভোটের আসর সাময়িক মাত করা যায়, কিন্তু তা দিয়ে গরিবের পেট ভরে না। এই আপ্তবাক্য আমাদের দেশের রাজনৈতিক নেতারা কবে বুঝতে পারবেন? ভোটের নাগপাশ থেকে বেরিয়ে কবে তাঁরা মানুষের স্বার্থে উন্নয়ন ও শান্তি প্রতিষ্ঠার রাজনীতি করবেন, তা ঈশ্বরই জানেন।