উচ্চবিদ্যার ক্ষেত্রে বাধার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হতে হবে। উচ্চতর বিদ্যার ক্ষেত্রে শুভ ফল পাবে। কর্মপ্রার্থীদের ... বিশদ
অসুর লিখেছেন, ‘বাবা, আমি মুখ্যুসুখ্যু সাধারণ মানুষ। খুব বেশি কিছু বুঝি না। তবে মনে হল, এক সাংঘাতিক সময় আসতিসে। দ্যাশের মানুষের আর দ্যাশ বলে কিছু থাকবে নি। এক কলমের খোঁচায় সব অনুপ্রবেশকারী হয়ে যাবে। সবার মধ্যে দেকতে পাচ্ছি এনআরসি আতঙ্ক। শুনলাম ওখানে নাকি বড় বড় খাঁচা বানাচ্ছে। সেখানে মানুষকে পুরে রাখবে। ডিটিনশন ক্যাম্প নাকি কী যেন বলছিল সব। ওরাই বলছিল, কে যেন এক হিটলার অমনই এক ক্যাম্প বানিয়েছেল। আমি তো ছোটজাত। অসুর। লোকে ঘেন্না করে আমায়। জানি না, সামনের বছর আর আমাকে মায়ের বাপের বাড়ি ঢুকতে দেবে কিনা! কে জানে হয়তো ওই ডিটিনশন ক্যাম্পেই আটকে রেখে দেবে। বড় ভয় বাবা, বড় ভয়!’
অসুরের রিপোর্ট পড়ে শিব চিন্তায় পড়লেন। ভাবলেন নন্দী-ভৃঙ্গী যুগলকে একবার মর্ত্যে পাঠিয়ে ডিটেলস রিপোর্ট সংগ্রহ করবেন।
পরের রিপোর্ট গণেশের। পড়তে শুরু করলেন শিব। ‘বাবা, বিশ্বকর্মাকাকু ফিরে এসে বলেছিলেন, দেশের সর্বত্রই শিল্পের দফারফা চলছে। চাঙ্গা একমাত্র চৌর্যশিল্প। যে যেখানে পারছে হাত মেরে কামাচ্ছে। তবে অধিকাংশ রাজনীতিক এবং ব্যবসায়ী এ ব্যাপারে সিদ্ধহস্ত। দুজনে লতায় পাতায় একেবারে মাসতুতো ভাই। এ বলে আমায় দ্যাখ, ও বলে আমায় দ্যাখ। প্রায় সর্বত্র লুটেপুটে খাওয়ার চিহ্ন স্পষ্ট। আমি গিয়ে সেটাই দেখলাম। ব্যাঙ্ক থেকে ব্যবসার জন্য টাকা নিয়ে গণেশ উল্টে সবাই বিদেশে পালাচ্ছে। এই ‘গণেশ ওল্টানো’ শব্দটা দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে। ওটা যে আমার কাছে কতটা অপমানজনক তা বলে বোঝাতে পারব না। ইচ্ছে করে সব ক’টাকে শুঁড়ে জড়িয়ে আছাড় মারি। এর সঙ্গে এবার যে মহা ঝামেলার ব্যাপার দেখলাম তা হল রাজ্যজুড়ে বিভিন্ন ব্রিজের টলোমলো অবস্থা। সর্বত্র একটা আতঙ্ক। এই বুঝি ভেঙে পড়ল। ঘরপোড়া গোরু তো সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পাবেই। ’
রিপোর্ট পড়ে শিব একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। একবার বিশ্বকর্মাকে পাঠাতে হবে। সব ব্রিজের একটা তদন্ত রিপোর্ট অবিলম্বে তাঁর চাই।
পরের মেলটা সরস্বতীর। খুলে পড়তে শুরু করলেন শিব। ‘একটা কথা বলতেই হয়। সেটা হল শিক্ষার দৈন্যদশা সর্বত্র চলছে। শিক্ষার থেকে রেজাল্ট বড়। ভালো রেজাল্ট করার জন্য যা চলছে তা মোটেই কাম্য নয়। ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের বইয়ের ব্যাগ বইতে বইতে পিঠের শিরদাঁড়া বেঁকে যাওয়ার জোগাড়। আবার দেখলাম বহু পণ্ডিত পুরাণ, শাস্ত্রকে ইতিহাস আর বিজ্ঞান বলে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন। কেউ কেউ তো সমস্ত ওষুধের বিকল্প হিসাবে গোময় এবং গোমূত্রকে চালানোর পক্ষে সওয়াল করছেন। সব ঘেঁটে ঘ হয়ে যাচ্ছে। ওদিকে আবার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের কৌলিন্য নিয়ে গর্ব করার মতো দিন ছিল আমাদের। সেই কৌলিন্য যেন ধুলোয় লুটিয়ে যেতে বসেছে। শিক্ষাঙ্গনে যা যা হচ্ছে তা আমি তোমাকে সব বলতে পারব না। রাজ্যের মানুষ তা জানে। রাজনীতি এক জিনিস, কিন্তু নোংরামি অন্য। শিক্ষার দেবী হয়ে লজ্জায় আমার মাথা কাটা যাওয়ার জোগাড়। আমি শুধু বলতে পারি এই অশিক্ষার পরিবেশ অবিলম্বে দূর করা দরকার। সব থেকে ভালো হয়, যদি তুমি কাউকে আলাদা পাঠিয়ে একটা ডিটেলস রিপোর্ট তৈরি করাও।’
শিব ভাবলেন, সেটা করা দরকার। নিজের মনেই বললেন, একবার অশ্বিনীকুমার ভাইদের পাঠাবো ভাবছি।
এবার তিনি কার্তিকের পাঠানো রিপোর্ট পড়তে শুরু করলেন। ‘এবার ঘুরে এসে থেকে একটা ব্যাপার আমার মাথায় ঘুরছে। শুনে এলাম কেন্দ্রীয় সরকার সব নাকি বেসরকারি হাতে বেচে দেবে। রেল, ব্যাঙ্ক, বিমা, বিমান আরও অনেক কিছু। আমি ঠিক করেছি, সরকার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বেচলেই আমি কিনে নেব। শুনলাম রাশিয়া, আমেরিকা, চীন, ফ্রান্স নাকি লাইনে আছে। ঘোষণা হলেই ঝাঁপিয়ে পড়বে। পুরো দেশের প্রতিরক্ষা আমিই চালাব। আর মাঝে মাঝে পাকিস্তানে সার্জিক্যাল স্ট্রাইক করব। লোকে আমার নামে ধন্য ধন্য করবে। তবে একটা কথা আমার মনে হয়েছে, যত টাকার অস্ত্র কেনা হয়, তার বড় অংশ যদি দেশের স্বাস্থ্য খাতে আর পরিবেশ খাতে ব্যয় করা যেত, তবে দেশটা অন্যরকম হত।’
শিব পড়ে মুচকি হাসলেন। নিজের মনেই বললেন, প্রতিরক্ষা শক্তি তো বাড়াতেই হবে। অস্ত্র কেনাটা সব সরকারেরই একটা অভ্যাস। সব ডিলই মোক্ষম ডিল। তাই অস্ত্র কেনাটা জরুরি কর্তব্য।
পরের ই-মেল লক্ষ্মীর। শিব পড়তে শুরু করলেন। ‘সব দেখলাম ভাঁড়ে মা ভবানী। রাজকোষ বাড়ন্ত। সরকার আর্থিক দুর্বলতার কথা স্বীকার না করলেও দেশের মানুষ সব জানে। ফেসবুকে ফেসবুকে এনিয়ে কত যে ব্যঙ্গ, মিম চলছে তা বলে বোঝানো যাবে না। আর সরকার বারবার বোঝানোর চেষ্টা করছে, আর্থিক সূচক ঊর্ধ্বমুখী এবং আর্থিক অগ্রগতি বোঁ বোঁ করে ছুটছে। সরকার বলছে, দেশে নোট বদলের প্রভাব তেমন দেখা যায়নি। সরকারের এখন সবথেকে বড় মাথাব্যথা হল, আর্থিক ক্ষেত্রটাকে মসৃণ রাখা। ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থা নিয়ে মানুষের মধ্যে ক্ষোভ বাড়ছে। যেসব নিয়মনীতি চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে তাতে অনেকেই অসন্তুষ্ট। কিন্তু শুধু সংখ্যার জোরে সরকার অনেক কিছু চাপিয়ে দিচ্ছে। বিরোধী বলে কিছু নেই। তাই পরিস্থিতি খুবই খারাপের দিকে যাচ্ছে।’
শিব বললেন, ‘যে দেশটা স্বাধীনতার পর থেকেই আকণ্ঠ দুনীর্তিতে ডুবে আছে, তার পরিণতি তো এমনই হবে। দুনীর্তিই হল দেশের মূল শত্রু।’
এবার দুর্গার ই-মেল খুলে পড়তে শুরু করলেন শিব। ‘একদিন আমি অসুর মেরে সমস্ত স্বর্গলোককে রক্ষা করেছিলাম। কিন্তু বারবার বাপের বাড়ি গিয়ে যেসব অভিজ্ঞতা নিয়ে আমি ফিরে আসি, তাতে মনে হয়, আমি ব্যর্থ। কিছুই করতে পারলাম না। কত অসুর যে মর্ত্যলোকে ঘুরে ফিরে বেড়াচ্ছে, আমি দেখেও কিছু করতে পারি না।
একটা সাজানো অসুরকে আমি প্রতি বছর বধ করে দেশের মানুষের পূজিত হই। অথচ সমাজে কত অসুরের দল বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমি দেখেছি অনেক রাজনৈতিক অসুর। তারা সমাজে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। তারা মেয়েদের মর্যাদা দেয় না। রাজনৈতিক ক্ষমতার বলে বলী হয়ে কোনও মেয়েকে ধর্ষণ করে। পুলিস অভিযোগ নেয় না। উল্টে তাদের বাড়ি গিয়ে শাসায়। সাক্ষীকে মাঝপথে ট্রাক চালিয়ে পিষে মেরে ফেলে। ধর্ষণ, পীড়ন চৌর্যবৃত্তির পর তাদের আত্মরক্ষার বর্ম হল রাজনীতি। ব্যবসায়ী, শিল্পপতিদের মধ্যেও এইসব অসুরকে আমি দেখেছি। আবার শিক্ষক অসুরও আছে। কন্যাসম ছাত্রীদের তারা শ্লীলতাহানি করে। এতটুকু বিবেক, মানবিকতা তাদের নেই। তাছাড়া প্রোমোটার অসুর, ডাক্তার অসুর, আইনজীবী অসুরদেরও আমি দেখেছি। এসব দেখে খুব হতাশ লাগে। অসুর আমার পায়ের কাছে বসে বলে, মা সব দেখছো তো? আমি বলি, সব দেখছি বাবা। কিছু করা যাবে না। যাদের হাতে ক্ষমতা, তাদের ধ্বংস হতে সময় লাগবে। তাছাড়া এখন চারিদিকে মানবাধিকার কর্মীরা ঘুরে বেড়াচ্ছে। সবাই আমাকে ফাঁসিয়ে দেবে। তোদের সময় মানবাধিকার ব্যাপারটা ছিল না বলেই তোকে বধ করতে পেরেছি। নাহলে তুইও বেঁচে যেতিস। অসুর আমায় বলেছিল, আমি তো বেঁচে আছি মা। তুমি তো আমাকে মারতে পারনি। রক্তবীজের মতো আমি মানুষের মধ্যে বেঁচে আছি। ক্ষমতায়, বাহুবলে, হিংসায়, লোভে, কামনায়, প্রবৃত্তিতে, লুণ্ঠন মানসিকতায়, পাপবোধে, আগ্রাসনে। আমরা মানুষের সব শুভবোধকে শেষ করে দেব। এই পৃথিবীকে করে তুলব অসুরদের বাসভূমি। তাই শুনে আমি বলেছি, তা আমি হতে দেব না। সুযোগ হলেই আমি তোদের বিনাশ করব। চণ্ডীর সইে শ্লোকটা জানিস তো! ইত্থং যদা যদা বাধা দানবোত্থা ভবিষ্যতি / তদাতদাবতীর্য্যাহং করিষ্যামি অরিসংক্ষয়ম। আসুরিক অত্যাচারে এই ধরা পীড়িত হয়ে উঠলে আমি আবির্ভূত হয়ে সেই অসুরিক শক্তিকে বিনাশ করব। অসুরদের দমন শুধু সময়ের অপেক্ষা। আমি আসবই।’
শিব অস্ফুটে বললেন, ‘তুমিই পারবে দুর্গা। নারীশক্তি যখন অপমানিত হয়, তখনই তো শুরু হয় ধ্বংসের খেলা। আমি সেই ধ্বংসের ছবি মানস চক্ষে দেখতে পাচ্ছি।’
কার্টুন সুব্রত মাজী