উচ্চবিদ্যার ক্ষেত্রে বাধার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হতে হবে। উচ্চতর বিদ্যার ক্ষেত্রে শুভ ফল পাবে। কর্মপ্রার্থীদের ... বিশদ
এরপর পাকিস্তান দেখেছে, দাড়িওয়ালা বিক্ষোভকারীদের গাড়ির বিশাল বিশাল কনভয়। হাতে উঁচু করে ধরা কালো ও সাদা পতাকা। সুক্কুর, মুলতান, লাহোর এবং গুজরানওয়ালা হয়ে সর্ষে হলুদ রঙের পোশাক পরা প্রতিবাদকারীরা শুক্রবার পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদে জড়ো হয়েছে। তাদের দাবি, ‘অদক্ষ প্রশাসক’ প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে পদত্যাগ করতে হবে। বিক্ষোভকারীদের গাড়ির বহর যতই চোখ ধাঁধানো হোক না কেন সেখানে আরও একটি বিষয় নজর কাড়ছে সকলের, এই বিক্ষোভে নেই কোনও মহিলার অংশগ্রহণ। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, আজাদি মার্চ শুরু হওয়ার আগে যে লিফলেট প্রকাশ করা হয়েছে তাতে মহিলাদের ঘরে থাকার আহ্বান জানিয়ে বলা হয়েছে, ‘রোজা ও নামাজ পড়তে’।
পাকিস্তানের বিরোধী দল জমিয়াত উলেমা-এ-ইসলামের প্রধান মৌলানা ফজলুর রহমানের দাবি, ‘আমরা যাতে সফল হই, সে জন্য তাঁরা রোজা রেখে আল্লার কাছে দোয়া করছেন।’ একইসঙ্গে তাঁর ঘোষণা, ‘এখন দেশ আমাদের নিয়ন্ত্রণে। আমরা ভেঙে পড়া অর্থনীতিকে মাথা তুলে দাঁড় করাব। অর্থনীতিকে একটি স্থিতিশীল অবস্থায় নিয়ে আসাই আমাদের লক্ষ্য।’ সেই সঙ্গে দেশের ‘শক্তিশালী’ প্রতিষ্ঠানগুলিকে নিরপেক্ষ থাকতে অনুরোধ করেন ফজলুর। ‘শক্তিশালী’ প্রতিষ্ঠান বলতে তিনি যে সেনাকে বুঝিয়েছেন, তা নিয়ে পাক রাজনীতিকদের সন্দেহ ছিল না। বিক্ষোভ সমাবেশে বারবার বলেছেন, ইমরান খান সেনাদের পুতুল।
ইমরান খানকে পদত্যাগের জন্য রবিবার পর্যন্ত সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছিল। ফজলুর রহমান ইঙ্গিত দিয়েছেন, রবিবারের মধ্যে ইমরান পদত্যাগ না করলে বিক্ষোভকারীদের নিয়ে তিনি রেড জোনে প্রবেশ করবেন। কোনও চাপেই তিনি নতি স্বীকার করবেন না। পাল্টা জবাবে ইমরান খানও জানিয়ে দিয়েছেন, কোনও অগণতান্ত্রিক দাবি মানা হবে না। বিক্ষোভকারীরা যেন সরকারকে ব্ল্যাকমেল করতে না পারে সে বিষয়েও সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন। পরিস্থিতি যে একটা ভয়াবহ আকার ধারণ করতে চলেছে, তা আঁচ করেই পাক পুলিস-প্রশাসন প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়েছে। ইসলামাবাদের গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোতে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে।
হিংসা রুখতে রাজধানীর সর্বত্র সেনা এবং আধাসামরিক বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে প্রশাসনকে সতর্ক থাকতে নির্দেশ দিয়েছেন পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ মন্ত্রী ইজাজ শাহ। পার্লামেন্টের সামনে সাঁজোয়া যান মোতায়েন করা হয়েছে। স্পর্শকাতর জায়গাগুলোতে নিরাপত্তা বাহিনীর অতিরিক্ত সদস্যও আনা হয়েছে। জমিয়াত উলেমা-এ ইসলামের প্রধানের হুমকির পর প্রধানমন্ত্রীর বানি গালা বাসভবনের দিকের সড়কগুলোতে নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে।
প্রশ্ন হল, ইমরান খানকে উৎখাতের ডাক দেওয়া কে এই ফজলুর রহমান? বাবা মুফতি মাহমুদের হাত ধরেই ফজলুর রহমানের রাজনীতিতে আসা। ১৯৭৯ সালের ৯ নভেম্বর করাচির খালিকে দুনিয়া হলে মৌলানা প্রথম রাজনৈতিক বক্তব্য রাখেন। এই বক্তব্যে তিনি তৎকালীন সেনাশাসক জেনারেল জিয়াউল হকের রাষ্ট্রপ্রধান পদে বসার সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করেন। এরপর থেকে তাঁর জেলে যাওয়া আসা শুরু। ১৯৮১ সালে তিনি যখন জেনারেল জিয়াউল হকের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে কারাবন্দি হন। তখন তাঁকে জমিয়াতে উলেমা-এ ইসলামের জেনারেল সেক্রেটারি নির্বাচন করা হয়। ১৯৯৫ সালের ২৮ মার্চ জামেয়া মাদানিয়া করিমপার্কে ৩২৫ সদস্যের অধিকাংশের মতামতের ভিত্তিতে ফজলুর রহমান সভাপতি নির্বাচিত হন। ফজলুর রহমান রাজনৈতিক মামলায় মোট ১০ বার কারাবরণ করেছেন।
১৯৯৩ সনে বেনজির ভুট্টো দ্বিতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হলে ফজলুর রহমান জাতীয় সংসদের বিদেশ বিষয়ক কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৯৬ সালে যখন বেনজির ক্ষমতাচ্যুত হন, তখন নওয়াজ শরিফের তদন্ত ব্যুরো সর্বশক্তি নিয়োগ করেও ফজলুর রহমানের বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ আনতে পারেনি। আগেও পাকিস্তানে ইসলামি অনেক দল ছিল, কিন্তু তা কোনও জাতীয় শক্তির রূপ ধারণ করতে পারেনি। ফজলুর রহমান ২০০২ সালে সব ইসলামি দল নিয়ে ‘মুত্তাহিদা মজলিসে আমল’ (এমএমএ) নামে একটি জোট গঠন করেন। যার সভাপতি ছিলেন বেরেলভিপন্থি মৌলানা শাহ আহমদ নুরানি এবং মুখপাত্র ছিলেন তিনি নিজে। এতে জামাত, শিয়াসহ সব মত ও পথের লোকেরা তাঁর নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হয় এবং এমএমএ কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে ৭২টি আসনে জয়লাভ করে।
পাকিস্তানের সাংবাদিক হামিদ মীর একবার তাঁর এক সম্পাদকীয় কলামে লেখেন, ‘অনেক যুবক আমাকে জিজ্ঞেস করেন যে, পাকিস্তানে সবচেয়ে উঠতি রাজনীতিবিদ কে? আমি সাধারণত এমন প্রশ্ন এড়িয়ে চলি। কিন্তু কিছু নাছোড়বান্দা যখন আমাকে চেপে ধরে, তখন অনায়াসে তাদের জবাবে মুখ থেকে বেরিয়ে আসে, মৌলানা ফজলুর রহমান। মজার কথা হল, কেউ কেউ এই জবাব শুনে খুশিতে আত্মহারা হয়ে যান, আবার কেউ কেউ অগ্নির্শমা হয়ে বলেন যে, তাহলে তাঁকে ‘ডিজেল মৌলানা’ বলা হয় কেন? আমি সাধারণত এ কথার জবাব এভাবে দিই যে, তাঁকে ডিজেল মৌলানা খেতাবদাতা জনাব আতাউল হক কাসেমিও একথা অকপটে স্বীকার করতে বাধ্য যে, ফজলুর রহমান পাকিস্তানের উঠতি রাজনীতিবিদের প্রথম সারির একজন।’
এহেন ফজলুর রহমান ডাক দিয়েছেন, ‘পাকিস্তানের গর্বাচেভকে পদত্যাগ করতে হবে।’ বিক্ষোভকারীদের উদ্দেশ্যে দেওয়া বক্তৃতায় বলেন, ‘২৫ জুলাইয়ের নির্বাচন ছিল জালিয়াতিতে ভরা। ওই নির্বাচনের পর ক্ষমতায় আসা সরকার কিংবা সরকারকে স্বীকৃতি দিচ্ছি না আমরা। সরকারকে আমরা এক বছর সময় দিয়েছি। কিন্তু এখন আর বেশি সময় দেওয়া যাবে না। ইসলাম ও পাকিস্তান কখনও আলাদা হতে পারে না। ইসলামি সাংবিধানিক ধারাগুলো বাস্তবায়নের দাবিগুলো থেকে দূরে রাখতে পিটিআই সরকারের কোনও কর্তৃত্ব নেই।’ পিটিআই সরকারের চাপিয়ে দেওয়া দাসত্বের অর্থনীতি বিরোধী দল মেনে নেবে না বলে দাবি করেন এই রাজনীতিবিদ। আর এই দাবিতেই জমিয়াত উলেমা-এ ইসলামের আজাদি মার্চ জনসমুদ্রের রূপ নিয়েছে।
পাকিস্তানি ও দলীয় পতাকা উড়িয়ে কয়েক হাজার গাড়ি নিয়ে এই পদযাত্রায় অংশ নিয়েছে আন্দোলনকারীরা। ইমরানবিরোধী ‘গো নিয়াজি গো’ স্লোগানসহ সরকারবিরোধী প্রচারে গোটা দেশ উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। ইমরান বিরোধী হাওয়াকে আরও উস্কে দিতে সরকারবিরোধী এই পদযাত্রায় পাকিস্তান পিপল’স পার্টি, পাকিস্তান মুসলিম লিগ-নওয়াজ, আওয়ামি ন্যাশনাল পার্টিসহ বিভিন্ন দলের প্রতিনিধিরাও সমর্থন দিয়ে অংশ নিয়েছেন। ইসলামাবাদে ফজলুরের বাড়িতে তাঁর সঙ্গে আলোচনায় বসেন পাকিস্তান পিপলস পার্টির বিলাবল ভুট্টো জারদারি, পাকিস্তান মুসলিম লিগ-নওয়াজের আহসান ইকবাল, খাজা আসিফ, পাখতুনখোয়া মিল্লি আওয়ামি পার্টির মেহমুদ খান আছাকজাইয়ের মতো বিরোধী নেতারা।
বিশাল এই জনরোষ সত্ত্বেও নির্বাচিত সরকারের প্রধান ইমরান খানের উপরই আস্থা প্রকাশ করেছে পাক সেনাবাহিনী। সেনাবাহিনীর মুখপাত্র মেজর জেনারেল আসিফ গফুর জানিয়ে দিয়েছেন, আমরা আইন ও সংবিধানে বিশ্বাসী। আমাদের সমর্থন নির্বাচিত সরকারের উপরই থাকবে, কোনও নির্দিষ্ট দলের পক্ষে নয়। সেনাবাহিনীর দিকে ইঙ্গিত করে ফজলুর রহমান জানিয়ে দিয়েছেন, যদি ইমরান খান পদত্যাগ না করেন এবং তাঁর ‘প্রতিষ্ঠানটি’-র সুরক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করেন, তাহলে ওই ‘প্রতিষ্ঠানের’ বিরুদ্ধেও জনমত গঠন করা হবে। বিরোধীরা অবাধে এই জনমত গঠন করবে। সেনাবাহিনী যাই বলুক না কেন, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের পদত্যাগ এবং পুনরায় নির্বাচনের দাবিতে অনড় বিরোধীরা। কী হতে চলেছে পাকিস্তানে? কেউ জানে না।
পাকিস্তানে অনেকে ঠাট্টা করে বলছেন, ফজলুর রহমানের উত্থানে ইমরানের ফের পিঙ্কি পীরনির দ্বারস্থ হওয়া ছাড়া উপায় নেই! পিঙ্কি পীরনি কে জানেন? পাকিস্তানের ফার্স্ট লেডি। তিনি একজন মহিলা পীর। স্বপ্ন আর ভবিষ্যৎ নিয়েই বুশরা মানেকার কারবার। ভক্তরা তাঁকে পিঙ্কি পীরনি বলেই চেনেন। নিজের শহর লাহোরের বাইরেও তাঁর অনেক অনুসারী। সেই পিঙ্কি পীরনি এক রাতে স্বপ্ন দেখলেন। ২০১৫ সালে মানেকা যাঁকে স্বপ্নে দেখেছিলেন তিনিও একসময় তাঁর ভক্তদের দলে শামিল হলেন।
সেই ভক্তের নাম ইমরান খান। ইমরান খান তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘পাকিস্তানে বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে লাখ লাখ মানুষ তাঁদের অনুসরণ করে, ধর্মীয় থেকে নিত্যদিনের জীবনের সমস্যা নিয়ে তাঁদের কাছে পরামর্শ চায়।’ ১৯৯০–এর মাঝামাঝি ইমরানের সৌভাগ্যে মেঘের চিহ্ন ছিল না। বিশ্বকাপ জিতেছেন। ধনী সুন্দরীকে বিয়ে করেছেন। মায়ের স্মরণে ক্যান্সার হাসপাতাল গড়েছেন। এত সব অর্জনের মধ্যে পাকিস্তানের এক ছোট শহরের এক মহিলা পীরের ভবিষ্যদ্বাণী তাঁকে আর কী দিয়েছে জানেন? রাজনীতি।
অনেক প্রতিষ্ঠিত রাজনীতিবিদ, সামরিক বাহিনীর বড় কর্তারা ইমরানকে নিজের কাছে টানার চেষ্টা করছিলেন। শেষ পর্যন্ত ইমরান খান ১৯৯৬ সালে নিজের দল বানালেন। নাম দিলেন তেহরিক ই ইনসাফ। মানে ন্যায়ের জন্য আন্দোলন, যা পিটিআই নামে পরিচিত। প্রথম নির্বাচনে পার্টি কোনও আসন পেল না। পরের নির্বাচনে জিতলেন শুধু নিজের আসনে। ২০১৩ সালে তাঁর ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা যখন তুঙ্গে, তখনও পিটিআই জিতল মাত্র ৩৫ আসন। ২০ বছর ধরে তিনি বিদেশে থাকা বন্ধুদের বলতেন, ‘পরের বার দেশে এলে দেখবে আমি প্রধানমন্ত্রী।’ চারটা নির্বাচন গেল, দুটো বিয়ে ভাঙল কিন্তু প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আশা অধরাই রয়ে গেল। ঠিক এই সময়ই বুশরা মানেকা তাঁর স্বপ্ন দেখলেন।
এর পরের অংশ এক আরব্য রজনীর গল্প হয়ে পাকিস্তানিদের মুখে মুখে ফেরে। মানেকার স্বপ্নে নাকি এক কণ্ঠস্বর বলেছিল, ইমরান খান যদি প্রধানমন্ত্রী হতে চান তাহলে তাঁকে সঠিক মহিলাকে বিয়ে করতে হবে। সঠিক মহিলা মানে মানেকার পরিবারের কেউ। এই গল্পের অন্য সংস্করণ বলছে যে বিয়ের জন্য মানেকা প্রথমে তাঁর ছোট বোনের কথা বলেন। আরেক গল্প বলছে, তাঁর আপন মেয়ের কথা। ইমরান দুই প্রস্তাবই নাকচ করেন। মানেকা আবার স্বপ্ন দেখলেন।
এবার আর কোনও ইশারা নয়। স্বপ্নে জানতে পারলেন ইমরানের যে স্ত্রী দরকার, সেটা তিনি নিজেই। পাঁচ সন্তানের মা মানেকা প্রস্তুত হলেন। তাঁর কাস্টমস অফিসার স্বামী আপসে বিবাহ বিচ্ছেদে রাজিও হয়ে গেলেন। ২০১৮–এর ফেব্রুয়ারিতে ক্রিকেটার আর ভবিষ্যৎ–দ্রষ্টার বিয়ে হল ঘনিষ্ঠজনদের নিয়ে ছোট পারিবারিক অনুষ্ঠানে। এর ছয় মাস পর ইমরান খান হলেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। পিঙ্কি পীরনি হলেন পাকিস্তানের ফার্স্ট লেডি। পিঙ্কি পীরনি কি পারবেন, এ যাত্রায় ইমরানকে বাঁচাতে?