উচ্চবিদ্যার ক্ষেত্রে বাধার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হতে হবে। উচ্চতর বিদ্যার ক্ষেত্রে শুভ ফল পাবে। কর্মপ্রার্থীদের ... বিশদ
কার কতটা ভূতের ভয় তা আমার জানা নেই, আমার কিন্তু খুবই ভূতের ভয়, তাই রাতে আমি একা একা ঘরে শুতে পারি না, চোখ বুঝলেই ভূশুণ্ডির মাঠ থেকে হাজার হাজার ভূত উড়ে এসে আমাকে ঘিরে ধরে, কেউ আমার পা ধরে টানে কেউ বা আবার কাতুকুতু দিয়ে আমাকে নাজেহাল করে ছাড়ে, সে সব দুঃখের কথা আজ নয় ছেড়েই দিলাম। তাই ভূত নিয়ে কিছু লিখতে গেলে আমার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসে, গায়ের লোম খাড়া হয়ে যায়।
বেশ কিছুদিন হল আমেরিকায় এসেছি, নিঃসন্দেহ এটি একটি স্বপ্নের দেশ। প্রকৃতি যেন তার সমস্ত সম্পদ দিয়ে দেশটিকে উজাড় করে সাজিয়েছে। যে দিকেই তাকাই মনে হয় যেন কোনও এক নিপুণ শিল্পী তার ক্যানভাসে ধরে রেখেছে এর সৌন্দর্যের নিদর্শন। এ দেশে মানুষজনের সংখ্যা এতই কম অনেকটা পথ হাঁটার পর দু’একজন মানুষ দেখা যায়। রাত হলেই গা ছমছম করে, এ যেন এক আজব দেশ। তবে এই নির্জন নিরালা জায়গায় আধিভৌতিক কাণ্ড হামেশাই ঘটে, ভূতপ্রেত দেখা যায় শুনেছি। নিউজার্সি, ক্যানকটিকা, মেরিল্যান্ড এখনকার কিছু কিছু জায়গা আমার দেখা, লোকজন নেই বললেই চলে। আমার এক প্রিয়জন সাউথ ক্যারোলিনায় পড়াশুনো করতে গিয়েছিল। তার মুখ থেকে শোনা, সে ছিল একজন গবেষণার ছাত্র, রাত হয়ে যেত প্রায় ল্যাবরেটরি থেকে বের হতে। ক্যাম্পাস থেকে তার পিজি হোস্টেলটি বেশ কিছু দূরে ছিল, সাইকেল করেই সে যাতায়াত করত, মাঝপথে পড়ত একটা হালকা জঙ্গল। সে দু’একবার দেখেছে এক অপরূপা মেম, উচ্চতা প্রায় ছ’ফুটের মতো, ঘন অন্ধকারের মধ্যে তার গায়ের রঙের ঝলক, অন্ধকার ভেদ করে বেরিয়ে আসছে। কিছুটা পথ আগুপিছু করে সে জঙ্গলের মধ্যে কোথায় যেন মিলিয়ে যেত। ভৌতিক পরিবেশ সৃষ্টি না করে ভূতের গল্প হয় না। তাই আরেকটি ঘটনার কথা বলি, নায়াগ্রা জলপ্রপাত দেখতে গিয়ে গাইডের মুখে এ কাহিনী শোনা। ‘স্ক্রিমিং টানেল’ নায়াগ্রা জলপ্রপাতের কুখ্যাত ভৌতিক স্থানের অন্যতম। এখানকার মানুষজন বলে এই টানেলের ভেতরে একটি দেশলাইকাঠি দিয়ে আগুন জ্বালালে সঙ্গে সঙ্গে সেটি আগুনের গোলা হয়ে টানেলের বাইরে চলে যাবে। আর শোনা যাবে একটি ছোট্ট মেয়ের চিৎকার যা খুবই ভয়ানক।
ভূতেদের কথা নিয়ে যখন লিখছি তখন বরং অন্যরকম এক ভূতের কাহিনী শোনাই আজ।
বিশ্বের এমন কতকগুলি দেশ আছে যারা বছরের একটি দিনে ভূতেদের আমন্ত্রণ জানায়। আমি আমেরিকায় যে পাড়ায় থাকতাম সেটি হল নিউইয়র্ক শহরের কুইনস বোরোতে। সেই পাড়াতে নানা দেশের মানুষের বাস আমেরিকান, আইরিশ, স্প্যানিশ, গাইনিজ, বাংলাদেশি এবং আফ্রো আমেরিকান। একদিন সন্ধ্যাবেলা নির্জন রাস্তা দিয়ে বাড়ি ফিরছি, ফুটপাতে সারি সারি ম্যাপল গাছ। হাডসন নদী থেকে ফুরফুরে হাওয়া উড়ে আসছে, গাছগুলিতে ফল লেগেছে অর্থাৎ পাতার রং পাল্টাচ্ছে, সবুজ থেকে কমলা তারপর হলুদ, ঝরে পড়ার আগে হয় লাল। এ যেন এক অভিনব প্রকৃতির রং বদলের খেলা, রাস্তার দু’ধারে ছবির মতো বাগানওয়ালা বাংলো বাড়ি, ছিমছাম পরিবেশ। হঠাৎ যেন সমস্ত চিত্রটাই বদলে গেল যখন দেখলাম ওই বাড়িগুলোর দরজায় আর বাগানে বীভৎস সব কঙ্কাল রাখা, পুতুল দিয়ে সাজিয়ে দেখানো হয়েছে বন্দুক থেকে গুলি ছুঁড়ে একজন অপরকে খুন করছে। কোথাও আবার হাওয়ায় কঙ্কালের মাথাটি দুলছে। আলখাল্লা পরে বাড়ির বাগানে ভূতেরা নাচছে। এ দেশের ভূতেরা আবার ইংরেজিতে কথা বলে, নাকিসুরে কী সব বলছিল, আর আছে বাগানের মাঝখানে রাখা বিশাল বিশাল কুমড়ো।
এই ভৌতিক পরিবেশ আমাকে একটু ভীত ও ভাবিত করে তুলল, রাস্তায় লোকজন নেই বললেই চলে দু’একটি গাড়ি সাঁই সাঁই করে পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে, আমি বাড়ির দিকে দ্রুত পা বাড়ালাম। হঠাৎ চোখে পড়ল একটি বাড়ির দেওয়ালে আলো দিয়ে লেখা ‘হ্যালোইন ফেস্টিভাল’।
প্রতি বছর অক্টোবর মাসের শেষ দিনটি অর্থাৎ ৩১ অক্টোবর সারা পাশ্চাত্য দেশে খ্রিস্টানদের মধ্যে এই হ্যালোইন উৎসব পালিত হয়। এই দিনটিকে বলে ‘অল হ্যালোজ ডে’। প্রায় দু’হাজার বছর আগে বর্তমান আয়ারল্যান্ড, ইংল্যান্ড ও উত্তর ফ্রান্সে বসবাস করত কেল্টিক জাতি। নভেম্বরের প্রথম দিনটি নববর্ষ হিসাবে পালন হতো। এই দিনটিকে তারা গ্রীষ্মের শেষ এবং অন্ধকারের বা শীতের শুরু মনে করত। বড়ই ভয়ের এ সময়। এই রাতে প্রেতাত্মা ও অতৃপ্ত আত্মারা মানুষের মাঝে ফিরে আসে। এদের সঙ্গে যদি মানুষের দেখা হয় তবে সেই মানুষের ক্ষতি হতে পারে। তাই মানুষরা এই রাতে বিভিন্নরকম ভূতের মুখোশ ও কাপড় পরে কাটাত। আর রাতেরবেলা আগুনের পাশে মুখোশ পরে বৃত্তাকারে একসঙ্গে ঘুরতে ঘুরতে মন্ত্র বলত। এই উৎসবের উদ্দেশ্য বিদেহী আত্মাদের স্মরণ করা। মজা করে বলা হয় ভূত উৎসব। এই সময় নাকি ভূতেরা ভূতলোক থেকে মর্তে নেমে আসে। আর ১ নভেম্বর এরা পালন করে অল সেন্ট ডে, যেদিন সবাই শ্রদ্ধা নিবেদন করে সেই মানুষদের প্রতি যারা যিশুর সঙ্গে সঙ্গে শহিদ হয়েছেন।
এই ভূত উৎসবে বা হ্যালোইন ডে-তে কতরকম যে বিচিত্র ঘটনা ঘটে তার ঠিকঠিকানা নেই। শিশুরা ভূতেদের থেকে নিজেদের লুকিয়ে রাখতে বিচিত্র সাজ সাজে। কেউ সাজে বাঘ বা সিংহ কেউ জলদস্যু, স্পাইডারম্যান কেউ আবার পুলিস। ছোট মেয়েরা সাজে রাজকুমারী, প্রজাপতি আরও কত কিছু যাতে ভূতেরা ওদের চিনতে না পারে। এই উৎসব উপলক্ষে শহরে নানা দোকানে শিশুদের জন্য নানারকম পোশাক বিক্রি হয়।
হ্যালোইন উৎসব নানারকম কর্মকাণ্ডের মধ্যে দিয়ে পালিত হয়, তার মধ্যে আছে ট্রিক আর ট্রিট, ভয়ের চলচ্চিত্র দেখা, বনফায়ার, আধিভৌতিক স্থানগুলি ঘুরে ঘুরে দেখা, আজব পোশাকের পার্টি। ওইদিন নাকি উড়ন্ত ঝাড়ুতে করে হ্যালোইন ডাইনিরা উড়ে বেড়ায় সারা আকাশ জুড়ে। হ্যারি পটার চলচ্চিত্রে এই দৃশ্যের কিছুটা নমুনা পাওয়া যায়। হ্যালোইন উৎসবে সাজের আরেকটা মজা হল কুমড়ো, এরা কুমড়োর গায়ে নাক-চোখ আঁকে, কুমড়োগুলি বেশিরভাগ কাচের। আমরা যখন বেড়াচ্ছিলাম এদিক-ওদিক, একটি মিউজিয়াম চোখে পড়ল নাম কর্নিং মিউজিয়াম অফ গ্লাস, এই মিউজিয়াম সংলগ্ন একটি কারখানায় ঢাউস ঢাউস কাচের হ্যালোইন কুমড়ো তৈরি হচ্ছে, এত অত্যাধুনিক কারিগরি যে একটি কুমড়ো তৈরি করতে এক মিনিটও সময় লাগছে না।
আমেরিকায় শিশু কিশোর থেকে শুরু করে যাকেই জিজ্ঞাসা করা যায় তাদের কাছে সবচেয়ে মজার উৎসব কী, সবাই বলবে হ্যালোইন। কমবয়সী ছেলেমেয়েরা টর্চ হাতে বেরিয়ে পড়ে ‘ট্রিক অর ট্রিট’ করার জন্য। আর অনেকেই প্রথা অনুযায়ী মুখে মুখোশ এঁটে গায়ে অদ্ভুত পোশাক পরে বেরিয়ে পড়ে। শিশু-কিশোরদের এই অবাধ বিচরণ, তাদের আনন্দ-উল্লাসে প্রথম শীতের অন্ধকার রাতের বিষণ্ণতা যেন ঢাকা পড়ে যায়। অতলান্তিক থেকে ধেয়ে আসা দমকা হাওয়া মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় হ্যালোইন উৎসবের সঙ্গে।
ছবি : সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে