উচ্চবিদ্যার ক্ষেত্রে বাধার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হতে হবে। উচ্চতর বিদ্যার ক্ষেত্রে শুভ ফল পাবে। কর্মপ্রার্থীদের ... বিশদ
‘ভবিষ্যৎ ভারত-সন্তানদের কাছে তুমি একাধারে জননী, সেবিকা ও বন্ধু হয়ে ওঠো।’ স্বামী বিবেকানন্দ যাঁর সম্বন্ধে এই কথাগুলো বলেছিলেন তিনি হলেন একজন বিদেশিনী— মার্গারেট এলিজাবেথ নোবল যাঁর নাম, যাঁকে আমরা চিনি ‘ভগিনী নিবেদিতা’ বলে। তাঁর জন্ম যদিও হয়েছিল বিদেশের মাটিতে, তবু সেই মহীয়সী নারীর মন, প্রাণ, স্বপ্ন সব কিছুতে ছেয়েছিল শুধুই ভারতবর্ষ! সেই মার্গারেট নোবল কী করে ‘সিস্টার নিবেদিতা’ হয়ে উঠেছিলেন আজ তোমাদের শোনাব সেই কথা।
মার্গারেটের বাবার নাম স্যামুয়েল চিরমন্ড নোবল এবং মায়ের নাম মেরি ইসাবেল। বাবা ছিলেন ধর্মযাজক। দাদামশাই হ্যামিলটন ছিলেন তখনকারের আয়ারল্যান্ডের স্বাধীনতা আন্দোলনের একজন বিশিষ্ট নেতা। মার্গারেটের জন্মের আগেই তাঁর ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন স্বয়ং ঈশ্বরই, হয়তো এটাকেই বলে বিধিলিপি। ১৮৬৭ সালের ২৮ অক্টোবর। উত্তর আয়ারল্যান্ডের টাইরন প্রদেশের ডানগ্যানন নামে একটি ছোট শহর। মেরি ইসাবেল জন্ম দিতে চলেছেন তাঁর প্রথম সন্তানের। কিন্তু বুক তাঁর কাঁপছে ভয়ে! তিনি ঈশ্বরের কাছে মনে মনে শপথ করলেন, যদি তাঁর প্রথম সন্তান সুস্থভাবে পৃথিবীর আলো দেখে, তাহলে তিনি সেই সন্তানকে ঈশ্বরের চরণেই সমর্পণ করবেন। ঠিক এর পর মুহূর্তেই জন্ম নিলেন মার্গারেট নোবল। সুতরাং তাঁর জন্মই হয়েছিল ঈশ্বরের নির্ধারিত কাজ করবার জন্যই।
মাত্র দশ বছর বয়সে তিনি হারালেন তাঁর বাবাকে। অল্প বয়স থেকেই তাঁর ওপর সংসারের অনেক দায়দায়িত্ব এসে পড়ল। মার্গারেটের বয়স তখন সবে তেরো। সংসারের খরচ বাঁচাতে তিন বছরের ছোট ছেলেকে নিজের বাবার বাড়িতে রেখে মানুষ করবার কথা ভাবলেন মেরি ইসাবেল। কিন্তু তাকে সেখানে পৌঁছে দেবে কে? মার্গারেট দায়িত্ব নিয়ে ছোট ভাইকে ভুলিয়ে ভালিয়ে দীর্ঘপথ এমনকী সমুদ্র পেরিয়ে দাদামশায়ের বাড়ি ঠিক পৌঁছে দিয়ে এলেন। এমনি আত্মবিশ্বাসী আর সাহসী ছিলেন তিনি সেই ছোট্টবেলা থেকেই।
লন্ডনের এক বোর্ডিং স্কুলে মার্গারেট পড়াশুনো করে সাফল্যের সঙ্গেই স্কুল জীবন শেষ করলেন। তারপর উইম্বলডনে একটি স্কুল খুলে সেখানে পড়াতে শুরু করলেন। সেই সঙ্গে নানান পত্র-পত্রিকায় প্রবন্ধ লিখেও সুনাম অর্জন করলেন। মার্গারেটের মনে কিন্তু অস্থিরতা— প্রকৃত ধর্মজীবন কী তা জানবার জন্য তিনি যখন ব্যাকুল, চিন্তাগ্রস্ত, ঠিক তখনই ১৮৯৫ সালের নভেম্বর মাসের এক সন্ধেবেলা লন্ডনের এক অভিজাত পরিবারের বাড়িতে তাঁর প্রথম সাক্ষাৎ হল স্বামী বিবেকানন্দের সঙ্গে। স্বামীজির মুখে ভারতীয় ধর্মের কথা শুনে তিনি বিস্মিত ও মুগ্ধ হয়ে গেলেন! স্বামীজিকে নানান প্রশ্ন করে তিনি বুঝতে পারলেন এতদিন যে প্রকৃত ধর্মজীবনের পথ তিনি খুঁজছিলেন, এই ভারতীয় সন্ন্যাসীই সেই পথ তাঁকে দেখাতে পারবেন। মার্গারেট তাঁকে মনে মনে ‘গুরু’ হিসেবে মেনে নিলেন। স্বামীজিও বুঝলেন এই বিদেশিনী মেয়েটিই পারবে ভারতবর্ষের মেয়েদের শিক্ষিত করে তুলতে। তাই তিনি এই কাজের জন্য আহ্বান জানালেন মার্গারেটকে।
মার্গারেট ১৮৯৮ সালের ২৮ জানুয়ারি নিজের স্বদেশ ছেড়ে ভারতবর্ষের মাটিতে পা দিলেন। স্বামীজির পবিত্র সংস্পর্শে এসে মার্গারেটও পেলেন তাঁর ‘মাস্টার’কে!
ভারতবর্ষে আসবার পর সংঘ-জননী শ্রীশ্রীমা সারদার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন স্বামীজি মার্গারেটের। সারদা মা তাঁকে পরম আদরে কাছে টেনে নিলেন। নিজে হাতে করে তাঁকে শ্রীশ্রীঠাকুর রামকৃষ্ণদেবের প্রসাদ খাওয়ালেন এবং নিজেও সেই বিদেশিনীর সঙ্গে একসঙ্গে বসে সেই মহাপ্রসাদ গ্রহণ করলেন। বললেন, ‘আজ থেকে তুমি আমার খুকি।’ মার্গারেট তাঁর ডায়েরিতে এই দিনটি ‘জীবনের সেরা দিন’ বলে লিখে রেখে গেছেন।
স্টার থিয়েটারে সকলের সঙ্গে এরপর একদিন মার্গারেটের পরিচয় করিয়ে দিলেন স্বামীজি। তিনি সবাইকে বললেন, ‘মার্গারেট হলেন ইংল্যান্ডের দেওয়া ভারতবর্ষকে একটি উপহার! ... মার্গারেট তাঁর প্রাণ ভারতবর্ষের সেবায় দিতে এসেছেন।’
২৫ মার্চ স্বামীজি মার্গারেটকে দীক্ষা দিলেন। এবং তাঁর নাম রাখলেন ‘নিবেদিতা’। নিবেদিতা তাঁর ডায়েরিতে লিখলেন, এটি তাঁর জীবনের সবচেয়ে ‘আনন্দময় সকাল।’
এরপরই শুরু হল ভগিনী নিবেদিতার কর্মকাণ্ড। ১৬নং বোসপাড়া লেনে নিবেদিতা খুললেন মেয়েদের জন্য স্কুল। সে স্কুলের প্রতিষ্ঠা করলেন স্বয়ং শ্রীশ্রীমা শ্রীরামকৃষ্ণের পুজো করে। সেই স্কুলে যাতে শহরের গণ্যমান্য ব্যক্তিরা তাঁদের মেয়েদের পাঠান সে জন্য স্বামীজিও অনেক চেষ্টা করতেন। নিবেদিতা নিজে বাড়ি বাড়ি গিয়ে অভিভাবকদের পায়ের কাছে হাঁটু গেড়ে বসে তাঁদের কাছে মেয়েদের পড়াশুনো শেখানোর জন্য ভিক্ষা চাইতেন। এইভাবে তিনি এদেশে মেয়েদের শিক্ষার জন্য অক্লান্তভাবে চেষ্টা করে গেছেন। কারণ, সেই সময় আমাদের দেশে মেয়েদের পড়াশুনো শেখানোর তেমন চল ছিল না। তাদের তিনি পড়াশুনোর সঙ্গে সঙ্গে সেলাই, ছবি আঁকা, হাতের কাজও শেখাতেন। বয়স্কা বিবাহিতা এবং বিধবা মহিলারাও যাতে লেখাপড়া, সেলাই ইত্যাদি শিখতে পারেন সে ব্যবস্থাও তিনি করেছিলেন। শ্রীশ্রীমা সারদাও তাঁর গৃহী ভক্তদের বলতেন তাঁদের মেয়েদের নিবেদিতার স্কুলে পাঠানোর জন্য।
১৮৯৯ সালে কলকাতায় প্লেগরোগ মহামারির আকার ধারণ করল। স্বামীজির নির্দেশে নিবেদিতা রামকৃষ্ণ মিশনের সন্ন্যাসীদের সঙ্গে নিয়ে সেবা কাজে নেমে পড়লেন। সেই সঙ্গে শহরের রাস্তাঘাট, পাড়াকে আবর্জনামুক্ত করতে নিজে হাতে ঝাড়ু-বালতি নিয়ে নেমে পড়তেও এতটুকু কুণ্ঠা বোধ করলেন না তিনি। এক মেমসাহেবকে এমনভাবে কাজ করতে দেখে পাড়ার ছেলেরা লজ্জিত হয়ে তখন নিজেরাই এগিয়ে এসে তাঁর সঙ্গে হাত লাগাল। আজীবন ভগিনী নিবেদিতা ভারতবাসীর সেবা করে গেছেন। ১৯০৬ সালে পূর্ববঙ্গে দুর্ভিক্ষ ও বন্যা কবলিত মানুষের সেবা করতে গিয়ে তিনি ব্রেন-ফিভারে আক্রান্ত হন, তবু জল-কাদা ভেঙে মানুষের বাড়ি বাড়ি ঘুরে সেবা করেছিলেন সেই অসুস্থ শরীরেও!
ভারতবর্ষের শিল্পের উন্নতির জন্যও তিনি অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নন্দলাল বসুর মতো শিল্পীদের অনুপ্রেরণা দিয়েছেন। উদীয়মান বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসুকে সাহায্য করেছেন আর্থিকভাবে যাতে তিনি তাঁর বৈজ্ঞানিক গবেষণাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেন। পাশাপাশি ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের অত্যন্ত ভরসাস্থল ও প্রেরণাদাত্রী ছিলেন তিনি।
নিবেদিতার লেখা বইগুলোর মধ্যে অন্যতম হল— ‘The Master as I saw Him’, ‘The web of Indian Life’, ‘Hints on National Education in India’, ‘Glimpses of Famine and Flood in East Bengal in 1906’, ‘Notes, of some wanderings with Swami Vivekananda’. ইত্যাদি।
তিনি নিজেকে বলতেন— ‘রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের নিবেদিতা’। ‘ভারতবর্ষ’ শব্দটি তিনি জপ করতেন ভাবে বিভোর হয়ে। ভারতবর্ষের সমস্ত কিছুর প্রতি তাঁর ছিল পূজার দৃষ্টি। তাইতো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর সম্বন্ধে বলেছিলেন, ‘তিনি যখন বলিতেন “Our People” তখন তাহার মধ্যে যে একান্ত আত্মীয়তার সুরটি লাগিত আমাদের কাহারো কণ্ঠে তেমনটি ত লাগে না।’
ছবি : সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে