সঠিক বন্ধু নির্বাচন আবশ্যক। কর্মরতদের ক্ষেত্রে শুভ। বদলির কোনও সম্ভাবনা এই মুহূর্তে নেই। শেয়ার বা ... বিশদ
সেই কবে নীল আর্মস্ট্রং প্রথম পা রেখেছিলেন চাঁদের দেশে। পঞ্চাশ বছর পেরিয়ে গেল। চাঁদে বাসস্থান কিংবা কলোনি বানানো তো দূরের কথা, মানুষ নিয়ে কোনও মহাকাশযান আর পৌঁছাতে পারল না চরকা-কাটা চাঁদের বুড়ির রাজ্যে।
চাঁদে যাওয়া নিয়ে কল্পবিজ্ঞানের গল্প কিংবা ম্যুভির কোনও শেষ নেই। জুল ভার্ণ থেকে হার্জ— চাঁদে অভিযান নিয়ে মত্ত সকলেই। হার্জ তো দু-দুটো কমিকসের বই লিখে ফেললেন টিনটিন আর তার সাঙ্গোপাঙ্গদের চাঁদে যাওয়া নিয়ে। ‘ডেস্টিনেশন মুন’ (বাংলায় ‘চন্দ্রলোকে অভিযান’) বর্ণনা করেছে চাঁদে যাবার আয়োজন। সে গল্পের বিস্তৃতি চাঁদের উদ্দেশ্যে রকেটের যাত্রা হওয়া পর্যন্ত। আর তার পরের অংশটা হল ‘এক্সপ্লোরার্স অন দ্য মুন’, যার বাংলা হয়েছে ‘চাঁদে টিনটিন’ নামে।
২২ জুলাই উৎক্ষেপণ হয়েছে ভারতের চন্দ্রযান-২-এর। মানুষ নিয়ে অবশ্য নয়। তবু, দস্তুরমতো তার চাঁদের দেশে পৌঁছানোর কথা সেপ্টেম্বরের ৭ তারিখ। ভারতের সবচেয়ে শক্তিশালী রকেট ‘জিএসএলভি-মার্ক-৩’ চন্দ্রযান-২ কে পৌঁছে দেয় ভূপৃষ্ঠ থেকে ১৭০ কিলোমিটার উপরে, যেখানে চন্দ্রযান-২ পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করতে শুরু করে একটি উপবৃত্তাকার কক্ষপথে। ১৭ দিন ধরে চলবে তার এই পৃথিবী প্রদক্ষিণ। এই আবর্তনপথে প্রতিবার সে একটু একটু করে দূরে সরে যায় এবং ক্রমশ বড় হয়ে যায় তার আবর্তনের কক্ষপথ। যেন একটু একটু করে ধরিত্রী মায়ের আকর্ষণ ছিন্ন করার প্রয়াসে। পঞ্চম কক্ষপথে পৃথিবী থেকে সব চাইতে দূরে থাকাকালীন অবস্থায় পৃথিবী থেকে চন্দ্রযান-২-এর দূরত্ব হবে প্রায় ১ লক্ষ ৪৪ হাজার কিলোমিটার। সেটা ৬ আগস্ট নাগাদ। এমনি করে ১৪ আগস্ট পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে চন্দ্রযান-২ ঢুকে পড়বে লুনার ট্রান্সফার অরবিট-এ। এটাই হল চাঁদে যাওয়ার রাস্তা। চন্দ্রযানের এই ধরনের ঘুরপাক খাওয়ার বর্ণনা রয়েছে ‘চাঁদে টিনটিন’ কমিকসেও।
এটা সহজবোধ্য যে, পৃথিবী আর চাঁদ দুয়েরই রয়েছে টান, যাকে বলে অভিকর্ষ। চাঁদে যেতে হলে চন্দ্রযানকে পৃথিবীর অভিকর্ষ থেকে মুক্তি পেতে হবে। আবার সেই সঙ্গে চাঁদের অভিকর্ষের আওতায় তাকে ঢুকতে হবে ধীরে-সুস্থে, যাতে কোনও ভাবেই সে হুমড়ি খেয়ে না পড়ে চাঁদের গায়ে। যে কোনও দুই বস্তুর অভিকর্ষের টানাপোড়েনের মাঝে কোনও একটা বিন্দু থাকবেই যেখানে তাদের টান সমান। দড়ি টানাটানির খেলায় সেখানে জিতবে না কেউ, আবার কেউ হারবেও না। চাঁদ আর পৃথিবীর মাঝের সেই বিন্দুটিকে বলা হয় ‘ল্যাগরাঞ্জ-ওয়ান পয়েন্ট’ বা সংক্ষেপে ‘এল-ওয়ান পয়েন্ট’। এটা সহজবোধ্য যে, এল-ওয়ান পয়েন্টে চন্দ্রযান-২ পৌঁছানোর সময় চাঁদ আর পৃথিবীর দূরত্ব সব চাইতে বেশি হওয়াটাই এক্ষেত্রে আদর্শ পরিস্থিতি। নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ রেখে পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে চাঁদের আকর্ষণের সাম্রাজ্যে ঢোকার জন্য। সবকিছুকে এই একসাথে মেলানোটা কিন্তু ইসরোর বিজ্ঞানীদের এক বড় চ্যালেঞ্জ।
চাঁদে যাবার রাস্তা ধরে তখন ৫ দিন ছুটবে চন্দ্রযান-২। তারপর সে একেবারেই চাঁদের আওতায়। চাঁদের চারপাশে উপবৃত্তাকার কক্ষপথে সে ঘুরতে থাকবে। সেখানে তার যন্ত্র বিগড়ে গেলে, অনন্তকাল ধরে চাঁদের চারপাশে ঘুরে বেড়ানোই বোধকরি তার ভবিতব্য।
চন্দ্রযান-২ কিন্তু নামতে চাইবে চাঁদের মাটিতে। তাই তার কক্ষপথগুলির পরিধি বদলাতে থাকবে। পৃথিবীর ক্ষেত্রে যা হয়েছিল তার সাথে তফাৎ এটাই যে, এবার কক্ষপথের পরিধি ক্রমশ ছোট হয়ে আসবে। অবশেষে ৭ সেপ্টেম্বর ল্যান্ডার (বিক্রম) আর রোভার (প্রজ্ঞান) নামবে চাঁদের বুড়ির দেশে। পৃথিবীর মানদণ্ডে ১৪ দিন ধরে চালাবে তাদের অভীষ্ট সন্ধান। তার পরীক্ষা-নিরীক্ষার বিষয়বস্তুর মধ্যে রয়েছে চন্দ্রপৃষ্ঠের ভূসম্পত্তি, ভূমিকম্প, খনিজ এবং তার বিস্তৃতির শনাক্তকরণ এবং চাঁদের পৃষ্ঠদেশের রাসায়নিক সংমিশ্রণ পর্যালোচনার চেষ্টা করা। সৌরশক্তি-চালিত ছ’চাকার রোভার প্রজ্ঞান চন্দ্রপৃষ্ঠে ঘুরে বেড়াতে পারবে ৫০০ মিটার পর্যন্ত। তারপর ল্যান্ডারের মাধ্যমে তথ্য পৌঁছবে বিজ্ঞানীদের কাছে। অরবিটারে থাকবে অনেক ক্যামেরা, স্পেক্টোমিটার।
চাঁদের ৪০ ডিগ্রি দক্ষিণের পরের অংশ সম্পর্কে কোনও নির্দিষ্ট প্রামাণ্য তথ্য নেই মানুষের কাছে। সেই অংশটা এখনও একেবারেই অপরিজ্ঞাত। চাঁদের অন্ধকারাচ্ছন্ন দক্ষিণ মেরুর কাছাকাছি অংশে আজ পর্যন্ত অভিযান চালায়নি কোনও দেশ। ভারতের চন্দ্রযান-২ পৌঁছাতে চাইছে চাঁদের দক্ষিণ মেরু অঞ্চলে। ৭০.৯০২৬৭ ডিগ্রি দক্ষিণ ২২.৭৮১১০ ডিগ্রি পূর্ব থেকে ৬৭.৮৭৪০৬ ডিগ্রি দক্ষিণ ১৮.৪৬৯৪৭ ডিগ্রি পশ্চিমের মধ্যে পরীক্ষা-নিরীক্ষায় উঠে আসতে পারে উপগ্রহটি সম্পর্কে অনেক অজানা তথ্য। এবং, কে বলতে পারে, মানবসভ্যতার গতিপথকে হয়তো বেশ খানিকটা প্রভাবিতও করতে পারে তা।
এমনিতে কেন এত গুরুত্বপূর্ণ চাঁদে অভিযান? আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে একটা কারণ অবশ্যই হিলিয়াম-৩। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, যথেষ্ট পরিমাণে হিলিয়াম-৩ রয়েছে চাঁদে, যদিও সঠিক পরিমাণটা জানেন না কেউই। ফিউশনের মাধ্যমে পারমাণবিক শক্তি উৎপাদনের ক্ষেত্রে পারমাণবিক রিঅ্যাক্টর ঠান্ডা করতে এই হিলিয়াম-৩-এর ব্যবহার। চাঁদে সঞ্চিত হিলিয়াম-৩ সম্পর্কিত তথ্যাদি এবং ভবিষ্যতে তার সম্ভাব্য ব্যবহার তাই যুগান্তর আনতে পারে পৃথিবীর বিদ্যুৎশক্তি উৎপাদনের ক্ষেত্রে। চাঁদের সমৃদ্ধ দক্ষিণাঞ্চলে অভিযান করতে কিন্তু উৎসুক অন্য দেশও। আমেরিকা ২০২৪-এ চাঁদে মানুষ পাঠাবার পরিকল্পনাও করেছে।
হাজার কোটি টাকা খরচ করে ভারতের এবারের এই চাঁদে অভিযান। তাই সামান্য এদিক ওদিক হলে যে ভারতের চন্দ্র-অভিযান বা মহাকাশ-অভিযান আবার বেশ কিছুটা পিছিয়ে যাবে, তাইই নয়, সেই সঙ্গে এই হাজার কোটি টাকাও জলে।
আসলে এ ধরনের অভিযানের ক্ষেত্রে একটুখানি ভুলই উল্টেপাল্টে দিতে পারে সব কিছু। সেই কবে একটুখানি দিক ভুল করে কলম্বাস ভারত যেতে গিয়ে পৌঁছালেন উল্টোদিকে আমেরিকা মহাদেশে। আবার ভাবা যাক ১৯৫০ সালের কল্পবিজ্ঞানের ম্যুভি ‘রকেটশিপ এক্স-এম’-এর কথা। শুরুতে সেটা চাঁদে যাওয়ার গল্পই ছিল। একদল মহাকাশচারী চলেছে চন্দ্রাভিযানে। মহাকাশযানে গণ্ডগোল এবং জ্বালানীর হিসেবের ভুলে তারা পথ বদলে গিয়ে পৌঁছায় মঙ্গল গ্রহে। সেখানে তারা মঙ্গলে অতীতের সমৃদ্ধ সভ্যতার চিহ্ন খুঁজে পায়, যা খুব সম্ভবত ধ্বংস হয়ে গিয়েছে পারমাণবিক সংঘাতে, এবং যারা বেঁচে গিয়েছে তারাও পরিণত হয়েছে প্রাচীন গুহাবাসীতে। মঙ্গল গ্রহে পৌঁছানো এবং মঙ্গলের জীবন এবং সভ্যতা সম্পর্কে গল্পের এই কষ্টকল্পনার অংশটুকু বাদ দিলেও এটা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে যে, একটুখানি হিসেবের ভুলে মহাকাশযানের পক্ষে অসীম মহাকাশে দিক ভুল করে অন্য পথে ছুটে যাওয়া, চিরতরে হারিয়ে যাওয়া, প্রবলভাবেই সম্ভব। রুপোলি পর্দার নাটকীয় স্টাইলে মহাকাশযান চাঁদ ছেড়ে মঙ্গলে পৌঁছাবে, সে সম্ভাবনা কিন্তু নেই।
‘চাঁদে টিনটিন’ কমিকসে মহাকাশযানের আরও বিপদের সম্ভাবনা দেখানো হয়েছে। সেখানে মস্ত বড় উল্কাপিণ্ড ছুটে আসছিল মহাকাশযানের দিকে। যে উল্কার সঙ্গে ধাক্কা লাগলে চুরমার হয়ে যেতে পারে চন্দ্রযান। ক্যাপ্টেন হ্যাডক যখন ভাবেন যে, তাঁরাও চুরমার হয়ে যেতে পারতেন মহাকাশযানের সঙ্গে, প্রফেসর ক্যালকুলাস ভাবতে বসেন যে, ধাক্কা লাগলে তাঁর থিওরিটা ভুল প্রমাণিত হতো, আর তাঁকে নতুন করে অঙ্ক করতে হতো। প্রফেসর ক্যালকুলাসদের নিয়ে এই হল বিপদ!
তবে, এমনকী চাঁদের মাটিতে নামাতেও বিপদ রয়েছে। এই তো এ বছরের এপ্রিলে ইজরায়েলের রোবটিক বেরেশিট মহাকাশযান ভেঙে পড়ল চাঁদে নামার ঠিক আগে। মিশন কন্ট্রোলের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল চাঁদের পৃষ্ঠদেশের মাত্র ১৪৯ মিটার দূরে। তাই সত্যি সত্যিই মহাকাশযানের চাঁদে পৌঁছানো এক জটিল প্রক্রিয়া। তার শেষ পর্যন্ত রুদ্ধ নিশ্বাসে অপেক্ষা করা ছাড়া গত্যন্তর নেই। আর ইসরোর সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানীরা তাঁদের দিনরাত এক করে কাজ করে যাবেন শেষ পর্যন্ত। ল্যান্ডার ‘বিক্রম’ কীভাবে চাঁদের মাটিতে নামবে, ভারতের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ইসরো তার পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছে বেঙ্গালুরুর চাল্লাকেরে সায়েন্স সিটির লুনার টেরাইন টেস্ট ফেসিলিটিতে। ভারতের মহাকাশ গবেষণার জনক বিক্রম সারাভাইয়ের নামে এই ল্যান্ডারের নাম দেওয়া হয়েছে ‘বিক্রম’।
আপাতত চন্দ্রযান-২ ঠিকঠাক চলেছে তার যাত্রাপথে। চন্দ্রযান-২ এর সাফল্য ভারতের বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এক বিরাট সমৃদ্ধির স্বাক্ষর হতে পারে। আজ পর্যন্ত হাতে গোনা কয়েকটি দেশ তাদের চন্দ্রযান নামাতে পেরেছে চাঁদের মাটিতে— আমেরিকা, রাশিয়া, চিন। এই তালিকায় ভারতের নাম সংযোজিত হলে জাতীয় গৌরবকে তা বাড়িয়ে দিতে পারে অনেকটাই। আমরা তাই রুদ্ধনিশ্বাসে অপেক্ষা করে থাকি চন্দ্রযান-২ এর সাফল্যের প্রত্যাশায়। চাঁদমামা ‘টি’ দিয়ে যাক আমাদের চন্দ্রযানকে। আমরা চাঁদের হাসির বাঁধ ভাঙার অপেক্ষায়।
ছবি: ইসরো’র সৌজন্যে