পারিবারিক সম্পত্তি সংক্রান্ত আইনি কর্মে ব্যস্ততা। ব্যবসা সম্প্রসারণে অতিরিক্ত অর্থ বিনিয়োগের পরিকল্পনা। ... বিশদ
চিরকালই সুজয়িতা বন্ধুবৎসল। ওর এত ভালো নামটাকে কেটেছেটে কলেজের বন্ধুরা ‘সুজি’ বানিয়ে দিলেও ও রাগ করেনি। বরং নামের অমন অপভ্রংশ শুনে ওর মা যখন বলেছিল, ‘ছিঃ! আমার দাদার দেওয়া অমন সুন্দর নামটাকে ওরা এমন বদখত বানিয়ে দিল! ছোট করে ডাকতে চাইলে জয়ী তো বলা যায়। সুজি বলে ডাকলে তুই সাড়া দিবি না।’
সুজয়িতা বলেছিল, ‘থাক না মা! ওটা ওদের ভালোবেসে দেওয়া নাম, ওরা যা বলে ডেকে খুশি হয়, ডাকুক না।’ সুজয়িতা নামটা কেবল থেকে গেল কলেজের খাতাপত্রে। বন্ধুদের কাছে ও সুজিই।
সেই সুজি এতগুলো বছর পর দেশে পা রাখবে আর বন্ধুদের সেই খবরটা না জানিয়ে পারে! নিজেই কয়েকজনের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল। সুজয়িতাদের বাড়ি বাঁকুড়ায়। স্কুলের পড়াশোনার পাট চুকিয়ে ও কলকাতার কলেজে ভর্তি হয়েছিল। কলেজ, ইউনিভার্সিটির পাঁচটা বছর কলকাতাতে হস্টেলে-মেসে কাটিয়ে, বিয়ের পর ফ্রান্সে থিতু হয়েছিল। তারপর চোদ্দোটা বছর কেটে গিয়েছে। রাইন নদী দিয়ে বয়ে গেছে অনেক জল, জল গড়িয়েছে গঙ্গা ভাগীরথী দিয়েও। সুজয়িতার জীবনও চলেছে অনেক উত্থান-পতনের মধ্যে দিয়ে। অবশেষে সব কিছু ঝেড়ে ফেলে একেবারে চলে
আসছে ও।
প্যারিস থেকে দিল্লি হয়ে কলকাতায় নামতে নামতে বিকেল হয়ে যাবে, তাই সুজয়িতা ঠিক করেছে আজকের দিনটা কলকাতাতে থেকে যাবে। বন্ধুরা যারা কলকাতায় আছে তাদের সঙ্গে দেখা করে, আড্ডা মেরে পরদিন বাঁকুড়ায় ফিরবে। তাতে ফুসফুসে অনেকটা অক্সিজেন ঢুকবে। টিকিট কাটা হয়ে যাবার পরই দিনক্ষণ জানিয়ে দিয়েছিল বন্ধুদের। এমনকী, আজ দিল্লিতে নামার পর হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপটাতে মেসেজও করেছিল। অথচ এয়ারপোর্টের বাইরে পা রেখে দেখতে পেল একমাত্র জিষ্ণুকে।
‘শুধু তুই? আর কেউই আসতে পারল না?’ সুজয়িতার গলায় স্পষ্ট হতাশা।
‘জুঁই আর কুণালের সঙ্গে ফোনে কথা হয়েছিল খানিক আগে। ওরা বলেছে আসবে। তবে একটু দেরি হবে। আর বাকিদের কথা জানি না।’
সুজয়িতার উৎসাহে তখন ভাটার টান। সেইসঙ্গে খানিকটা অভিমানের মেঘও ঘনালো বুকের ভেতরে। ওর মুখে অন্ধকার জমাট বাঁধতে দেখে জিষ্ণু বলল, ‘ঘাবড়াচ্ছিস কেন? ম্যায় হুঁ না! আমরা কোথাও বসি চল। ওখানকার লোকেশনটা শেয়ার করে দেব গ্রুপে। যারা আসতে চাইবে চলে আসতে পারবে।’
কথাটা মনে ধরল সুজয়িতার। জিষ্ণু গাড়ি এনেছিল। ওর গাড়িতে নিজের ঢাউস দুটো ট্রলি তুলে জিষ্ণুর পাশের সিটে গা ছেড়ে দিল সুজয়িতা। চোদ্দো বছরে অনেক বদলে গেছে কলকাতা। ফ্লাইওভার উড়াল দিয়েছে যত্রতত্র, মেট্রোরেল ডাবল প্রোমোশন পেয়েছে।
জিষ্ণু ফার্স্ট ইয়ারে পড়াকালীন সুজয়িতার ভালো বন্ধু ছিল। সেকেন্ড ইয়ারে উঠে ওর মধ্যে প্রেমিক প্রেমিক ভাব দেখা দিল। সুজয়িতা বুঝত সবই, কিন্তু পাত্তা দেয়নি। বরং কিছুদিন জিষ্ণুকে এড়িয়ে চলেছিল। ফলে জিষ্ণুও নিজের আবেগ সংবরণ করে নিয়েছিল। আর দেবদাস সিনড্রোমে আক্রান্ত হয়নি। পরবর্তীকালে এই সামান্য চিত্তদৌর্বল্যের কথা জিষ্ণু মনে রাখেনি, ভুলে গিয়েছে সুজয়িতাও।
‘হ্যাঁ রে, তুই এত বছর বাদে ফিরছিস তাও আবার একলা, ব্যাপার কী?’
অনেক বছর পর যোগাযোগ হলেও বন্ধুরা বন্ধুই থেকে যায়। আর তাদের সহজাত অধিকার থাকে খোলা মনে যেকোনও কথা জিজ্ঞাসা করার। প্রশ্নটা একেবারে ব্যক্তিগত হলেও জিষ্ণু সরাসরি জিজ্ঞাসা করতে কুণ্ঠা বোধ করল না, আর সুজয়িতাও শুনে রাগ করল না।
‘দোকলা যিনি ছিলেন তার সঙ্গে পোষায়নি রে! ওই চ্যাপ্টারটা অনেকদিন ক্লোজড।’
‘ওহ! আই অ্যাম সরি। মানে জানতাম
না তো।’
‘ধুসস! আমার নিজেরই কোনও দুঃখ নেই এ নিয়ে, তুই খামোকা দুঃখ পেতে যাস কোন দুঃখে! এই বেশ ভালো আছি, একেবারে বিন্দাস!’
‘বেশ, তাহলে আমিও দুঃখটা ফিরিয়ে নিলাম। তা তোর বিবাহের বাই প্রডাক্ট কোথায়?’
‘বাই প্রোডাক্ট!’ ভুরু কুঁচকে গেল সুজয়িতার। পরক্ষণে মানেটা বুঝতে পেরে সশব্দে হেসে ফেলল।
‘তোর মাথায় আসেও বটে! বাই প্রোডাক্ট নেই! সেটাও একটা বড় বাঁচোয়া। নইলে আষ্টেপিষ্টে বাধা পড়ে যেতাম , দড়ি কেটে উড়ে যেতে পারতাম না।’
কথা বলতে বলতে ওরা বেশ খানিকটা চলে এসেছিল। একটা ভালো রেস্তরাঁর সামনে গাড়ি থামাল জিষ্ণু।
ওরা ভেতরে ঢুকে বসতে না বসতেই আকাশ কালো হয়ে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যে নামল তুমুল বৃষ্টি। সুজয়িতা বলল, ‘আহা! এমন না হলে চলে? কবি কি আর এমনি এমনি লিখেছেন— সে আমাদের বাংলাদেশ আমাদেরই বাংলা
রে! আহা!’
‘এটা বর্ষার কবিতা ছিল নাকি!’ জিষ্ণু ভুরু কুঁচকাল।
‘সে না হোক! যা মুখে এল, বললাম মনের আনন্দে। তুই থাম দেখি, মাস্টারমশাইয়ের মতো ভুল ধরতে আসিস না!’
ঘণ্টা দেড়েক পেরিয়ে যাবার পরও বৃষ্টি কমল না দেখে সুজয়িতার মুখে চিন্তার ছাপ। খানিক আগে কুণাল আর জুঁই আলাদা আলাদাভাবে ফোন করে জানিয়েছে, ইচ্ছে থাকলেও এত বৃষ্টিতে বাড়ি থেকে বেরতে পারছে না। সুজয়িতা দেখল, কুণাল আর জুঁই ভুল কিছু বলেনি। দেড় ঘণ্টার বৃষ্টিতে এখানেও হাঁটুজল দাঁড়িয়ে গিয়েছে। কলকাতার এই সমস্যা আর মিটল না। একটু বেশি বৃষ্টি হলেই কলকাতা ভেনিস হয়ে যায়।
বৃষ্টি তখনও ধরেনি। ইতিমধ্যে বাইরে অন্ধকারও নেমে গিয়েছে। রাস্তার আলোগুলো জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। কৃত্রিম আলোর প্রসাধনী মেখে জলের ফোঁটাগুলো বকুলফুলের মতো
ঝরে পড়ছিল।
তিন নম্বর কফির কাপে একটা চুমুক দিয়ে উদ্বিগ্ন গলায় সুজয়িতা বলল, ‘আমি তো খুব বিপদে পড়ে গেলাম রে।’
‘কীসের বিপদ?’
‘আমি তো ভেবেছিলাম রাতটা কোনও হোটেলে কাটাব। কাল বাঁকুড়ার ট্রেন ধরব। কিন্তু এখন যা পরিস্থিতি হল, এই জল ভেঙে কোথায় হোটেল খুঁজতে যাব?’
‘আমি আছি তো! অত ভয় পাচ্ছিস কেন?’ জিষ্ণু আশ্বাস দিল।
‘সে তো জানি যে তুই আছিস, হোটেলে পৌঁছে দিবি। কিন্তু তুই-ই বা এই জলের মধ্যে হোটেল খুঁজতে যাবি কী করে? ইঞ্জিনে জল ঢুকে গেলেই তো গেল! গাড়ি তখন নৌকা হয়ে যাবে।’
‘সামনেই আমার ফ্ল্যাট, তেঘরিয়ায়। আজ রাতটা ওখানেই থেকে যা। রেশমি আছে, লোপা আছে, তোর কোনও অসুবিধা হবে না।’
‘তোর বউ-মেয়ে? তারা তো চেনে না আমাকে!’
‘চেনে না, চিনে যাবে। তুই এমন কিছু সুখাদ্য নোস যে, ওরা তোকে খেয়ে নেবে! চল, তোকে বাড়িতে এন্ট্রি করিয়ে দিয়ে আমাকে অফিসে ঢুকতে হবে। একটা প্রজেক্ট চলছে, খুব ইম্পর্ট্যান্ট, আমাকে সারারাত ওখানেই থাকতে হবে।’
সুজয়িতার ক্লান্ত লাগছিল খুব, ঘুমও পাচ্ছিল। তাই আর কথা বাড়াল না। একটা রাতের তো ব্যাপার, গিয়ে দু’একটা সৌজন্যমূলক কথা বলে বিছানায় চলে যাবে। যা খাওয়া হয়েছে এতক্ষণ ধরে, তাতে আর রাতে কিছু খাওয়ার দরকার নেই, তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়া যাবে।
জিষ্ণুদের বাড়ির গলিতেও হাঁটু পর্যন্ত জল জমে গিয়েছে। জলে পা দিয়ে ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে সুজয়িতা বলল, ‘মনে হচ্ছে কলকাতার শেপটা কড়াইয়ের মতো হয়ে গেছে।’
দুটো ভারী ট্রলি ব্যাগ জল থেকে বাঁচাতে উঁচু করে ধরে আগে আগে যাচ্ছিল জিষ্ণু, পেছনে না তাকিয়েই বলল, ‘পুকুর-টুকুর যেখানে যা ছিল সব বুজিয়ে ফ্ল্যাট উঠে যাচ্ছে, জলগুলো কোথায় যাবে বল!’
লিফ্ট তিনতলায় দাঁড়াল। একটা বন্ধ ফ্ল্যাটের সামনে গিয়ে পকেট হাতড়ে জিষ্ণুকে চাবি বের করতে দেখে সুজয়িতা বলল, ‘তুই যে বললি, বাড়িতে তোর মেয়ে-বউ আছে?’
‘রেশমিরা কাছেই এক আত্মীয়ের বাড়িতে গেছিল দুপুরে। মেসেজ করল বৃষ্টিতে আটকে পড়েছে। এসে যাবে’খন। তুই নিশ্চিন্তে থাক। আমিও সব বলে দিয়েছি ওদের।’
সুজয়িতার থাকার ব্যবস্থা করে জিষ্ণু বেরিয়ে গেল। ওকে এখন এই জল ঠেলে সল্টলেকে যেতে হবে। বেরনোর সময় বলে গেল, ‘তুই রেস্ট নে। রেশমিরা যখন আসে আসবে, ওদের কাছে ডুপ্লিকেট চাবি আছে, ঢুকে পড়বে। ফ্রিজে খাবার আছে, যা খাবি গরম করে খেয়ে নিস।’
‘আবার কী খাব! মাথা খারাপ তোর! আমি বরং একটু ফ্রেশ হয়ে শুয়ে পড়ি, তোর বউকে বলে দিস, ফিরে এসে আমাকে যেন ডাকে।’
ক্লান্ত শরীর বিছানায় ঠেকাতে না ঠেকাতেই ঘুমিয়ে পড়ল সুজয়িতা।
অনেক রাতে ঘুমটা ভেঙে গেল। দেখল, পুরো বাড়ি অন্ধকারে ডুবে আছে। সময় দেখার জন্য মোবাইলটা অন করে জিষ্ণুর মেসেজ দেখতে পেল— ‘রেশমি জানিয়েছে এত জলের মধ্যে গাড়ি পাচ্ছে না, তাই আজ ফিরতে পারছে না। তুই শান্তিতে ঘুমো।’ আবারও গভীর ঘুমে
তলিয়ে গেল।
পরদিন আটটায় ঘুম ভাঙল সুজয়িতার, প্রায় বারো ঘণ্টা ঘুমিয়ে শরীরটা ফ্রেশ লাগছে।
অন্যের রান্নাঘরে নিজের জন্য চা বানাতে বানাতে সুজয়িতা ভাবছিল, বাড়িতে গেস্ট আছে, জিষ্ণুর বউয়ের তো উচিত ছিল সকালে তাড়াতাড়ি চলে আসা কিংবা একবার ফোন করে কথা বলা। তাহলে কি ওর বাড়িতে হুট করে চলে আসাটা রেশমি পছন্দ করেনি? নিশ্চয়ই তাই। রেশমির ব্যবহার তো সেটাই বলছে।
এটা মনে হতেই মুখটা তেতো হয়ে গেল সুজয়িতার।
খানিকবাদে জিষ্ণুর ফোন এল, ‘কী রে উঠেছিস? ঘুম হয়েছে তো ঠিকঠাক?’
‘দারুণ ঘুমিয়েছি। তুই কখন আসবি? আমি বেরব তো, বাড়ি ফিরব।’
‘এই তো ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই আসছি।’
‘একটা সত্যি কথা বলবি? তোর বউয়ের মনে হয় আমার এখানে আসাটা পছন্দ হয়নি,
তাই না?’
‘আরে না না! ওসব কিছু নয়। আমি আসছি, ওদের সঙ্গে নিয়েই আসছি।’
ফ্ল্যাটটা ঘুরে দেখছিল সুজয়িতা আর ভাবছিল জিষ্ণুর বউটা বেশ গোছানো স্বভাবের। বাড়িতে কোথাও এলোমেলো করে রাখা জামাকাপড় নেই। ফলে ফ্ল্যাটটা বেশ পরিষ্কার, ছিমছাম। সারা বাড়িতে একটাও ছবি নেই, অন্তত ওর মেয়ের এটাই যা একটু আশ্চর্যের!
ন’টার মধ্যে চলে এল জিষ্ণু, সুজয়িতা ততক্ষণে তৈরি হয়ে গিয়েছে। ও একবার ভেবেছিল ব্রেকফাস্ট কিছু বানিয়ে রাখবে। কিন্তু অচেনা কারও রান্নাঘর ব্যবহার করার আগে তার অনুমতি নেওয়া উচিত। বিশেষত এক্ষেত্রে জিষ্ণুর বউয়ের যখন অতিথিকে পছন্দ নয় বলেই মনে হচ্ছে, তাই আর ওই পথে হাঁটেনি। আসলে সুজয়িতা এখন এখান থেকে পালাতে পারলে বাঁচে।
টেবিলের ওপর ঠোঙাটা রেখে জিষ্ণু বলল, ‘নে গরম গরম হিংয়ের কচুরি, আর সঙ্গে আলুর চচ্চড়ি। দারুণ বানায় এরা, শিগগিরি খেয়ে নে, ঠান্ডা করিস না।’
হিংয়ের কচুরি সুজয়িতার ভীষণ প্রিয়। খুশি মনে খেতে খেতে বলল, ‘আহা! কতদিন পর খেলাম রে তোর কল্যাণে!’
‘জানি। সেই জন্যই তো নিয়ে এলাম।’
‘কী জানিস?’
‘হিংয়ের কচুরি তোর প্রিয় আর এতবছর সেটা খেতে পাসনি।’
‘তোর মনে আছে?’ খাওয়া থামিয়ে অবাক হয়ে তাকাল সুজয়িতা।
‘থাকবে না? এই তো সেদিনের কথা। রাস্তায় হিংয়ের কচুরি ভাজতে দেখলেই তোর কচুরি নিয়ে আদেখলাপনার কথা মনে পড়ে যায়।’
সুজয়িতা ঠোঁট ওল্টাল।
জিষ্ণু বলেছিল, আসার সময় বউ আর মেয়েকে নিয়ে আসবে, অথচ ফিরেছে একলাই। সুজয়িতা বুঝল, রেশমি আসতে চায়নি, নিশ্চয়ই ওর এখানে থাকা নিয়ে ওদের স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ঝামেলা হয়েছে। তাই এ নিয়ে আর কোনও কথা জিজ্ঞাসা করে বন্ধুকে বিড়ম্বনায় ফেলতে চাইল না ও। ব্রেকফাস্ট করেই বেরিয়ে পড়ল। জিষ্ণু স্টেশন পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে আসতে চেয়েছিল, সুজয়িতাই রাজি হল না, ‘তুই সারারাত ঘুমাসনি, এখন টেনে ঘুম লাগা। আমি ঠিক চলে যাব।’ তবে মনে মনে ভাবল, আজ আর ঘুম হয়েছে তোর! আমি বেরিয়ে গেছি খবর পেলেই বউ ঢুকবে আর তেড়ে ঝগড়া লাগাবে।
কী যেন একটা অসঙ্গতি মনের মধ্যে খচখচ করছিল। ব্যাপারটা পরিষ্কার করে নেওয়ার জন্য ট্যাক্সিতে যেতে যেতে জুঁইকে ফোনে ধরল।
‘হ্যাঁ রে, জিষ্ণুর কি বউয়ের সঙ্গে গণ্ডগোল? ওর বউ মেয়েকে নিয়ে আলাদা থাকে?’ সুজয়িতার মন বলছে, আসলে এটাই ঘটনা, লজ্জায় জিষ্ণু কিছু বলেনি।
‘কার বউ-মেয়ে?’ গাড়ির হর্ন ভেদ করে জুঁইয়ের চিৎকার কানে এল সুজয়িতার।
‘জিষ্ণুর জিষ্ণুর।’
‘জিষ্ণুর আবার বউ-মেয়ে কোথায় পেলি? ও তো বিয়ে করেনি বলেই এতকাল জানতাম।’
সুজয়িতা প্রচণ্ড অবাক হয়ে গেল। তারপর রাগ এসে সেই জায়গাটার দখল নিল। শুধু শুধু এমন মিথ্যে বলার কারণটা কী! ট্যাক্সিকে মুখ ঘোরাতে বলল।
দরজা খুলে সুজয়িতাকে দেখে অবাক হয়ে গেল জিষ্ণু।
‘তুই? কিছু ফেলে গেছিস?’
জিষ্ণুর প্রশ্নের জবাব না দিয়ে ঝাঁঝিয়ে উঠল সুজয়িতা।
‘জুঁই বলল তুই বিয়েই করিসনি। অথচ কাল থেকে আমাকে রেশমি-লোপা, বউ-মেয়ে কত গল্প শোনালি। এত মিথ্যে বলার কারণটা কী?’
‘বাড়িতে বউ-মেয়ে আছে এটা না বললে তুই কি আমার এখানে থাকতে রাজি হতিস? ওরকম দুর্যোগের মধ্যে তোকে কোথায় ছেড়ে দিতাম আমি? তাই গল্পটা বানালাম। একটা ভালো কাজের জন্য এটুকু মিথ্যে বললে ঠাকুর পাপ দেয় না।’
সুজয়িতার রাগ পড়ে গেল জিষ্ণুর জবাব শুনে। এ কী ছেলেমানুষি কাণ্ড! ওকে দরজা থেকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে ভেতরে ঢুকে বসল ও। জিষ্ণুকে হুকুম করল, ‘দরজাটা বন্ধ করে এখানে এসে বস।’
জিষ্ণু লাজুক মুখে আজ্ঞা পালন করল।
‘বিয়ে করিসনি কেন?’
‘মেয়ে পেলাম কই? যাকে করব ভেবেছিলাম, সে তো অন্যের হাত ধরে বিদেশে পাড়ি দিল।’
সুজয়িতা হাসবে না কাঁদবে ভেবে পাচ্ছিল না। একটু পরে ধাতস্থ হয়ে বলল, ‘বাঁকুড়ার ট্রেনটা তো মিস হয়ে গেল তোর মিথ্যে কথার চক্করে। ভাবছি, আজকের দিনটা এখানেই থেকে যাই, কী বলিস?’
‘শুধু আজ কেন ম্যাডাম! যদি চান, জীবনের বাদবাকি দিনগুলো এখানেই থেকে যেতে পারেন।’