পারিবারিক সম্পত্তি সংক্রান্ত আইনি কর্মে ব্যস্ততা। ব্যবসা সম্প্রসারণে অতিরিক্ত অর্থ বিনিয়োগের পরিকল্পনা। ... বিশদ
এই সুযোগটাই তো নেয় মেয়েটা। বিষ্ণুপ্রিয়া। নামের সঙ্গে যার স্বভাবের মিল নেই। নিরু নিজে পছন্দ করেছিল মেয়ে। ছোট ঠাকুরঝির ননদের মেয়ে। বাবার আর্থিক অবস্থা তেমন বলার মতো নয়, আরও দুটো ছোট বোন আছে। একমাত্র ছেলের জন্য সুকৃতির এমন সাধারণ মেয়ে পছন্দ ছিল না। সরকারি চাকরি না হলেও নিরঞ্জনের বড় কোম্পানিতে চাকরি, চাকরিসূত্রে দেশে বিদেশে ঘোরা, পরপর প্রোমোশন। ভালো ভালো সম্বন্ধ আসছিল। রূপ, রুপো দুইয়ের জৌলুসের সম্বন্ধ। অথচ এই মেয়েকে পছন্দ হল নিরুর।
স্বামী বেঁচে থাকলে কিছুতেই এ বিয়ে হতে দিত না সুকৃতি। কিন্তু বৈধব্যের মানে শুধু স্বামী হারানোই নয়, আরও অনেক কিছু। স্বামীর সঙ্গে সঙ্গে সংসারে জোরের জায়গাটাও হারিয়ে যায়। উনত্রিশ বছর আগের কথা, এখনও মনে পড়ে, মনে হয়েছিল নিজের পরিচয়টাই হারিয়ে ফেলেছে। নিজেকে অসহায়, অরক্ষিত মনে হতো। স্বামীকে শেষ সিদ্ধান্ত নিতে দেওয়ার স্বভাব ছিল সুকৃতির। সেই সিদ্ধান্তগুলো নেওয়ার ব্যাপারে হঠাৎ একা পড়ে যাওয়াটা যে কী অনির্বচনীয় নিরালম্ব অবস্থা, কাউকে বোঝানো যাবে না। রাতের পর রাত ঘুম হতো না। ক্লান্ত শ্রান্ত। কী করব না করব, তা বুঝে উঠতেও কষ্ট। দিনের পর দিন নিরুর দিকেও খেয়াল রাখা হয়নি। নিরু তখন সাত বছরের। দুঃখ কাটিয়ে ওঠার সেই দীর্ঘ সময়টা ভুলিয়ে দিয়েছিল নিরুই। বাবাকে ছাড়া, কোনও অভিভাবকের পরামর্শ ও পথনির্দেশ ছাড়া, একা একা জীবনের সিদ্ধান্ত নিয়ে নিজেকে এবং মাকে সামলে রাখা নিরু। বিয়ে নিয়ে, নিজের জীবনসঙ্গিনী নিয়ে নিরুর সিদ্ধান্ত মেনে নিতে হয়েছিল তাই।
ছোট ঠাকুরঝি অবশ্য বারবার বলেছিল, ‘নামেও লক্ষ্মী, স্বভাবেও লক্ষ্মী। ছোট থেকে দেখছি তো, খুব ভালো মেয়ে।’
মামাশ্বশুর বলেছিলেন, ‘নিরঞ্জন আর বিষ্ণুপ্রিয়া। লক্ষ্মী-নারায়ণ। নারায়ণের নাম নিরঞ্জন, জানো তো? আর বিষ্ণুপ্রিয়া মা লক্ষ্মীর আরেক নাম।’
পাড়ার গিন্নিরা বলাবলি করছিল, ‘সুকৃতির কপাল দেখ, সাক্ষাত্ লক্ষ্মীঠাকরুন বউ হয়ে এলেন।’
তা, বিয়েবাড়িতে অমন আদেখলাপনা, প্রশংসার কথাবার্তা অনেক হয়। তবে এ বাড়ি ও বাড়ির মেয়েগুলো দশবার ‘নতুন বউদি’ করে এসে পড়ছিল। কলেজে পড়া ছেলেগুলো পর্যন্ত বশ। এমনি এমনিই বাড়ির সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে লোক, নতুন বউ জানলায় দাঁড়ালে তো কথাই নেই। নিরুর বন্ধুরা আড্ডা দিতে জাঁকিয়ে বসছিল। বছরের পর বছর তাদের এ বাড়িতে দেখা পাওয়া যায়নি। নিরুর বিয়ে হয়ে হঠাত্ সবার প্রিয় হয়ে উঠেছিল এ বাড়ি।
নতুন বউমার ঘোমটা তুলে মুখখানা দেখে মন ভরে উঠেছিল সুকৃতিরও। ফর্সা লাল লাল একখানা ঝলমলে মুখ। লাল বেনারসী, কপালে সিঁথিমৌর, হাতে গাছকৌটো। এত সুন্দর হয় কোনও মানুষ? আত্মীয়মহলেই বল, পাড়া-পড়শিদের ঘরেই বল, এ তল্লাটে এমন সুন্দর বউ কারও নেই। দরজার ওপর আমপাতা, ফুলের মালা। দরজার বাইরে পূর্ণকলস, দেয়ালে স্বস্তিকচিহ্ন। বড় ঠাকুরঝির হাতে শাঁখ, ছোটপিসিমার হাতে বরণের থালা। চোখে ঘোর লেগেছিল। সাক্ষাত্ মা লক্ষ্মী।
সেদিনের প্রতিটা মুহূর্ত মনে পড়ে আজকাল।
...
বিয়ের পর দেড়বছর। ভালোবাসা, যত্ন, সম্মান দিয়ে নতুন বউকে ঘিরে রেখেছিল নিরু। বিষ্ণুপ্রিয়া হেঁটে গেলেও পদ্মফুল ফুটে ওঠে এমন ভাব। নিরুর বন্ধুরা, অফিসের কলিগরা, তাদের বউরা— বেশ একটা দল। আড্ডা, হাসি, গান। সবটাই বড্ড ভালো। বড্ড আলো।
কে জানত এত তাড়াতাড়িই সব আলো মুছে যাবে। নিরঞ্জনের প্রাপ্য টাকা আর বিষ্ণুপ্রিয়ার জন্য একটা চাকরির তদ্বির অফিস থেকেই করছে। অফিসিয়াল কাজে গিয়েই দুর্ঘটনা। তাই সব দায়িত্ব অফিসের।
সুকৃতি অবশ্য দায়ী করে বউকেই। ও মেয়ের কপালের দোষেই নিরু অকালে চলে গিয়েছে। কথাতেই আছে, ‘অতি বড় সুন্দরী না পায় ঘর’। অফিসের চাকরির কথা ভেবেই ওর এ বাড়িতে থাকা মেনে নিয়েছে। যদিও রোজই মনে মনে বলে, ‘ও বাপের বাড়ি ফিরে যাক।’
নিজের অজান্তেই চোখের জল নেমে এসেছে গাল বেয়ে, আঁচল তুলে মুছে নিল সুকৃতি। হাসিমুখের নিরুকে মনে পড়ে গেল। নিরু নেই, বাড়িটা খাঁ খাঁ করে। হঠাত্ যে কী হয়ে গেল! বিশ্বনাথ চলে যাবার দিনটা যেমন। একেবারে হঠাত্। দুপুরে খেয়েদেয়ে ব্যাঙ্কে টাকা তুলতে গিয়েছিল মানুষটা। বাড়ি ফেরার পথে মাথা ঘুরে রাস্তায় পড়ে গিয়েছিল। ব্যস, চিকিত্সা করার সময়টুকুও দিল না।
নিরুর জন্যে অবশ্য বউ করেছিল। মাথায় চোট, ডান পা বাদ দিতে হয়েছে, বুকের পাঁজরে অপারেশন। রাত দিন জেগে শুশ্রূষা করেছে বউ। যত্নে, মায়ায়। নিরু যেদিন সব মায়া কাটিয়ে চলে গেল, বউ অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল। তারপর এই সাত মাসে আরও দু’বার অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল। পরের কয়েক সপ্তাহ কেমন ভয় পেয়ে থাকত। অনবরত শরীরে যন্ত্রণা হতো ওর।
ডাক্তার শরীরে কোনও রোগ খুঁজে পাননি। বলেছিলেন, ‘মনের মধ্যে দুঃখ চেপে রেখে এমন। ওকে কাঁদানোর চেষ্টা করুন।’ খবর পেয়ে ওর বাবা-মা এসেছিলেন, নিয়ে যেতে চাইলেও বউ যায়নি। সুকৃতি দেখেছে, শোবার ঘরে নিরুর জামাকাপড় দিয়ে মাথা ঢেকে শুয়ে আছে।
নিজের কষ্ট, নিরুকে হারিয়ে ফেলার যন্ত্রণায় বউয়ের দিকে তাকাবার অবকাশ হয়নি সুকৃতির। এত বড় বাড়ি, দুটো ঘরে মাত্র দু’জন মানুষ। যে যার দুঃখ নিয়ে একাকিনী।
তবে আজকাল কিছুদিন ধরে বউ একটু ছটফট করছে। একদিন কবিতা পড়ছিল, সুকৃতি স্পষ্ট শুনেছে।
‘একটি নক্ষত্র আসে; তারপর একা পায়ে চ’লে
ঝাউয়ের কিনার ঘেঁষে হেমন্তের তারাভরা রাতে
সে আসবে মনে হয়; আমার দুয়ার অন্ধকারে
কখন খুলেছে তার সপ্রতিভ হাতে!...’
সুকৃতিকে ঘরের বাইরে দেখে চুপ করে গেল। মনের এই অবস্থায় এমন সব ভাবের কবিতা পড়ার মন হয়? জীবনানন্দের কবিতার বই। নিরুর বই। নিরুর বইটা নেবার আগে একবার সুকৃতির অনুমতি পর্যন্ত নেবে না?
পাড়ার অল্পবয়সি মেয়েগুলো আসছে মাঝে মাঝে। তাতে সুকৃতির খারাপ লাগার কিছু নেই। কিন্তু সেদিন দত্তদের নতুন বউ এসে বাহারি খোঁপা বেঁধে গেল বউমার কাছে। রবীন্দ্রজয়ন্তীর গান প্র্যাকটিস করে গেল ছেলেমেয়েরা। ভাগ্যিস বউ জলসায় গাইতে যায়নি। কিন্তু পড়শিরা কি দেখছে না যে, বউয়ের মনে দোলা লেগেছে? স্বামীর মৃত্যুর একবছরও তো হয়নি।
আর এই ব্যাপারটা। কেউ আসে। রোজ রাতে দরজা খোলা, দরজা বন্ধ হওয়ার আওয়াজ পায় সুকৃতি। ‘নিরু রে’... বুকের মধ্যে থেকে কান্নাটা বেরিয়েই এল। দ্বিচারিণী বউ ফাঁকি দিচ্ছে নিরুকে। সেই নিরু, যে চোখে হারাত তার বিষ্ণুপ্রিয়াকে।
বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ল সুকৃতি। আজ হাতেনাতে ধরতেই হবে। বাইরে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে, বাদলা হাওয়ায় গাছের ডালগুলো শব্দ করে দুলছে। তার মধ্যেই শব্দ হল একটা। বারান্দায় গ্রিলের শব্দ না? কে যেন কথা বলল। দূরে রাস্তাটা নিঝুম, স্ট্রিট-লাইটের আলো পড়ে আছে জায়গায় জায়গায়। নকশা-কাটা জলের পুকুরের মতো দেখাচ্ছে। রাতজাগা একটা পাখি ডেকে উঠল।
একটু চমকেই উঠেছে সুকৃতি। এই জল-ঝরঝর রাতে পাখিটা জেগে আছে?
নিরুর ঘরের দরজায় শব্দ হল আবার। অনেকদিন তেল দেওয়া হয় না, কব্জাগুলোয় আওয়াজ হয় আজকাল। সুকৃতির মাথায় আগুন জ্বলে উঠল। এত তাড়াতাড়ি নিরুকে ভুলে গেল মেয়েটা? অবশ্য পরের বাড়ির মেয়ের কাছে বেশি চাহিদা থাকাই উচিত নয়। এ বাড়িকে নিজের বাড়ি করে নেবার আগেই তো নিরু চলে গেল। তবু এখানেই আছে যখন, বাড়ির সম্ভ্রমের কথা ভাববে না?
আস্তে আস্তে নিরুর ঘরের দিকে এগিয়ে গেল সুকৃতি। দরজাটা অল্প অল্প দুলছে। কেউ কী ভেতরে আছে? ‘বউমা’, চাপা গলায় ডাক দিল।
হালকা একটা আওয়াজ এল। ঘরের ভেতর কেউ আছে। চাপা গলায় কিছু বলল কেউ?
‘বউমা, দরজা খোল, ’ জোরে ডেকে উঠল সুকৃতি। তারপরই থমকে গেল। চারদিক নির্জন। বৃষ্টির শব্দ ছাড়া কোনও শব্দ নেই। জোর গলার আওয়াজে যদি কেউ জেগে ওঠে? পাশের বাড়ির মুখুজ্জেগিন্নি ঘুম না হওয়ার অসুখে ভুগছে। সামনের বাড়ির সাহাদের ছেলেটা ভোর ভোর উঠে মাঠে প্র্যাকটিস করতে যায়। চ্যাটার্জিদের মেয়েটা রাত জেগে ডাক্তারির পড়া করে।
‘বউমা!’
‘কে?’ চাপা গলা, ধরা ধরা। যেন ঠান্ডা লেগেছে। ঘরের মধ্যে থেকে এল আওয়াজটা? নাকি গ্রিলের দিক থেকে? আর ধৈর্য রাখা গেল না। হাত বাড়িয়ে দরজাটা খুলে দিতে গেল সুকৃতি।
‘মা! কী হয়েছে? শরীর খারাপ?’ পেছন থেকে গলার আওয়াজ।
বিষ্ণুপ্রিয়া। হাতে একটা লম্বা সাদা মোমবাতি।
‘তুমি এদিকে কোথায় গেছিলে?’ বউ এখানে, তাহলে ঘরের মধ্যে কে?
‘কারেন্ট চলে গেছে মা। রান্নাঘরে গেছিলাম। মোমবাতি...’
‘তোমার ঘরে কে এসেছে?’ সুকৃতি তীব্র গলায় বলে উঠল।
‘ঘরে? কে এসেছে মা? কী করে ঢুকল?’ ভয়ে দু’চোখ বড় হয়ে উঠল বিষ্ণুপ্রিয়ার।
আর তখনই চোখে পড়ল সুকৃতির, মেয়েটার চোখে জল, গালেও জলের ধারা লেগে রয়েছে। কাঁদছিল ও? তাই বুঝি গলাটা ধরা ধরা?
মনটা নরম হয়ে আসছিল, পলকে কঠিন হল সুকৃতি, ‘কে এসেছে ঘরে, তুমিই তো বলবে। গ্রিল খুলেছিলে কেন? রোজ দরজা খোল, বন্ধ কর। কেন? কে আসে?’
‘গ্রিল? গ্রিল খোলা?’
ঠিক তখনই ঝোড়ো হাওয়ার একটা জোরালো ধাক্কা দিল দু’জনকেই, আর গ্রিলটা আওয়াজ করে কেঁপে উঠল। সামনে বিষ্ণুপ্রিয়ার ঘরের দরজাও সেই ধাক্কায় হাট হয়ে খুলে গেল, আবার বন্ধ হয়ে এল। দু’বারই দরজায় লোহার কব্জাগুলো আওয়াজ করে উঠল। হাওয়ার ধাক্কায় শব্দ করে কেঁপে উঠল দেয়ালের ছবি, আলমারির কাঠের পাল্লা।
‘আমার খুব ভয় করে মা।’ কান্নাভেজা গলায় বলে উঠেছে বিষ্ণুপ্রিয়া, ‘দরজা বন্ধ করলেই ভয় করে। তাই দরজাটা খোলা রাখি। রাত হলেই বড্ড ভয় করে। বড়...’ কথা শেষ না করেই চোখ নামিয়ে নিল।
‘একা লাগে। বড় একা লাগে’...না বলা কথাটা সুকৃতির বুকের মধ্যে বেজে উঠল।
তাই তো। হঠাত্ বৈধব্য। কী করতে হবে, বুঝতে না পেরে মনের দুঃখ মনে চেপে রেখে কষ্ট সহ্য করছে মেয়েটা। ও যাতে নিজের বৈধব্যের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারে, তার জন্য কী সাহায্য করেছে নিরুর মা? আহা, বড্ড ভালোবাসা ছিল দু’টিতে।
হাত বাড়িয়ে মোমবাতিটা হাতে নিল সুকৃতি, মোমের আলোয় মেয়ের মুখখানা আলো আলো। তেল তেল, ঠিক লক্ষ্মীঠাকুরের মতো। ধরা গলায় বলল, ‘আয় মা। আজ থেকে রাতে তুই আমার কাছে থাকবি।’