পারিবারিক সম্পত্তি সংক্রান্ত আইনি কর্মে ব্যস্ততা। ব্যবসা সম্প্রসারণে অতিরিক্ত অর্থ বিনিয়োগের পরিকল্পনা। ... বিশদ
১৪৫০ সাল নাগাদ নির্মিত হয়েছিল এই টাওয়ার। যদিও উপরের তলার আর অন্যান্য কিছু অংশের কাজ শুরু হয় ১৬০৫ নাগাদ। রাজা দ্বিতীয় চার্লসের রাজত্বকালে এই প্রাসাদ-দুর্গ ছিল অ্যাপলগার্ণের ব্যারোনেট স্যর আলেকজান্ডার জার্ডিনের অধিকারে। জমিদারদের সঙ্গে প্রজাদের দ্বন্দ্ব চিরকালের। ব্যতিক্রম ছিল না জার্ডিনের ক্ষেত্রেও। মিলহাউসব্রিজ গ্রামের জেমস ‘ডান্টি’ পোর্টিয়াস ছিল স্পেডলিনস টাওয়ারের ব্রেড অর্থাৎ পাউরুটি সরবরাহকারী। এলাকায় জেমস এমনিতেই খিটখিটে হিসেবে পরিচিত ছিল। তাই লোকজন তাঁকে ডান্টি বলে ডাকত। প্রাচীন ইংরেজিতে ‘ডান্টি’ শব্দের অর্থ ছিল ‘আর্গুমেন্ট’ অর্থাৎ তর্ক। যাইহোক একবার কোনও কারণে ডান্টি পোর্টিয়াস আর আলেকজান্ডার জার্ডিনের মধ্যে ঝামেলার সূত্রপাত হয়। শোনা যায়, পোর্টিয়াস নিজেরই ময়দা কলে আগুন লাগিয়ে দেন। এতে ক্ষুব্ধ হন জার্ডিন। খবর পাওয়ামাত্রই পোর্টিয়াসকে পেয়াদা পাঠিয়ে বন্দি করার আদেশ দিলেন তিনি। দুর্ঘটনা সম্পর্কে বিশেষ খোঁজখবর না নিয়েই পোর্টিয়াসকে দুর্গের মাটির নীচের অন্ধকার কারাগারে আটকে রাখা হয়। মূলত সেটি ছিল মদের পিপে রাখার ভাঁড়ার। সেখানেই তালাবদ্ধ অবস্থায় রাখা হয় পোর্টিয়াসকে। আর তার চাবি আলেকজান্ডার জার্ডিন নিজের জিম্মায় রাখেন। শুধুমাত্র দু’বেলা তাঁকে জল আর খাবার দিয়ে আসা হয় সময়ে সময়ে। অন্যদিকে পোর্টিয়াসকে কী সাজা দেওয়া যায় তা নিয়ে ভাবনায় জার্ডিন। নিজের হলেও ময়দা কলে আগুন লাগানো শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কিন্তু আইনকে নিজের হাতে তুলে নিয়ে জার্ডিন ঠিক করলেন পোর্টিয়াসকে আরও দিনকয়েক আটকে রেখে শায়েস্তা করবেন। আর তারপর যখন সে প্রাণভিক্ষা চাইবে তখন তাঁকে বেশ কয়েক ঘা চাবুক মেরে মুক্তি দেবেন।
কিন্তু বাস্তবে ঘটল অন্যরকম। হঠাৎই জমিদারি সংক্রান্ত জরুরি দরকারে জার্ডিনকে যেতে হল স্কটল্যান্ডে। এদিকে পোর্টিয়াস আটকে রইল ওই অন্ধকারে। কিছুদিন পর যখন জার্ডিন এডিনবরায়, তখন তাঁর মনে পড়ল পোর্টিয়াসের কথা। আর আতঙ্কিত হয়ে উঠলেন জার্ডিন। কারণ প্রাসাদ থেকে বেরোনোর সময় সব ক’টা ঘরের এমনকী মাটির নীচের ওই ভাঁড়ারের চাবিও ভুল করে তিনি নিজের সঙ্গে এনেছেন। চাবির অন্য জোড়াও প্রাসাদে নেই। অর্থাৎ অনাহারে তেষ্টায় ওখানে কষ্ট পাচ্ছে বেচারা পোর্টিয়াস। তাঁর অবিবেচনার ফল ভোগ করতে হচ্ছে অন্যজনকে। এই খবর যদি রাজার কানে যায় তার ফলাফল কী হবে ভেবেই শিউরে উঠলেন জার্ডিন। মানসম্মান, জমিদারির সঙ্গে নিজের প্রাণটাও না যায়।
নিজের কাজ শেষ হতে তখনও বাকি। তাই অবিলম্বে জার্ডিন নিজের বিশ্বস্ত এক লোকের হাতে ওই ঘরের চাবি ফেরত পাঠালেন ক্যাসেলে। কিন্তু সেই চাবি আসার আগেই খাদ্য আর জলের অভাবে মাটির নীচেই প্রাণ দিয়ে ভুলের মাশুল দিয়েছেন পোর্টিয়াস। জার্ডিনের বিশ্বস্ত লোক পোর্টিয়াস মারা গেছে দেখে নিজের কর্তব্য স্থির করে ফেলল। পাইক বরকন্দাজদের সঙ্গে মিলে রাতারাতি পোর্টিয়াসদের মৃতদেহ স্থানীয় গির্জার সমাধিক্ষেত্রে কবর দিল। সেই সঙ্গে অর্থের বিনিময়ে গির্জার পাদ্রিদের হাত করে নিল সে। ক’দিন পর জার্ডিন প্রাসাদে ফিরে পোর্টিয়াসের মৃত্যু সংবাদ শুনে গুম হয়ে রইলেন। আবার যখন জানতে পারলেন যে, দুর্ঘটনার আসল কারণ বিশেষ কেউ জানে না তখন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। যারা জানত সত্যটা তাঁদেরও টাকার বিনিময়ে নিজের দিকে টেনে নিলেন।
ব্যাপারটা পুরোপুরি মিটতে না মিটতেই দেখা দিল অন্য সমস্যা। অশরীরী পোর্টিয়াস আস্তানা গাড়ল মাটির নীচের সেই ভাঁড়ারে। সেখানে ঘুলঘুলি থেকে নাকি তাঁর আর্তনাদ কানে আসে সারাক্ষণ। সেই আর্তনাদ খিদে তেষ্টার। নতুন এই আতঙ্কে ত্রস্ত হয়ে রইল প্রাসাদের সবাই। ঘুম উড়ে গেলে জার্ডিনের।
এদিকে ভূত দেখার জন্য, বলা ভালো শোনার জন্য প্রাসাদের আশপাশে ভিড় জমায় অল্পবয়সিরা। ভাঁড়ারের পিছনের পোড়ো জমি থেকে ভূতের আর্তনাদ তাঁদের নতুন নিষ্ঠুর বিনোদন। অনেকে আবার ভূতের প্রতি দয়াপরবশ হয়ে বাসি পাউরুটি ঘুলঘুলি দিয়ে দেয় ভূতের উদ্দেশে। ভিতর থেকে আসে শুকনো পাউরুটি চিবোনোর আওয়াজ। এভাবেই চলতে থাকে।
একটা সময় ভূতের আর্তনাদে অতিষ্ঠ হয়ে ওঠেন জার্ডিন। তারপর বুঝতে পারেন, ভূতকে সন্তুষ্ট না করলে মুক্তি নেই। তাই তিনি প্রাসাদের সবাইকে আদেশ দেন, শুকনো পাউরুটি এনে ওই গুদাম বোঝাই করতে। ঘুলঘুলি দিয়ে দেওয়া টুকরো পাউরুটি পোর্টিয়াসের ভূত খেল বটে, কিন্তু তাতে সে শান্ত হল না। খিদের সঙ্গে তাঁর চিৎকার আগের চেয়ে কয়েকগুণ বেড়ে গেল। আরও মাসখানেক চলল এইভাবে। এমনকী প্রজারা এসে তাঁর কাছে ধর্না দিল বিহিত চেয়ে। সবাই অতিষ্ঠ ভূতের চিৎকারে। ভূতকে তুষ্ট না করতে পেরে জার্ডিন এবার শরণাপন্ন হলেন গির্জার পাদ্রির। গির্জার বড় পাদ্রি সব শুনে হেসে বললেন, ‘এ আর এমন কী কাজ আপনি বিদেশে থাকতে ওই বাসি মৃতদেহের সৎকারের মন্ত্রও আমিই পড়েছি। মন্ত্র পড়ে আমি ওকে লোহিত সাগরের ওপারে পাঠাব।’ জার্ডিন পাদ্রিকে বললেন, বরং কম খরচে কোনও উপায় বাতলাতে। ভূত প্রাসাদের ভাঁড়ার ছেড়ে বেরলেই হবে। সেই শুনে পাদ্রি একটা ছোট চৌকো বাক্স বের করলেন তাঁর আলখাল্লার ভেতর থেকে। সেটা জার্ডিনের হাতে দিয়ে বললেন, ‘এর ভিতর একখানা ছোট বাইবেল আছে, যা ১৬৩৪ সালে ছাপানো হয়েছিল। এই খুদে বাইবেলের এক বিশেষ ক্ষমতা আছে। এই বই যেখানে থাকে তার হাজার গজের ভেতর কোনও ভূতপ্রেত ঘেঁষতে পারবে না।’ বড় পাদ্রির দেওয়া সেই বাইবেলখানা শোওয়ার ঘরে রাখলেন জার্ডিন। আর সেদিন থেকেই বন্ধ হল পোর্টিয়াসের ভূতের উপদ্রব। অবশেষে স্বস্তি পেলেন জার্ডিন।
যদিও পরকালে গিয়েও আগের মতো নাছোড়বান্দা ছিল পোর্টিয়াস। একবার পাদ্রির দেওয়া সেই ছোট্ট বাইবেল খানা ছিঁড়ে যাওয়ায় সেটা বাঁধাই করতে দেওয়া হয় এডিনবরার এক দপ্তরীর কাছে। বাইবেলের অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে পোর্টিয়াসের ভূত আবার ফিরে আসে প্রাসাদে। রাতের অন্ধকারে সস্ত্রীক ঘুমন্ত জার্ডিনকে খাটসুদ্ধু উল্টে দেয় সে। বিপদ বুঝে তড়িঘড়ি জার্ডিন সেই রক্ষাকবচ বাইবেলখানা ফেরত নিয়ে আসেন। আবার পোর্টিয়াসও পগারপার। জার্ডিন বেঁচে থাকতে আর প্রাসাদ মুখো হয়নি সে। জার্ডিন মারা যাওয়ার বহু বছর পর ১৮৮৪ সালে তাঁর বংশধররা স্পেডলিনস টাওয়ার বিক্রি করে দেয়। তারপর হাতবদল হলেও সেই রক্ষাকবচ খুদে বাইবেলখানি আজও সযত্নে রয়েছে সেখানে।
তারপর কেটে গেছে কয়েকযুগ, সময়ের সঙ্গে পাল্টেছে অনেককিছুই। সেদিনের ওই দুর্গ-প্রাসাদ আজ পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণের জায়গা। সুদীর্ঘ মাঠ, বাগান, হ্রদ নিয়ে এই চত্বর দেখার মতো। আর আন্নান নদী তো আছেই। প্রাসাদের ওক কাঠের মূল প্রবেশদ্বার পেরলেই মনে হবে মধ্যযুগীয় স্বপ্নরাজ্য। যাকে ঘিরে রয়েছে ইতিহাস আর কয়েক শতাব্দী ব্যাপী কাহিনি। তবে ৮০ ফুট এই চারতলা প্রাসাদের মধ্যে রয়েছে অতিথি সেবার সম্পূর্ণ বন্দোবস্ত। ইতিহাসকে অনুভব করা আর সুন্দর সময় কাটানোর আদর্শ ঠিকানা এই হলিডে হোম। আছে ছোট্ট অনুষ্ঠানের বন্দোবস্ত, নানা আমোদপ্রমোদ, আছে অনেক কিছুই। আর আছে সবচেয়ে পুরনো বাসিন্দা ‘ডান্টি’ পোর্টিয়াস। যদিও সে একদম নিরুপদ্রব আর শান্তভাবে জীবনযাপন করে নিজের ঘরেই। সুতরাং এমন জীবন্ত ইতিহাস অনুভব করতে হলে যেতেই হবে স্পেডলিনস দুর্গে।