পারিবারিক সম্পত্তি সংক্রান্ত আইনি কর্মে ব্যস্ততা। ব্যবসা সম্প্রসারণে অতিরিক্ত অর্থ বিনিয়োগের পরিকল্পনা। ... বিশদ
এমন সময় হাওয়ার গতিতে যেন ঘড়ঘড় শব্দে চারটি ঘোড়ায় টানা জুড়ি গাড়িটি এসে থামে বাড়ির সামনে। আগন্তুকের আগমনে যেন নিশ্চল বাড়িটা আবার প্রাণ ফিরে পায়। আগন্তুক শশব্যস্ত হয়ে ঘর জুড়ে খুঁজতে থাকে কিছু। কেউ বলে কালো রঙের ডেস্কে থাকা কিছু নথিপত্র, কেউ বলে কিছু ছবি। যার জন্য তাঁকে দুই জগতের সীমানা পেরিয়ে আসতে হয় বারবার। অনুসন্ধান শেষে হতাশ আগন্তুক আবার মিলিয়ে যান রাতের অন্ধকারেই। তিনি আবার আসবেন, যেমনটা আসছেন ১৮১৮ থেকে। বাড়ির ঠিকানা হেস্টিংস হাউস, আলিপুর। আগন্তুকের নাম ওয়ারেন হেস্টিংস। বাংলার প্রথম ব্রিটিশ গভর্নর জেনারেল। ঔপনিবেশিক কলকাতার বহু সাক্ষী আজও শহরজুড়ে স্বমহিমায় বর্তমান। ইতিহাসের পাশাপাশি যাদের সঙ্গে জুড়ে রয়েছে অতিপ্রাকৃতিক তকমাও। মহানগরের বুকে ‘হেস্টিংস হাউস’ যাদের মধ্যে অন্যতম। আলিপুর জাজেস রোডের কাছে এই অট্টালিকা বর্তমানে মেয়েদের মহাবিদ্যালয় ‘ইনস্টিটিউট অব এডুকেশন ফর ওম্যান’। কিন্তু অতিলৌকিক ঘটনা নাকি প্রায়শই ঘটে থাকে এখানে। ওয়ারেন হেস্টিংসের আমল আজ অতীত। কিন্তু তিনি নেই হয়েও রয়ে গিয়েছেন এই বাড়ির ইতিহাসে কিংবদন্তিতে।
ওয়ারেন হেস্টিংস ১৭৭৪ সালে বাংলার গভর্নর জেনরল হন। দীর্ঘকাল প্রশাসক পদে ছিলেন তিনি। খোদ হেস্টিংসও নাকি কলকাতা শহরে ভূত দেখেছিলেন। সেই ঘটনার বিবরণ মহাফেজখানায় লিপিবদ্ধ করে রাখার নির্দেশ দিয়েছিলেন তিনি। যেই সূত্র ধরেই এই কাহিনিকে ১৮৯৩ সালে নিজের বইয়ে ঠাঁই দেন জেমস ডগলাস। কলকাতায় পরিষদ কক্ষের মধ্যেই নাকি ঢুকে পড়েছিলেন অশরীরী আর সেই কক্ষে তখন উপস্থিত ছিলেন হেস্টিংস এবং তাঁর পারিষদবর্গ। আগন্তুকের মাথায় ছিল ‘স্টোভ-পাইপ হ্যাট’। অথচ ভারতে তখনও সেই টুপির আমদানি হয়নি। ক্ষণিকের মধ্যেই হাওয়ায় মিলিয়ে যান অশরীরী। সেই অশরীরীকে সেদিন নিজের বাবা বলে শনাক্ত করেছিলেন হেস্টিংসের কাউন্সিলের সদস্য মিস্টার শেক্সপিয়র। আর যে জাহাজের ডাকে তাঁর বাবার মৃত্যুসংবাদ কলকাতায় আসে, সেই একই জাহাজে করেই নাকি এসেছিল ওই বিশেষ টুপিও।
হেস্টিংস সাহেবের আত্মা নিয়ে আজও নানা কথা শোনা যায় এই বাড়ির চত্বরে। কিন্তু কীসের টানে এই নেটিভ শহরে বারবার ফিরে আসেন হেস্টিংস সাহেব? দীর্ঘকাল প্রশাসক থাকার পর নিজের পদে ইস্তাফা দিয়ে তিনি ১৭৮৫ সালে ব্রিটেনে ফিরে যান।
দেশে ফেরার পর ঘুষ নেওয়া, ব্ল্যাকমেল করা সহ বিভিন্ন অভিযোগে অভিযুক্ত হন। সাত বছর আইনি লড়াইয়ের পর তিনি মুক্ত হন। কলকাতার ‘হেস্টিংস হাউস’ নামে পরিচিত এই বাড়ি থেকেই দেশে ফেরেন তিনি।
কিন্তু দেশে ফিরে হেস্টিংস আইনি জটিলতায় জড়িয়ে পড়েন। ১৭৮৭ সালে দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত করে তাঁর ইমপিচ করা হয়। তাঁর বিরুদ্ধে অন্যতম অভিযোগ ছিল ১৭৭৫ সালে মহারাজা নন্দকুমারকে ষড়যন্ত্র করে বিচারবিভাগীয় হত্যা, ঘুষ নেওয়া। হেস্টিংসের বিরুদ্ধে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ করেছিলেন মহারাজা নন্দকুমার। পরে নন্দকুমারের বিরুদ্ধেও পাল্টা জালিয়াতির অভিযোগ আনেন হেস্টিংস। বিচারে মহারাজকে মৃত্যুদণ্ড দেন তৎকালীন সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি এলিজা ইম্পে। যিনি ছিলেন হেস্টিংসের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। এই ষড়যন্ত্র ইতিহাসের কুখ্যাত অধ্যায়। যদিও সাত বছর দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের পর হেস্টিংস বেকসুর খালাস হন।
১৭৮৫ সালে হেস্টিংস যখন দেশে ফিরে যান, তখন ভুলবশত একটি কালোবাক্স ফেলে যান কলকাতায়। যার মধ্যে ছিল বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র ও দলিল দস্তাবেজ। সঙ্গে স্ত্রীকে লেখা কিছু চিঠিপত্র। যার হদিশ জানতেন একমাত্র তিনি। সেই নথিপত্র গুলি হাতে পেলে নাকি বিচারের সময় তাঁর নিজেকে নির্দোষ প্রমাণে সুবিধা হতো। তিনি তড়িঘড়ি তাঁর প্রাক্তন সচিবকে চিঠিও পাঠান কিন্তু তাঁর ফেলে যাওয়া কিছু জিনিসের সঙ্গে ওই কালো বাক্সটিও নিলাম হয়ে যায়। বাক্সের খোঁজে ক্যালকাটা গেজেটে বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হলেও সেটিকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। আবার কেউ কেউ বলেন, ওই কালো বাক্সে ছিল হেস্টিংসের ঘনিষ্ঠ জনৈক রমণীর খান দুই মিনিয়েচার ছবি। সুদীর্ঘ সময় পেরিয়ে আজও নাকি ওই বাক্সের খোঁজেই বারবার ফিরে আসেন বড়লাট ওয়ারেন হেস্টিংস, নিজের সেই আলিপুর হেস্টিংস হাউসে। যে বাক্সে রয়ে গিয়েছে তাঁর নির্দোষ হওয়ার কিছু নথিপত্র!
অনেকের দাবি, আজও নাকি রাতে শোনা যায় জুড়ি গাড়ির আওয়াজ। এই অট্টালিকার অতিলৌকিক কাণ্ডকারখানার গল্প চলে আসছে বহুদিন থেকেই। ১৮৮৪ সালে পল বার্ড নামে এক ব্যক্তিও নাকি হেস্টিংসর ঘোড়ার গাড়ি দেখেছিলেন। আর শুধুমাত্র ওয়ারেন হেস্টিংস নয় এই বাড়ির সঙ্গে জুড়ে একাধিক রহস্যময় উপস্থিতি। যার মধ্যে রয়েছেন এক ব্রিটিশ ছায়ামানবী। যিনি হেস্টিংস হাউসের চত্বরে ঘুরে বেড়ান, হাতে প্রদীপ নিয়ে যান চত্বরের সমাধিক্ষেত্রে। তিনি মেরিয়ান। জার্মান ব্যারনেস। ১৭৮৫ সালে ইংল্যান্ডে ফেরার আগে হেস্টিংস এই বাড়ির মালিকানা হস্তান্তর করেন তাঁর স্ত্রী মেরিয়ান ইমহফের সন্তান জুলিয়াসের কাছে। জুলিয়াস এবং তাঁর পরবর্তী কয়েক প্রজন্ম এই বাড়িতেই বাস করেছে। তাঁদের সমাধি রয়েছে এই বাড়ির চত্বরেই। আর প্রদীপ হাতে নাকি ছায়ামানবী স্বয়ং মেরিয়াম। যিনি এই বাড়ির টান আজও কাটাতে পারেননি।
এই তালিকায় আছেন ঘোড়দৌড়ের এক জকিও। শোনা যায়, ১৮৩২ সাল নাগাদ এই বাড়ির বাসিন্দা ছিলেন জনৈক জকি। দুর্ভাগ্যজনকভাবে একদিন কেউ তাঁর প্রিয় সাদা ঘোড়াকে গুলি করে হত্যা করে। ফলে ওই ব্যক্তি ঘোড়ার শোকে পাগল হয়ে যান। আজও নাকি সেই ঘোড়া মালিকের জন্য ছুটে আসেন বারেবারে, যাঁকে মাঝেমধ্যেই আলোআঁধারিতে দৌড়াতে দেখা যায় এই বাড়ির চত্বরে।
না বললেই নয় দুর্ভাগ্যজনক সেই বাচ্চাটির কথা যে বন্ধুদের সঙ্গে ফুটবল খেলতে গিয়ে বুকে বল লেগে ঘটনাস্থলে মারা যায়। সে নাকি আজও তাঁর বন্ধুদের অপেক্ষায় রয়েছে এখানে। এরকমই অজস্র ঘটনা ভেসে বেড়ায় হেস্টিংস ভবনের হাওয়ায়। দিনের বেলায় যেখানে ছাত্রীদের গুঞ্জনে প্রাণবন্ত। কিন্তু রাত নামলেই অন্য দুনিয়া। রয়েছে বিশ্বাসী-অবশ্বাসী দুই পক্ষই। রয়েছে যুক্তি পালটা যুক্তি। সত্যিই কি শেষ বয়সে না পাওয়া শান্তির খোঁজে আসেন হেস্টিংস? সত্যিই কি এখানে রয়েছে মায়ার বাঁধনে বাঁধা অশরীরীরা। যেই প্রশ্নের উত্তর জানেন স্বয়ং ঈশ্বর। তবে চক্ষুকর্ণের বিবাদভঞ্জনের জন্য আপনি আসতেই পারেন, অশরীরী না হোক ইতিহাসের সাক্ষী অবশ্যই হতে পারবেন, যা নিঃসন্দেহে মূল্যবান।