পারিবারিক সম্পত্তি সংক্রান্ত আইনি কর্মে ব্যস্ততা। ব্যবসা সম্প্রসারণে অতিরিক্ত অর্থ বিনিয়োগের পরিকল্পনা। ... বিশদ
কিন্তু ভাবলেই তো হবে না। শের খানের যোদ্ধা হিসেবে পরিকল্পনা নিখুঁত। সৈন্য মোতায়েন অঙ্ক কষা। সময়জ্ঞান তুলনাহীন। এবং সেনাবাহিনীর শৃঙ্খলা অদ্বিতীয়। আর তাই হুমায়ুনের সেনাবাহিনী অগ্রসর হতে হতে দেখতে পাচ্ছে, তাদের তুলনায় অনেক সুবিধাজনক স্থানে রয়েছে শের খান। কারণ এই হুমায়ুন বাহিনী যেখানে, সেটি নিচু জমি। এখন জুন মাস। বর্ষা নেমেই গিয়েছে। চলছেও। আর সবথেকে খারাপ লক্ষণ হল, এবার বর্ষা এসেছে অনেক আগেই। ফাঁদে পড়েছেন হুমায়ুন। কারণ তিন মাস ধরে এভাবে বসে থাকার কারণই ছিল না। শের খান সন্ধির প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন। সেই আলোচনার আসল কারণ হল, বর্ষা আসার অপেক্ষা। সেটা যখন হুমায়ুন বুঝলেন, তখন অনেক দেরি হয়ে গেল।
সুতরাং যখন শের খানের আফগান বাহিনী আক্রমণ করল, তখন কয়েকদিনের মধ্যেই হুমায়ুন আঁচ করলেন যে, সম্ভবত তাঁর বাহিনী সাফল্য পাবে না। ইতিমধ্যেই কর্মনাশার জল ঢুকে স্রোতের মতো ভাসাচ্ছে দিগ্বিদিক। সমস্যা হল হুমায়ুনের কাছে নেই কোনও স্থায়ী ঠিকানা। অন্তত সুরক্ষিত। তাই তাঁর সঙ্গে সঙ্গেই সর্বত্র চলেছে হারেম। অর্থাৎ বেগমের দল। এরকমই হয়। তাঁকে তো সবাই ধ্বংসই করতে চায়। কাকে বিশ্বাস করবেন? অতএব যুদ্ধের ময়দানে একপ্রান্তে সর্বদাই থাকে হারেমের নারীরা। তাঁদের দাসদাসীর দল।
সর্বাগ্রে বড় বেগমের কথা মনে পড়ল হুমায়ুনের। সবথেকে বিশ্বস্ত চার সেনাপতিকে ডাকলেন। তারদি বেগ, বাবা বেগ, কোচ বেগ ও মীর বাচকা বাহাদুর। তাঁদের বললেন, বেগমের তাঁবুতে যাও। তাঁকে রক্ষা করতে হবে। সবাইকে নিয়ে যত দূর সম্ভব হয়, পালাও। বেঁচে থাকলে আবার দেখা হবে আমাদের।
সেই চারজন দ্রুত উপস্থিত হলেন বেগ বেগমের কাছে। পারস্যের সুন্দরী এই বেগম নিছক আফগান, তুরস্ক, মুঘলদের বেগমের মতো সুলতান, বাদশাতে নিবেদিতপ্রাণ অনুগত নয়। তিনি রীতিমতো স্বাধীনচেতা। মুঘল বা আফগান দুনিয়ার প্রথম বেগম যিনি হজে গিয়েছিলেন একাই। তাই তাঁর আর এক নাম হাজি বেগম। নানাবিধ বেগম থাকলেও হুমায়ুন যখন অনেক দিন পর পর তাঁর কাছে আসতেন না, তখন তীব্র স্বরে হুমায়ুনকে বিদ্ধ করতেন এই বেগম। বলতেন, আপনার অনেক কাজ জানি। যুদ্ধ করছেন। পরিকল্পনা করছেন। শলাপরামর্শ করছেন। সবই ঠিক। তাই বলে আমরাও যে আছি, সেটা ভুলে যাবেন না।
একজন নারী, মুঘল বাদশাকে এই সুরে কড়া কথা বলছেন এটা একপ্রকার অবিশ্বাস্য হলেও, হুমায়ুনের বোন গুলবদন বেগম তাঁর অসামান্য রচনায় বেগ বেগমের এই দৃপ্ত চরিত্রের কথা অনেকবার বলেছেন।
আফগানরা আক্রমণ করে হাজির হল বেগ বেগমের তাঁবুতেও। একে একে তাঁর সুরক্ষায় আসা সকলেই অসীম সাহসিকতায় যুদ্ধ করল। কিন্তু একমাত্র তারদি বেগ ছাড়া কেউই আফগান যোদ্ধাদের সামনে দাঁড়াতে পারেনি। প্রাণ হারাল।
মাথায় বাজ পড়ল হুমায়ুন বাহিনীর। কারণ হারেমের নারীদের বন্দি করে নিয়েছে শের খানের বাহিনী। চরম অসম্মান। কিন্তু শের খান কড়া নির্দেশ দিলেন। বললেন, একজনও জেনানার কোনওরকম অসম্মান যেন না হয়। শুধু তাই নয়, বিহারের এক হিন্দু জমিদারের কাছে সেই বন্দি জেনানাদের পাঠিয়ে বলা হল, এঁরা আমাদের সম্মানীয়া অতিথি। আপনার কোনও এক প্রাসাদে রাখুন। আমরা এই নারীদের মুঘলদের কাছে ফেরত পাঠিয়ে দেব।
এহেন যুদ্ধক্ষেত্রে সবথেকে ধীর স্থির আর সহিষ্ণুতার পরিচয় দিলেন বেগম। এবং সম্পূর্ণ পাল্টে গেলেন তিনি। কেন? কারণ তাঁর মাত্র ৬ বছরের কন্যা আকিকা নৌকা থেকে পড়ে গিয়ে প্রবল জলস্রোতে হারিয়ে গেল কর্মনাশায়। পরবর্তীকালে নিজেকে ক্ষমা করতে পারেননি হুমায়ুন। লিখেছেন, জীবনের সবথেকে বড়
পাপ হল, কেন আমি আকিকাকে যুদ্ধক্ষেত্রে নিয়ে এলাম। আমি কেমন পুরুষ? যে পরিবারকে সুরক্ষিত করতে পারে না!
১৫৫৬ সালে কাবুলে ছিলেন হুমায়ুনের বেগমেরা। সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ দুই নারী বেগ বেগম ও হামিদা বানু। তাঁদের কাছে খবর এল হুমায়ুনের মৃত্যু হয়েছে। গ্রন্থাগারের সিঁড়ি থেকে দ্রুত নামতে গিয়ে তিনি পড়ে যান। এবং মৃত্যু হয়। দুই বেগম চলে এলেন আগ্রায়। ১৪ বছরের পুত্র আকবর সম্রাট হবেন! তাঁর মা হামিদা যতটা খুশি, তার থেকে কোনও অংশেই কম উচ্ছ্বসিত নয় বেগ বেগম। আকবরের সৎমা। আকবর অবশ্য নিজে আবুল ফজলকে বলেছিলেন আমি তো ছোটবেলায় একটা সময় ভাবতাম, উনিই আমার আসল মা! কারণ, আকবরকে কোলেপিঠে মানুষ করেছেন বেগ বেগম।
আকবরের আজও মনে আছে যে, দাঁতে ব্যথা হওয়ায় একবার বেগ বেগম হাকিমের থেকে ওষুধ নিয়ে আসেন। কিন্তু হামিদা বেগম ভাবলেন এটা চক্রান্ত। নিশ্চয়ই বিষ। কিছুতেই খেতে দেওয়া হবে না আকবরকে। বড় বেগম নির্ঘাত হামিদার পুত্রকে হত্যা করতে চায়। একথা শুনে বেগ বেগমের মাথায় বাজ পড়ল। তিনি আকবরকে হত্যা করবেন! ওই ওষুধের তরল পদার্থ নিজেই খেলেন সকলের সামনে। হামিদা বানুর বিশ্বাস হল!
আগ্রা নয়, কাবুল নয়। হুমায়ুনের স্মৃতির দিল্লিতেই সম্রাটের স্মৃতি সৌধ নির্মাণ করতে হবে। তাই চিরতরে দিল্লিতে একাকী জীবনে প্রবেশ করলেন বেগ বেগম। শুরু করলেন এক বিস্ময়কর প্রকল্প। হুমায়ুনের স্মৃতিসৌধ। হজে গিয়ে তিনি সঙ্গে করে নিয়ে এলেন পারস্যের শিল্পীদের। নিজের চোখে সেই সৌধ নির্মাণ দেখবেন বলে অদূরেই একটি ক্ষুদ্র বাড়ি নির্মাণ করে থাকছেন। এই সৌধেই যেন তাঁকে সমাহিত করা হয়! এই ছিল শেষ ইচ্ছা! হুমায়ুন টুম্বের নির্মাতা হাজি বেগম আজও চিরশয়ানে শান্তির নিদ্রায় সেই সৌধের অন্দরে!