পারিবারিক সম্পত্তি সংক্রান্ত আইনি কর্মে ব্যস্ততা। ব্যবসা সম্প্রসারণে অতিরিক্ত অর্থ বিনিয়োগের পরিকল্পনা। ... বিশদ
মহাবিদ্রোহের পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনের অবসান ঘটিয়ে ভারতের শাসনভার ভিক্টোরিয়ার হাতে আসার পরেই রানির ঘোষণায় সুশাসন, প্রজাপালন ও প্রজার ধর্মরক্ষার অঙ্গীকার করা হয়। সেই ভিতের উপর দাঁড়িয়ে খুব যত্নে ভিক্টোরিয়ার মমতাময়ী মাতৃসম মূর্তি গড়ে তোলা হয় সাধারণ ভারতীয়দের মনে। কোম্পানির আমলের সঙ্গে রানিমা-র আমলের পার্থক্য সকলকে বোঝানোয় ত্রুটি করাও হতো না।
সেই আবহেই এসে পড়ে ১৮৮৭ সাল। মানে রানির সিংহাসনে বসার সুবর্ণ জয়ন্তী। মহারানির আমলে ভারতে রেলপথ বিস্তার ও আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা প্রচলনের মতো সুফলের কথা মনে করিয়ে সাম্রাজ্য ও সম্রাজ্ঞীর মূর্তি পূজার আরও এক সুযোগ এনে দেয় জুবিলি উৎসব। সমকালীন রিপোর্ট থেকে জানা যায় যে, রানাঘাটে তো এক মন্দির স্থাপন করে সেখানে ভিক্টোরিয়ার মূর্তিকে পূজাও করা হতো।
তবে জুবিলি উদযাপনের অঙ্গ হিসেবে বাজি প্রদর্শনী, আলোকসজ্জার মতো সরকারি অনুষ্ঠানের পাশাপাশি এদেশে রানির জনহিতকর শাসনের স্মৃতিকে অক্ষয় করার উদ্দেশ্যে লর্ড ডাফরিনের প্রশাসনের তরফে ভারতীয়দের উৎসাহ দেওয়া হল পুর ও জনহিতকর কাজে নিজেদের অর্থ ও শক্তি নিয়োগ করতে। লেডি ডাফরিন তার হাসপাতালের জন্য বেশি করে অনুদান জোগাড়ে নেমে পড়লেন। ‘জুবিলি ব্রিজ’ নামে নতুন সেতু উদ্বোধন করা হল গঙ্গার উপর।
সাধারণ প্রজারা রানির প্রতি স্থায়ী শ্রদ্ধা প্রদর্শনের পথ খুঁজে নিলেন বাড়ির দেওয়ালে পঙ্খের কাজে (পলস্তরা কেটে ডিজাইন) রানির মুখের পার্শ্বচিত্র (face profile) ফুটিয়ে তুলে। জুবিলি উৎসব উপলক্ষে জারি করা সরকারি স্মারক গ্রন্থের প্রচ্ছদ থেকে নেওয়া মাথায় রাজমুকুট শোভিত সেই ছবির পাশে খোদাই করা থাকত ‘কুইন’স জুবিলি-১৮৮৭’ কথাগুলি।
এর পাশাপাশি এই ফলক বসানোর আরও একটি দৃষ্টিকোণের কথা পাওয়া যায় মাইলস টেলরের লেখা ‘এম্প্রেস: কুইন ভিক্টোরিয়া অ্যান্ড ইন্ডিয়া’ বইটিতে। টেলর দেখিয়েছেন যে, ১৮৫৮ সালের সনদ ঘোষণার পর ভারতীয়দের মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে সরকারের কড়া সমালোচনা করা হলেও সরাসরি মহারানির সমালোচনা অত্যন্ত বিরল ঘটনা। কিন্তু দেখা গেল যে, জুবিলির সুযোগ নিয়ে ভারতে ব্রিটিশ শাসনের অগ্রগতিকে প্রশাসনিক স্তরে মহারানির ব্যক্তিগত জীবনের মাইলফলকের সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়ার চেষ্টা। তাই অনেক সময় প্রজারা যেমন রাজভক্তি প্রকাশে সরকারের পরিবর্তে রানিকে বেছে নিলেন উৎসবের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে। এর সঙ্গে মনে রাখতে হবে যে, ১৮৮৫ সালে স্থাপিত জাতীয় কংগ্রেসও কিন্তু নিজের অস্তিত্বের প্রাথমিক বছরগুলিতে নিজেদের দাবিদাওয়াগুলি রাজানুগত্যের মোড়কেই পেশ করত। সুতরাং মনে করা হয়, মহারানির ফলক বসানোর পেছনে অনেকগুলি কারণ কাজ করেছিল সে সময়।
তবে জুবিলি উৎসবের বেশ কড়া সমালোচনা কিন্তু প্রকাশিত হয়েছিল এই শহরে থেকেই। কৃষ্ণচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘বঙ্গবাসী’ পত্রিকার পাতায় জুবিলি উৎসবকে শিশুদের ভয় দেখানোর কাল্পনিক ‘জুজু’র উৎসব আখ্যা দিয়ে লেখা হয়— ‘জুজুবিলি’ উদ্যাপন। লেখা হল যে, ভারতীয়দের মতো এমন অদ্ভুত জাতি পৃথিবীতে সম্ভবত আর নাই। কারণ তারা নিজেদের ঘরের আগুন লাগিয়ে বহ্ন্যুৎসবের আনন্দ উপভোগ করে। উৎসবের মোহে মানুষকে নেশাগ্রস্ত করার জন্য শাসকের তীব্র সমালোচনা করে পত্রিকা সম্পাদক খেদ প্রকাশ করেন যে, দেশবাসীও কতও সহজে নিজেদের দুর্দশা ভুলে গা ভাসিয়ে দিলেন অনুগত্য দেখানোর গড্ডলিকায়।
১৮৮৭ সালের দশ বছর পর রানির হীরক জয়ন্তী উৎসবের ডঙ্কা আবার বেজে উঠল। দুর্ভিক্ষ, কলেরা, মহামারীর মতো সমস্যা সত্ত্বেও ভিক্টোরিয়ার নামের ম্যাজিক অটুট ছিল। কিন্তু উদযাপনের ঠিক আগে কলকাতায় আঘাত হানল এক বড় ভূমিকম্প। ওল্ড মিশন চার্চের চূড়া ভেঙে পড়ল তার অভিঘাতে। ফলে উদযাপনের জৌসুলের উপর কিছু প্রভাব পড়লই।
সাধারণ মানুষের মনে রানির প্রতি এই ভক্তি শ্রদ্ধার অবিচল ছিল ১৯০৩ সালে তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত। তাঁর জীবনের শেষ কয়েক দশক রানি যেন ভারতীয়দের কাছে আরও আপন হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর হিন্দুস্তানি ভাষা শেখার চেষ্টা বা দু’জন ভারতীয় পার্শ্বচর নিয়োগের মধ্যে দিয়ে একটি নির্দিষ্ট বার্তা পৌঁছেছিল ভারতে। তাই তাঁর মৃত্যুর পরেও দেখা যায় যে, লর্ড কার্জনের নেতৃত্বে রানির স্মরণে সেন্ট পল’স গির্জায় অ্যাঙ্গলিকান প্রার্থনা অনুষ্ঠিত হয়। এছাড়াও রাজা বা রানির মৃত্যুতে প্রজাদের শ্রাদ্ধ করার শাস্ত্রীয় অধিকারের উদ্ধৃতি দিয়ে ঠিক সেই সময়েই ময়দানে রীতিমতো মহারানির শ্রাদ্ধানুষ্ঠান আয়োজন করেছিলেন কলকাতার হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষজন। এমনকী, কর্নওয়ালিস স্ট্রিটে গরিব মানুষদের রীতিমত পাত পেড়ে খিচুরি, কপির তরকারি, বোঁদে সহ ভোজে আপ্যায়নের ব্যবস্থা করেছিলেন যতীন্দ্রমোহন ঠাকুররা। শুধু হিন্দুরাই নন, শিয়ালদহ এলাকার মুসলমানরাও আলাদাভাবে শোক জানাতে মিছিল বের করেছিলেন শহরের পথে।
হিন্দুস্তানি ভাষা শেখা, আবদুল করিমকে সচিব হিসেবে বিশেষ স্বীকৃতি দেওয়া ছাড়াও আরও বেশ কয়েকটি ঘটনা থেকে বোঝা যায় যে, রানির যত বয়স বেড়েছে, তত যেন তিনি ভারতীয় ঘেরাটোপের মধ্যে ঢুকে পড়েছেন। বিষয়টা লোকের দৃষ্টিও এড়ায়নি। আর তাই হয়তো তার শাসনের শেষ কয় দশকে রাজভক্তি প্রদর্শনের উপায় হিসেবেও গড়ে উঠেছে বাড়ির দেওয়ালে রানির মুখ ফুটিয়ে তোলার সংস্কৃতি। ব্রিটিশ সরকারের তরফ থেকে খেতাব পাওয়া জমিদার ভূস্বামী শ্রেণির পাশাপাশি সাধারণ মানুষের বাড়ির দেওয়ালেও জুবিলির বছরের প্রোফাইল বা পার্শ্বচিত্র ছাড়াও তার মৃত্যুর পর পুষ্প স্তবকের মাঝে রানির আবক্ষ মূর্তি বসিয়েও শ্রদ্ধা জানানো হয়েছে। আজও বউবাজার বা বড়বাজারের মতো অঞ্চলের দেখা যায় সে সব শিল্পকর্ম। দৈবাৎ এমন ফলকের উপর নজর পড়লে কথা বলে ওঠে ইতিহাস। কিন্তু আমরা সেই ফিসফিস শুনতে পাই কি?