পারিবারিক সম্পত্তি সংক্রান্ত আইনি কর্মে ব্যস্ততা। ব্যবসা সম্প্রসারণে অতিরিক্ত অর্থ বিনিয়োগের পরিকল্পনা। ... বিশদ
এই বাজারের বিনোদনকারীরা কিন্তু নিছক যৌনকর্মী নয়। অত্যন্ত উন্নত সঙ্গীত ও নৃত্যেও পারদর্শী। কত্থক থেকে হিন্দুস্তানি সঙ্গীত নিছক সমঝদার সমাজেই যে পরিচিত ছিল এমন নয়। এই সুন্দরীদের বাজারে সবথেকে বেশি মাত্রায় পাওয়া যেত এরকম শিল্পীদের। সুতরাং সঙ্গীত ও নৃতের্য সমঝদার ও পৃষ্ঠপোষক সমাজ ও প্রশাসনের উচ্চ অংশের মানুষও এখানে যাতায়াত করতেন। মুঘল দরবারে ডাক পড়ত তাদের।
এসব থেকে অনেক দূরে এক বিদেশির ভাগ্যের সঙ্গে এই এলাকাটি বাঁধা পড়েছিল নিয়তির অঙ্গুলিহেলনে। ডেভিড অক্টারলোনির জন্ম হয়েছিল ম্যাসাচুসেটসের বোস্টনে। সে তো আমেরিকায়। তাহলে ডেভিড অক্টারলোনির সঙ্গে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কী সম্পর্ক? তিনি কীভাবে এরকম এক প্রবল শক্তিশালী ব্রিটিশ কোম্পানির ক্যাডেট হিসেবে যোগ দিয়ে সোজা ইন্ডিয়া নামের অনেক দূরের এক দেশে চলে এলেন? কারণটি বেশ চমকপ্রদ। বাবা ক্যাপ্টেন ডেভিড অক্টারলোনি নিজে ছিলেন স্কটল্যান্ডের মানুষ। স্ত্রী পারিবারিক সূত্রে বোস্টনে থাকলেও তাঁর সঙ্গে সেভাবে সময় কাটাতে পারেননি ক্যাপ্টেন। ওয়েস্ট ইন্ডিজে কর্মসূত্রে গিয়ে ক্যাপ্টেনের মৃত্যু হয়। চার ছেলেমেয়ে নিয়ে ইংল্যান্ডে চলে এলেন তাঁর স্ত্রী। একা একা তো আর চার ছেলেমেয়েকে মানুষ করা সম্ভব নয়। অতএব তিনি আবার একটি বিবাহ করলেন। স্যর আইজ্যাক হার্ড। এই হার্ডই তাঁর সৎপুত্রকে বলেছিলেন, কেরিয়ার যদি উজ্জ্বল করতে হয়, তাহলে সবথেকে ভালো সিদ্ধান্ত হল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে যোগ দেওয়া।
১৭৭৭ সালে সবথেকে নিম্নবর্গে পদ ক্যাডেট হিসেবে বেঙ্গল নেটিভ ইনফ্যান্ট্রিতে যোগ দিলেন। এলেন কলকাতায়। সেই শুরু। ডেভিড অক্টারলোনিকে আর কখনও পিছনে তাকাতে হয়নি। শুধুই উত্থান। ইংরেজ ও মহীশূরের যুদ্ধে ১৭৮২ সালে যখন হায়দার আলির বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়ছেন অক্টারলোনি, একটি বুলেট এসে তাঁর বাঁ কাঁধে বিদ্ধ হয়। আর ধরা পড়েন তিনি হায়দার আলির বাহিনীর হাতে। দু’বছর কারাবন্দি থাকার পর মুক্তি এবং আবার ফেরা কলকাতায়। ওই অসম সাহসিকতার কারণে তাঁর প্রমোশন হল দ্রুত। ক্যাপ্টেন থেকে মেজর। মেজর থেকে লেফটেন্যান্ট কর্নেল। তবে এবার তাঁকে ভাগ্য ও পেশা নিয়ে এল অন্য এক শহরে। কলকাতার সঙ্গে যে নগরীর কোনও সাদৃশ্য নেই। নগরের নাম দিল্লি।
দিল্লির নামক এক মোহময়ী শহরে এসে একের পর এক যুদ্ধে জড়িত হলেন অক্টারলোনি। কিন্তু যে কারণে তাঁর আর আজীবন এই বিদেশ ছেড়ে স্বদেশে ফিরে যাওয়া হল না, সেটি হল প্রেম।
ওই চৌরিবাজার লাগোয়া আজকের হৌজ গাজি পুলিস স্টেশনের নিকটবর্তী অঞ্চলে থাকা সেই যে বাজার ই হুসন, সেখানেই আসা যাওয়া করছিলেন অক্টারলোনি। আর সেই সুন্দরীদের বাজারে সন্ধান পেলেন এক সুন্দরী তরুণীর। জানা গেল আদতে সে ছিল পুনের এক ব্রাহ্মণ কন্যা। কিন্তু নাচ শেখায় প্রবল আগ্রহ তার ভাগ্যকে সম্পূর্ণ অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিয়ে আজ এনে হাজির করেছে এই কোঠাবাড়িতে। নাম নিয়েছে সে মুবারক। অক্টারলোনি সঙ্গীত ও নৃত্য দেখলেন এবং বাঁধা পড়লেন মুবারকের আকর্ষণে।
মুবারককে বিবাহ করলেন অক্টারলোনি। ১৩তম বিবাহ। দোর্দণ্ডপ্রতাপ অক্টারলোনি দিল্লির রেসিডেন্ট। অর্থাৎ সর্বোচ্চ পদ। তাঁর স্ত্রীর সংখ্যা এত হতেই পারে। সমস্যা হল মুবারককে ব্রিটিশ ও মুঘল কোনও প্রশাসনই ঠিক চিনতে পারেনি। তিনি নিছক আরও একজন বধূ হয়ে থাকতে আসেননি। ক্রমেই দেখা গেল সেই রূপ। ব্রিটিশ অফিসারদের মুবারক নির্দেশ দিলেন, আমাকে লেডি অক্টারলোনি নামে সম্বোধন করবেন। আর মুঘল আধিকারিকদের বার্তা জেনারেল বেগম হিসেবে ডাকতে হবে। অক্টারলোনি কাউকে যে অধিকার দেননি, সেই মর্যাদা দিলেন মুবারককে। তাঁকে বড় বড় পার্টিতে পর্যন্ত নিয়ে গিয়ে আলাপ করাতেন বিবি মুবারক উল নিস বেগম বলে।
দিল্লিতে মাঝেমধ্যেই বিকেলে হাতির পিঠে ১৩ জন স্ত্রীকে চাপিয়ে অক্টারলোনি বৈকালিক ভ্রমণে বেরতেন। কিন্তু তাঁর ঠিক পাশে থাকতেন একমাত্র মুবারক বেগম। এহেন বিবি মুবারককে দেখা গেল প্রশাসনও বেশ ভালো বোঝেন। তাঁকে কিছু কিছু ফাইল বোঝাতেন অক্টারলোনি। আর সেইসব সিদ্ধান্ত নিখুঁতভাবে নিতেন তিনি। ১৮২৩ সালে বিবির নামে একটি বাগান করেছিলেন অক্টারলোনি। সেই বাগানের প্রবেশপথে একটি সৌধ। সেই সৌধই পরিণত হয়েছিল পরবর্তী সময়ে মসজিদে। আজও মুবারক বেগমের মসিজদ স্বমহিমায় বিরাজমান পুরনো দিল্লির ওই গলিতে। যে অক্টারলোনি সাহেবের নামে কলকাতার অন্যতম আইকনিক এক মনুমেন্ট নির্মিত হয়েছিল (শহিদ মিনার), সেই অক্টারলোনির উপর কতটা প্রভাব ছিল তাঁর বিবির? মুবারক বেগমের শর্ত অনুযায়ী তাঁদের দুই কন্যাকে খ্রিস্ট ধর্মে দীক্ষিত করেননি অক্টারলোনি। তাঁরা পালিত ও পরিচিত হয়েছে ইসলামি নামেই। এতটাই দাপট ছিল বিবি মুবারকের। প্রতি বছর একটি করে ফারসি ও উর্দু ভাষার কবিসম্মেলনের আয়োজন করতেন মুবারক বেগম। তাঁর আহ্বান বিখ্যাত এক শায়ের প্রত্যাখ্যান করতে পারতেন না! কে তিনি? মির্জা গালিব!