সন্তানের বিদ্যাশিক্ষায় নজর দেওয়া প্রয়োজন। অতিরিক্ত পরিশ্রমে শরীরে অবনতি। নানাভাবে অর্থ অপচয়। কর্মপরিবর্তনের সম্ভাবনা বৃদ্ধি।প্রতিকার: ... বিশদ
ছেলেটি নরম। মেয়েটি কঠিন। ছেলেটির চোখে সারাক্ষণ জল টলটল করছে। আসলে জন্মানোর পর শুধু লড়াই করতে করতে দু-দণ্ড বসে কাঁদতে পারেনি কোনওদিন। এখন যেটুকু যা আছে তাইই ইমনের সামনে উপুড় করে দিতে পারলে যেন বেঁচে যায়।
অন্যদিকে ইমন চায় ভালোবাসা, কারণ জীবনে তার ওই একটা জিনিসের অভাব বড়। বাকি সবই তো আছে, এই যেমন হাইটেক গ্যাজেটস, প্রপার লোকেশনে বহুতল বাড়ি, গাড়ি সব। তবে ভালোবাসা, ওটা তো আর বাজারহাটে কিনতে পাওয়া যায় না যে, আদেশ দিলেই সামনে এসে হাজির হবে। তাই ও এসব নিয়ে ভাবে না। কিন্তু হঠাৎ মিশুকের আগমন ওকে এসব ভাবতে বাধ্য করেছে। নাহহ্ প্রেমে পড়ার লোভ ইমনের কোনওদিনও ছিল না। কারণ নিজেকে সে সব থেকে বেশি ভালোবাসে। ইমন জানত প্রেমে পড়লে সবকিছু খোয়াবে সে।
আসলে যার সারা পৃথিবীতে একজনই ভালোবাসার মানুষ, তার মতো অসহায় আর কে আছে? অজানা অচেনা একটা ছেলে—দুম করে ছেড়ে চলে গেলে সেই শূন্য জায়গা ভরাট করার মতো যে কেউ নেই। আর যাকে বাড়ির লোক কখনও ভালোবাসাতে পারল না সে কি না অন্য কারও আদর পাবে? তা সম্ভব!
সম্ভব। মিশুক জানে কীভাবে ভালোবাসাতে হয়। কীভাবে জানান দিতে হয় আমি আছি তোর পাশে। নানা লোকের নানা মত পেরিয়ে কীভাবে কাছের আরও কাছের হয়ে ওঠা যায়।
ফোন কল আর সুরেলা গলার গল্প
মিশুকের সঙ্গে দেখা হওয়া বড় অদ্ভুতভাবে। তবে সেই দেখা হওয়ার আগেও বলার মতো একটা গল্প উঁকি মারে, গল্পটা আর কিছুই না— একটা ফোন কল আর সুরেলা গলার গল্প। মোটেই ছেলেদের মতো কঠিন কর্কশ গলা নয়। মোলায়েম ছন্দে বয়ে যাওয়া এক কণ্ঠস্বর। মনে আছে সে দিনের কথা।
সবে দুপুরের খাওয়া সেরে ইমন তার ল্যাপটপ নিয়ে বিছানায় শুয়েছে। আসলে সারাদিন তার কাজের কাজ খুব একটা নেই বললেই চলে। গান গাইতে ভালোবাসে বলে সকাল বিকেল রেওয়াজ করা আর ইউটিউবে পছন্দের মানুষের গান শোনা কিংবা সিনেমা দেখা। অনেকসময় দাদা এসে জানিয়ে যায় বিদেশি কোনও ফিল্মের খবর। ডাউনলোডের নতুন ফর্মুলা আবিষ্কার করলে সেটাও এসে জানিয়ে যায় বোনকে। আসলে সারাদিন ব্যস্ততার মাঝে এটুকু টাইম বোনকে দিলে মনের দিক থেকেও একটু শান্তি পাওয়া যায় আর কী!
তাই সেইদিনও দুপুরবেলা বাবা-মা কাজে আর দাদা ইউনিভার্সিটিতে, বাড়িতে একা ইমন। টেলিফোনটা হঠাৎ বেজে উঠেছিল। ইমনের বিরক্ত লাগছিল, চার-পাঁচ বার রিং বেজে যাওয়ার পর বাধ্য হয়েই খুব কষ্ট করে বিছানা থেকে উঠেছিল ইমন। ও জানত ওর কোনও ফোন আসবে না কোনওদিন। হয়তো দাদা কিংবা মায়ের ফোন। কিংবা মামাবাড়ি থেকে ফোন করেছে। মা নিশ্চয় অপারেশন থিয়েটারে, তাই মাকে না পেয়ে বাড়ির একমাত্র প্রহরীকে জানিয়ে রাখা। আর শেষ মুহূর্তে বলা— ‘মান্তুকে একবার আসতে বলিস তো, তোর জন্য পিঠে করেছি, ওর হাত দিয়ে পাঠিয়ে দেব সোনাই।’ মান্তু ওর দাদার নাম। বাড়ির আদরের ছেলে, ইমনের খুব প্রিয় মানুষ। কাছের মানুষ যে ক’জন আছে তাদের মধ্যে একজন।
নিজের মনে এসব বুজকুড়ি কাটতে কাটতে ফোনটা কখন বেজে বেজে কেটে গিয়েছে, খেয়াল হয়নি ইমনের। ইমন হাঁফ ছেড়েছিল। যাক বাবা বাঁচা গিয়েছে। কিন্তু বিছানায় ফেরার মুহূর্তে আবার রিং। এবার সাত তাড়াতাড়ি ধরতে উঠেছিল ইমন। মাথায় এসেছিল অন্য কথা। ইমনের বাবা মস্ত ইঞ্জিনিয়ার। কাজের সূত্রে এদিক ওদিক যেতে হয়। ফিরতেও রাত হয়ে যায় কখনও। তখন বাবা বাড়িতে ফোন করে জানিয়ে রাখে। হয়তো বাবারই ফোন, ভেবেছিল ইমন। ফোন ধরে হ্যালো বলতেই ওপাশে ফুটে উঠেছিল মন তোলপাড় করা সেই গলার স্বর।
একটু ক্লান্ত, একটু অবিন্যস্ত— ‘উজান আছে বাড়িতে? বলবেন আমি মিশুক বলছি। ওর তো আজ আমাদের বাড়ি আসার কথা ছিল। এল না কেন? আমার তো ওকে খুব দরকার।’
এই পর্যন্ত সব ঠিক ছিল তারপরের কথায় ইমন হাসবে না কাঁদবে বুঝে উঠতে পারেনি। মিশুক বিড়বিড় করছে ‘ও ছাড়া তো আমার আর কেউ নেই। ও না এলে হবে না বিশ্বাস করুন।’
ইমন জানে আজ দাদা মিষ্টি দিদির সঙ্গে ঘুরতে গিয়েছে। যেদিন দাদার ডেটিং থাকে, সেদিন সকালে বোনের ঘরে উঁকি দেয় সে। বোনকে জিজ্ঞাসা করে কোন রঙের জামা পরে গেলে মিষ্টিকে সহজে হাত করা যাবে। বোনও অমনি বাইরের রোদ-ঝড়-হাওয়া ট্যালি করে বলে দেয় কী পরে বেরনো উচিত।
মিশুকের কথার স্রোতেই এসে মিশেছিল অন্য আর এক নদী ‘আজ তো দাদা মিষ্টি দিদিকে নিয়ে বেরিয়েছে ওর সঙ্গে বেরলে সকালে আমার পছন্দ মতো জামা পরেই তো বেরয় ও...’
কথা শেষ করার সময় দেয়নি মিশুক, খুব আহত স্বরে বলেছিল—‘ও কেন এমন করল বলতে পারেন? ও তো জানত সব...।’ ইমন কী বলবে বুঝতে পারেনি, ওর খারাপ লেগেছিল খুব তাও বলেছিল—‘আচ্ছা দাদা এলে আমি জানাব আপনার কথা...।’ বিড়বিড় করেছিল ছেলেটা, পরক্ষণেই গলা নরম করে বলেছিল, ‘আচ্ছা আপনি কি উজানের সেই বোন যে, ছোটবেলায় বাবার হজমির সঙ্গে ইসবগুল মিশিয়ে দিয়েছিলেন যাতে বাবা অফিসে যেতে না পারে আর সারাদিন আপনার সঙ্গে খেলা করে?’ এবার ইমনের ধাক্কা খাওয়ার পালা। অসভ্য দাদাটা তার বন্ধুদের এসব গল্প করেছে! ছিঃ ছিঃ ইমনের আর কোনও কিছু বলার মুখ নেই। এদিকে ছেলেটি বলেই চলেছে— বড় খারাপ কাজ করেছিলেন আপনি, একজনের গুরুত্বপূর্ণ কাজে বাধা দেওয়া কি ঠিক, বলুন তো?
খানিক স্তব্ধ থেকে ইমন যেন জ্বলে উঠেছিল, অজানা অচেনা একটা ছেলের কাছে জ্ঞান শুনতে রাজি নয় সে। ‘শুনুন, আমি যা করেছি সেটা ছোট বয়সে না বুঝে করেছি, আমি ফোন রাখছি। এরপরে ফোন করলে মনে রাখবেন দাদার একটা মোবাইল আছে, সেটা আপনাদের মতো লোকের সঙ্গে আড্ডা মারার জন্যই মূলত ব্যবহার করা হয়। আসরটা সেখানেই বসাবেন।’
আর কিছু শোনার অবস্থায় ছিল না সেদিন ইমন। প্রচণ্ড রাগে ফোন রেখে দিয়েছিল। ঘরে ফিরেই নিজের মোবাইল থেকে দাদাকে গুনে গুনে বত্রিশটা গালাগাল দিয়ে সম্পর্ক ভেঙে দেওয়ার অঙ্গীকার করে, রাতে খাওয়ার টেবিলে জেহাদ ঘোষণা করে, বাবাকে দিয়ে সব থেকে দামি ল্যাপটপ কিনিয়ে তবে শান্তিতে রাতে ঘুমিয়েছিল সেদিন ইমন।
তখন কী ইমন ভেবেছিল এরপর অনেক রাত কেটে যাবে— না ঘুমিয়ে শুধু মিশুকের কথা ভেবে? না, ভাবেনি। কারণ পরের ফোনটা এসেছিল বেশ কিছুদিন বাদে।
একটা মাথাচাড়া দেওয়া মনখারাপের গল্প
‘আমি ভালোবাসতে শিখিনি মিশুক, আঁকড়ে ধরতে শিখেছি।’— মিশুকের ডানহাতের আঙুলগুলো নিজের ঠোঁটে স্পর্শ করিয়ে কিছুটা ম্লান হেসে কথাগুলো বলল ইমন। আজ দুপুরেও বাড়িতে কেউ নেই। তাই মিশুক এসেছে। যদিও আজ আসার কারণ অন্য। মিশুক চলে যাচ্ছে। বেঙ্গালুরুতে এক নামী প্রতিষ্ঠানে পড়ার সুযোগ পেয়েছে সে। অনেকেই অবাক হয়েছে, অনেকে আবার অভিবাদন জানিয়েছে। ইমনের এত কিছু বোঝার দরকার নেই। মিশুক যে তাকে ছেড়ে তার দুপুরগুলোকে খালি করে দিয়ে চলে যাচ্ছে এটাই বড় কথা। কিন্তু মিশুক বলেছে এটা ওর স্বপ্ন। সব লড়াই এক ধাক্কায় জিতে যাওয়ার ট্রফি।
তাই আজ ইমনের মনখারাপ। খুব মনখারাপ। সেটুকু আঁচ করে নিয়ে মিশুক হালকা হাসল। ইমনকে কাছে টেনে নিয়ে বলল— ‘কষ্ট হলে কাঁদিস না কেন?’
অভিমানী গলায় ইমন উত্তর দিল— ‘আমি কাঁদতে শিখিনি, শুধু আঁকড়ে ধরতে শিখেছি।’ ওর মনে পড়ছিল শুরুর দিনগুলোর কথা—
ফোন এসেছিল প্রায় দশদিন পর, আবার ওই একি সময়। ইমন ধরেছিল ফোন। ওপাশে আবার সেই ছেলেটা, হড়বড় করে বলতে শুরু করেছিল—‘এই শুনুন আপনি আগের দিন ওইভাবে ফোন রেখে দিলেন কেন? আমি তো এমনি বলেছিলাম। আপনার দাদা কত ভালোবাসে আপনাকে, তাই তো ওরকমভাবে বোনের কথা বলে আমাদের...’ কথার মঝে থামিয়ে দিয়েছিল ইমন— ‘দেখুন, আমায় কেউ ভালোবাসে না, আর যদি বাসেও তা আপনার জেনে কী হবে, দুঃখিত আজও আমার দাদা বাড়িতে নেই। তাই ও কেন এল না— টাইপের মেয়েলি ন্যাকামো করবেন না। আমার সময় নেই।’
‘আপনি জানেন আমি ক্লাস নোটস ছাড়াই পরীক্ষা দিলাম। আসলে আপনার কথায় একটা জেদ চেপে গিয়েছিল বলতে পারেন। ভাবলাম আরে আমি তো মেয়ে নই, আমি তো পুরুষ। আমি ইচ্ছে করলে হিমালয় জয় করতে পারি। তাই না?’
ইমন বুঝল মেয়ে-সংক্রান্ত মন্তব্য করাটা ঠিক হয়নি। তার মতো শিক্ষিত মেয়ের মুখে ওটা মানায় না। গ্যাটিস দেওয়ার জন্য এপার থেকে ও বলল—‘তা করতে চাইলে করুন। আমায় কেন ফোন করছেন?’
‘না আসলে হঠাৎ ইচ্ছা করল। আচ্ছা, আপনি কী গান শুনছিলেন এখন? আমিও গান শুনি মাঝে সাঝে। গাইও।’
আর সহ্য করা যাচ্ছিল না। কথা শেষ করার জন্য ইমন বলেই দিয়েছিল ‘আমি হিন্দি গানের সঙ্গে নাচছিলাম এখন, হয়েছে?’ আর তারপরেই সংবিৎ ফিরে পেয়েছিল সে। ফোন রেখে হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলেছিল। বাড়িতে কেউ ছিল না, তাই কান্না যেন বাঁধ ভেঙেছিল সেদিন।
রাতের দিকে ইমন যখন শুতে যাবে তখনই ফোনে অপরিচিত নাম্বার থেকে একটা মেসেজ ঢুকেছিল— একা একা কাঁদবেন না, ভালো দেখায় না। আমি একটু মেয়েলি মানছি, একটুতেই কেঁদে ফেলি। কিন্তু আপনি এত দুঃখে থাকেন কেন সবসময়? সেই শুরু— তারপর বয়ে গিয়েছে অনেকগুলো দিন। নাহ, ইমন আজও মিশুকের সামনে কাঁদতে পারে না। তবে ইমনের অভিমানটুকু বুঝে নেয় মিশুক। এর মধ্যেই ইমন জেনে গিয়েছে মিশুকের জীবনের ভয়ঙ্কর কিছু সত্যি। দু’জনের অবিশ্রান্ত কথা হয়েছে ফোনে। মাঝে মাঝে মিশুক চলে এসেছে ইমনের কাছে। ইমন একের পর এক মিস হওয়া ক্লাস নোটস-এর ডিক্টেশন দিয়েছে এপার থেকে আর ওপার থেকে মিশুক শুনেছে। কিছু রেকর্ড করেছে। ইমনের আসলে জেদ চেপে গিয়েছিল, ক্লাসের সব থেকে ভালো ছেলে উজান মল্লিককে ডিঙিয়ে সারাজীবন দ্বিতীয় হওয়া মিশুককে এবার প্রথম করতেই হবে। নয়তো সেদিনের রিভেঞ্জ বাকি থেকে যাবে যে! সেদিন-যেদিন দাদা বন্ধুকে কথা দিয়েও ইচ্ছে করে কথা রাখেনি, মিশুকের বাড়ি থেকে অনেক দূরে রেস্তরাঁয় গা ঢাকা দিয়েছিল। বন্ধ রেখেছিল মোবাইল। যাতে মিশুক কোনওভাবেই যোগাযোগ করতে না পারে কিংবা কোনওভাবেই পরীক্ষায় উজানের প্রতিপক্ষ না হয়ে দাঁড়ায়।
গোল্ড মেডেল নিয়ে যেদিন মিশুক ইমনের কাছে এসেছিল, সেদিন ইমন আনন্দে কী করবে ভেবে পাচ্ছিল না। তবে মিশুক তুলনায় চুপটি করে বসেছিল। বলেছিল, ‘তোর দাদাকে বড্ড ভালোবাসি, ওকে হারিয়ে জিতে যাওয়ার কোনও ইচ্ছাই নেই আমার। আমি যেটুকু চাই সেটুকু পেলেই হল। এই মেডেলটা তুই রাখ, তোর জন্যই আনা।’ ইমন বুঝেছিল মিশুক আলাদা। ইমনের মতো সবকিছু নিজের করে নেওয়া নয় বরং কিছু জায়গায় ত্যাগেই ওর আনন্দ।
অন্যমনস্ক ইমনের সামনে দিয়ে সেই মিশুক আজ চলে যাচ্ছে। মিষ্টি হেসে ইমনের গাল টিপে দিয়ে দরজার দিকে পা বাড়াল মিশুক। ইমনের মাথা নিচু, ঠোঁট কাঁপছে তিরতির করে। কিন্তু কান্না বেরচ্ছে না। কান্না বেরয় না। সেটাই সব থেকে কষ্টের।
দরজার দিকে এগতে থাকা মিশুকের বুকের মধ্যেও তোলপাড় চলছে যেন। একবার ডাকবে না ইমন? যাওয়ার আগে বিদায় জানাবে না? দরজার চৌকাঠে এসে পা আটকে গেল মিশুকের। ইমনের ভারী অথচ শান্ত গলা পেল— ‘তুমি বোধহয় জানো না মিশুক, আমি...আমি অন্য অনেক মেয়েদের থেকে বেশি সুন্দর। তুমি কখনও ভালো করে দেখেছ আমায়?’
মিশুকের মুখে হাসি ফুটল এবার। হ্যাঁ সে দেখেছে ইমনকে, সেই যেদিন প্রথম ফোন করেছিল সেদিনই দেখেছে। প্রাণ ভরে দেখেছে।
দু-মাস পরের গল্প
ইমন ল্যাপটপ চালু করল। রোজ এসময় মিশুকের সঙ্গে কথা বলে ইমন। না ফোনে কথা বললে চলবে না। মিশুক চায় ভিডিও কল।
ইমন চ্যাট অন করেই নাক সিঁটকালো। ‘ইসস আজকেও সেই এক জামা? তুমি কী স্নান খাওয়া না করে শুধু পড়াশোনা করেই বেঁচে থাকবে ভেবেছ?’ আলগা ধমক লাগালো ইমন।
মিশুক কী বলবে ভেবে পাচ্ছিল না। ইমনকে শান্ত করতে বলে ফেলল— ‘তোকে কিন্তু আজ এই ড্রেসটায় বেশ লাগছে। খুব সুন্দর।’
ইমনের ঠোঁটের কোণ কেঁপে উঠল। ওপাশ থেকে কোনও উত্তর না পেয়ে মিশুক বলল— ‘তোকে নিয়ে কত দেশ ঘোরার স্বপ্ন দেখি আমি জানিস?’ আবার একটা ধাক্কা। চকিতে ইমনের চোখ চলে গেল নিজের পায়ের দিকে। অপুষ্টিতে ভোগা সরু সরু দুটো পায়ের দিকে। সেই ক্লাস ফাইভে সাইকেল করে বাড়ি ফেরার পথে অ্যাক্সিডেন্ট, তারপর পা দুটো শুকিয়ে গেল। আর ঠিক হল না। ব্যস্ত বাবা-মা-দাদা একসময় বুঝে গিয়েছিল ইমন আর কোনওদিন হাঁটতে পারবে না। শুধু ইমনের বুঝতে কিছু সময় লেগেছিল। তার চার দেওয়ালের গণ্ডিকে নিজের ভবিষ্যৎ ভেবে নিতে ঠোঁট কেঁপেছিল। কিন্তু কাঁদেনি সে। কাঁপা কাঁপা স্বরে ইমন বলল, ‘এরকম বল কেন? জানো তো আমি অকেজো। আমায় নিয়ে কোথাও যাওয়ার ক্ষমতা নেই কারও।’
মিশুকের হাসি ভেসে এল। ‘আরে তাতে কী? তোর মতো সুন্দর মেয়েদের হার হয় না কখনও বুঝলি? আমি তো পাশে আছি।’
লজ্জা পেল ইমন। সে জানে মিশুক অন্ধ। সেই প্রথম ফোনের দিনটির জন্য তাই ইমন নিজেকে ক্ষমা করতে পারেনি আজও। দাদা মিশুকের না দেখতে পাওয়ার সুযোগ নিয়েছিল। শেষ মুহূর্তে ক্লাস নোটস দেবে বলেও দেয়নি। তারপর মিশুকের লড়াই যে, কবে ইমনের লড়াই হয়ে গিয়েছিল বোঝেনি ওরা। ইমন বলল, ‘আচ্ছা তুমি জানো আমি সুন্দর? তুমি তো দেখতে পাও না, কীভাবে বোঝো তাহলে?’
ওপাশ থেকে উত্তর এল— ‘কেন আমি তো দেখতে পাচ্ছি তোর চোখের কোণে জল।’ হুইলচেয়ারে বসা ফর্সা, একঢাল চুলের মাঝে মায়াবী মুখ মেয়েটা এতক্ষণে খেয়াল করল, ওর চোখের কোণে জলের বিন্দু টলটল করছে। ইমন কাঁদছে। যদিও কোনও কারণ নেই তাও মন খুলে কাঁদছে আজ সে। নিস্তব্ধ ঘরে দু’পক্ষই আজ চুপ।
দু’জনের মনই যেন একসঙ্গে বলে উঠল— আমাদের গল্পটা আর পাঁচটা সাধারণ মানুষের গল্পের মতো বেঁচে থাক। এর বেশি কিছু চাই না আমরা।