সন্তানের বিদ্যাশিক্ষায় নজর দেওয়া প্রয়োজন। অতিরিক্ত পরিশ্রমে শরীরে অবনতি। নানাভাবে অর্থ অপচয়। কর্মপরিবর্তনের সম্ভাবনা বৃদ্ধি।প্রতিকার: ... বিশদ
রাজলক্ষ্মী দেবীর প্রথম হিন্দি ছবিতে অভিনয় প্রখ্যাত পরিচালক দেবকী বসুর হাত ধরে। তিনের দশকেই দেবকী বসু ‘পুরাণ ভকত’ নামে একটি হিন্দি ছবি করেছিলেন। তাতে অভিনয়ের পাশাপাশি রাজলক্ষ্মী দেবীকে গানও গাইতে হয়েছিল। প্রথম হিন্দি ছবিতেই তাঁর নিখুঁত উচ্চারণ শুনে নিউ থিয়েটার্সের কর্তারা ঠিক করে নিয়েছিলেন যে, তাঁদের হিন্দি ছবিগুলিতেও রাজলক্ষ্মী দেবীই অভিনয় করবেন। নিউ থিয়েটার্সের হিন্দি ছবি ছাড়াও তিনি বম্বের অনেক ছবিতেও কাজ পেয়েছিলেন হিন্দি সংলাপ বলায় তাঁর দক্ষতার কারণে। সহজাত অভিনয়টা তো ছিলই। বম্বের বিখ্যাত পরিচালক হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায় যখন ‘মুসাফির’ করেছিলেন, তখন একটি বিশেষ ধরনের অভিনয়ের জন্য কলকাতা থেকে নিয়ে গিয়েছিলেন রাজলক্ষ্মীকে। ছবিটি যাঁরা দেখেছেন তাঁদের নিশ্চয়ই মনে আছে, নতুন ভাড়াটেদের বাড়িতে শুভাকাঙ্খী হিসেবে ঢুকে কীভাবে নিজের স্বার্থসিদ্ধি করার চেষ্টা করছেন রাজলক্ষ্মী দেবী। চরিত্রটা ছোট্ট হলেও তার ব্যাপ্তি কিন্তু অনেক বড়। তাঁর হিন্দি ভাষায় পারদর্শিতার জন্যই নিউ থিয়েটার্সের বিখ্যাত পরিচালক বিমল রায় ‘দো বিঘা জমিন’ ছবির জন্যও কলকাতা থেকে বম্বে নিয়ে গিয়েছিলেন এই অভিনেত্রীকে।
শুধু হিন্দিই নয়, উর্দু, অসমিয়া ও ওড়িয়া ভাষার অনেক ছবিতেও কাজ করেছেন রাজলক্ষ্মী। সেইসব ছবিতেও নিজেই সংলাপ বলতেন, অন্যকে ডাবিং করতে দিতেন না। বাংলা-হিন্দিতে দখল তো ছিলই, প্রয়োজন বুঝে ওড়িয়া আর অসমিয়ার কথ্য ভাষাও তিনি আয়ত্ত করে নিয়েছিলেন। এত সাধ্য সাধনা করে ভাষা শেখা প্রসঙ্গে বলতেন, ‘প্রাণ দিয়ে আমি অভিনয় করলাম আর একজন এসে এমন করে সংলাপ বলল যে, চরিত্রটাই মার খেয়ে গেল! অভিনয় করার সময় শুধু শরীরী ভাষা বা হাত পা নাড়ানোই যথেষ্ট নয়, কণ্ঠস্বরের অভিনয়ও সমান গুরুত্বপূর্ণ। অন্য ভাষায় যারা কথা বলে তারাও তো মানুষ। তারা যদি সে ভাষায় কথা বলতে পারে আমিই বা পারব না কেন? একটু হয়তো পরিশ্রম হতো।’ ভাগ্যের দোষে হয়তো বেশিদূর লেখাপড়া করা হয়ে ওঠেনি। কিন্তু যে কোনও পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার অদম্য ইচ্ছে ছিল তাঁর।
উত্তমকুমার, বিশ্বজিৎ বা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মতো নায়করাই হোন কিংবা ছবি বিশ্বাস, পাহাড়ি সান্যাল, ভানু-জহরদের মতো শক্তিশালী অভিনেতারাই হোন, রাজলক্ষ্মী স্ক্রিনে থাকলে সকলেই নিচুস্বরে কথা বলতেন। আগুনের মতো তেজ, পুষ্পদন্তী হাসি, পৃথুলা, সর্বদা তিক্তমুখী— পর্দায় মূলত জাঁদরেল নেগেটিভ শেডে অভিনয় করলেও বাস্তবে মোটেও রাজলক্ষ্মী দেবী তেমনটা ছিলেন না। দানধ্যান করতেন। জীবনের শেষ দিকে দাঁত পড়ে যায়। আর দাঁত বাঁধাননি। তবে, অভিনয়ের দাপট এতটুকু কমেনি। ‘প্রথম কদম ফুল’ ছবিতে ছায়া দেবীকে তাঁর বউমা তনুজার অফিস থেকে দেরি করে ফেরা সম্বন্ধে ফোকলা মুখে বলছেন রাজলক্ষ্মী, ‘পাড়ার মুখপোড়াদের কথা শুনলে গা জ্বলে যায়। যা মুখে আসে তাই বলে গা...আমার আর কী! কিন্তু যা রটে তার কিছু তো বটে।’ আবার ‘লুকোচুরি’ ছবির সেই কমিক দৃশ্যটার কথাই ভাবুন। হঠাৎই মালা সিনহার ঘরে মা রাজলক্ষ্মী এসে উপস্থিত। কিশোরকুমার তখন রেডিওর পিছনে আত্মগোপন করেছেন। আড়াল থেকে নিজেই রেডিওর মতো করে ঘোষণা করছেন। মালা সিনহা রেডিও শুনছেন বলে রাজলক্ষ্মীও খানিক নিশ্চিন্ত হলেন। কিশোরকুমার রেডিওর পিছন থেকে বলেই চলেছেন, এইমাত্র জানা গেল হিটলার তিব্বতে গিয়ে সন্ন্যাস নিয়েছেন। শীঘ্রই তিনি ফিরে এসে সকলের পিণ্ডি চটকাবেন বলে ঘোষণা করেছেন..তারপর হুয়া হুয়া বলে তাঁর অননুকরণীয় স্টাইলে শব্দ করছেন। রাজলক্ষ্মী ঘুরে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘এ কী কথা। বাঙালির মেয়ে বাংলা ভালো লাগে না। হুয়া হুয়া হু...।’ এরপরই রেডিওর পিছন থেকে কিশোরকুমারের চুলের মুঠি ধরে বের করে আনলেন রাজলক্ষ্মী। কিশোরকুমার আর মালা সিনহা তখন কিংকর্তব্যবিমূঢ়।
সারা জীবনে আড়াইশোরও বেশি ছবিতে অভিনয় করেছেন রাজলক্ষ্মী দেবী। তাঁর অভিনীত নাটকের সংখ্যাও হাফ সেঞ্চুরি পার করে ফেলেছে। অথচ কোনও রোলেই তিনি ব্যর্থ হননি। বংশী আশ পরিচালিত ‘চাটুজ্যে বাড়ুজ্যে’ ছবির নায়িকা ছিলেন তিনি। ভানু-জহরের পাশে তিনিও সমানতালে অভিনয় করে দেখিয়ে দিয়েছিলেন কমেডি অভিনয় কাকে বলে! ছবির জগতের বাইরে কলকাতা বেতার ও গ্রামোফোন রেকর্ডেও বহু নাটকে তিনি তাঁর অভিনয় বৈশিষ্ট্যের পরিচয় রেখেছেন। তাঁর গানের গলাটিও ছিল চমৎকার। ‘জীবন জিজ্ঞাসা’ ছবির আউটডোরে থেকে ফেরার পথে গাড়ি দুর্ঘটনায় আহত হন রাজলক্ষ্মী। ভর্তি হতে হয় হাসপাতালে। সে যাত্রায় প্রাণে বেঁচে গেলেও শরীরটা আর সেভাবে রোগমুক্ত হয়নি। নিউমোনিয়া আর অ্যানিমিয়ায় ভুগে বেশ কিছুদিন বিছানায় পড়েছিলেন। ১৯৭২ সালের ২৬ মে সব শেষ। চিরতরে বিদায় নিলেন রাজলক্ষ্মী। বিছানায় শুয়ে শুয়ে অকথ্য যন্ত্রণা ভোগ করে অবশেষে মৃত্যুর কাছে হার মানলেন বাংলা ছবির এই অভিনেত্রী।