সন্তানের বিদ্যাশিক্ষায় নজর দেওয়া প্রয়োজন। অতিরিক্ত পরিশ্রমে শরীরে অবনতি। নানাভাবে অর্থ অপচয়। কর্মপরিবর্তনের সম্ভাবনা বৃদ্ধি।প্রতিকার: ... বিশদ
আমার কপালে ভাঁজ। কে আসতে পারে? কামাখ্যা মন্দিরের গা-ছোঁয়া বাদল পাণ্ডার গেস্ট হাউস। কেয়ারটেকার গোছের কেউ থাকে না। খাওয়া দাওয়ারও পাট নেই। বাইরে রকমারি হোটেল আছে, দোকান পত্রও। সেখান থেকেই খেয়ে আসতে হয়। কালকেও বাইরের ছোট একটা হোটেলে গিয়ে রাতের খাওয়া সেরেছি। রুটি, স্কোয়াশের তরকারি আর সুগন্ধি প্যাঁড়া। আজকেও তেমনই পরিকল্পনা। রণেন ফিরলেই খেতে বেরব। অপেক্ষা করছি নির্জন অতিথিশালায়। এক পেট খিদে। তার মধ্যে আবার দরজায় ঠক ঠক।
খুলব কি? ভাবনা পাক খাচ্ছে মাথায়। রণেন বলে গিয়েছিল, ‘কেউ ডাকলে দরজা খুলবি না কিন্তু।’ না খুলে উপায় কী? ‘অপেক্ষা কর আসছি’ বলে সেই যে রণেন চলে গেল আর পাত্তা নেই। ভাবনার মাঝে দরজায় আবার টোকা। সঙ্গে মোটা গলায় আদেশ, ‘দরজা খোল।’
কিছু একটা বলে কাটিয়ে দেব? রণেন থাকলে বানিয়ে কোনও কথা বলে লোকটাকে ভাগিয়ে দিতে পারত। আমি আবার মিথ্যে কথা বলতে পারি না। রণেনের মতো অনেক কিছুই পারি না।
রণেনের জন্যই এখানে আসা। আমেরিকা থেকে ফিরেই ও এবার বলল, ‘আমার সঙ্গে চল।’
—কোথায়?
—অসম। কামাখ্যা মন্দির।
বাবা-মা, দাদুর সঙ্গে তিন বছর আগে গিয়েছিলাম। দাদুর খুব প্রিয় জায়গা এই মন্দির। ঘন ঘন আসতেন। গুয়াহাটিতে ইনকাম ট্যাক্স অফিসার হিসাবে কাটিয়েছেন বছর দশেক। ছ’মাস আগে দাদু মারা গিয়েছেন। দাদুর কথা মনে পড়বে, সে কারণে তাঁর প্রিয় জায়গায় যেতে ইচ্ছে করছে না। তাই রণেনের মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘আমি যাব না রে! একবার দেখেছি তো।’
রণেন না-ছোড়। বলল, ‘আবার দেখবি। চল আমার সঙ্গে।’
—কেন রে! হঠাৎ কী হল?
—এক তান্ত্রিকের খোঁজ পেয়েছি। একদম জেনুইন।
—আমি কী করব?
—খাবি দাবি ঘুরে বেড়াবি।
—কী লাভ আমার?
—আরে, দেখেছিস তো কত সুন্দর জায়গা। উপরে পাহাড়, নীচে নদী। মনের আনন্দে ছবি আঁকবি।
রণেনের কথা ফেলতে পারি না। ছোটবেলার বন্ধু। ক্লাস ফাইভ থেকে বারো ক্লাস পর্যন্ত এক স্কুল। স্কুল ডিঙিয়ে আমি আর্ট কলেজে। পাশ করে এখন ছবি আঁকি। আর রণেন প্রেসিডেন্সিতে কেমিস্ট্রি অনার্স। তারপর এমএসসি পাশ করে রিসার্চ করতে চলে গেল আমেরিকা। সেন্ট্রাল মিচিগান ইউনিভার্সিটি।
শীতকালে দেশে আসে রণেন। মাঝে মাঝে ভূত চাপে ওর মাথায়। একবার আমাকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল ওড়িশার জঙ্গলে। কী এক গাছ খুঁজতে। সেই গাছের পাতা দিয়ে কাটা মাংস মুড়ে রাখলে নাকি টুকরোগুলো জুড়ে যায়। সেই পাতা ওর গবেষণার কোনও কাজে লেগেছিল কি না, বলেনি আমাকে।
একবার নিয়ে গেল উত্তর সিকিমের মঙ্গানের কাছে এক গ্রামে। ওখানে জঙ্গলের গভীরে ঝর্ণার টলটলে জল জমে সৃষ্টি হয়েছে ছোট্ট পুকুর। পাহাড়ের ক্ষুদ্র সমতলে জলাশয়ের স্বচ্ছ জলে এক ধরনের ব্যাঙ লাফিয়ে বেড়ায়। অদ্ভুত সেই প্রাণী। তাদের পা কেটে গেলে নাকি আবার নতুন করে গজিয়ে যায়। অনেক ছলচাতুরি করে সেই ব্যাঙ সংগ্রহ করেছিল রণেন। তারপর কী করেছিল, জানি না।
এবার অন্য খেয়াল রণেনের। তন্ত্র-মন্ত্র আর ভূত ঢুকেছে ওর মাথায়। আমেরিকার এক বুড়ো অধ্যাপকের কাছে শুনেছে কামাখ্যার কাহিনি। কামাখ্যার অনেক তান্ত্রিক এখনও নাকি ভূত পোষে। চাকরের মতো ভূতদের খাটায়। এমনকী ভূতের সাহায্য নিয়ে কোনও প্রতিদ্বন্দ্বী বা শত্রুকে ফিনিশ করে দেয়।
উন্নত দেশেও এরকম ভাবনা! একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিলাম আমি। বলেছিলাম, ‘দূর ভূত-টুত ছাড় তো!’ ঝাঁজিয়ে উঠেছিল রণেন। ‘ছবি আঁকিস তো কাগজে। দুই ডাইমেনশন ওটা। মূর্তি গড়লে তিন মাত্রা। আমি বুঝি চার ডাইমেনশন। এর বাইরেও কত রকম থাকতে পারে, জানিস?’
রণেনের সঙ্গে তর্ক করিনি। মনমেজাজও ভালো নেই ওর। বিদেশি রিসার্চ গাইড নাকি ওর আবিষ্কার নিজের নামে পেটেন্ট করিয়ে নিয়েছে।
ইদানীং ভূত-প্রেত মাথায় চেপেছে ওর। একবার কিছু মাথায় ঢুকলে শেষ না দেখে ছাড়ে না রণেন। প্রচণ্ড জেদি আর উচ্চাকাঙ্ক্ষীও। মাঝে মাঝে ওকে খুব স্বার্থপর মনে হয়।
রণেন যা চাইছে তাইই করবে। কামাখ্যা যাবেই। ওখানকার তান্ত্রিকদের খোঁজও পেয়েছে ও। কয়েকজনের সঙ্গে লোক মারফত যোগাযোগ হয়েছিল। তান্ত্রিকরা নিভৃত শ্মশানচারী। মন্দির-চাতালে কখনও বা গুহার অন্ধকারে থাকে। ফোন, ইন্টারনেটের ব্যবহার জানে না। লোক মারফতই যোগাযোগ করতে হয়।
এসব কথা রণেনই বলেছে। আজ যেমন বলল, ‘ঘরে থাক। পাহাড় থেকে ঘুরে এসে তোকে ডাক দেব। অন্য কেউ ডাকলে ঘরের দরজা খুলবি না কিন্তু।’ খোলা ঠিক হবে কি না ভাবছি। তার মধ্যেই আবার দরজায় সজোরে ধাক্কা। সঙ্গে বজ্রগম্ভীর কণ্ঠধ্বনি – ‘কপাট খোল।’
‘খুলছি’। কাঁপা গলায় অস্ফুট উচ্চারণের পর আমি টেবিলে হাতড়ে মোমবাতি জ্বাললাম। ডান দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে দরজার দিকে কয়েক পা এগলাম। দরজার ভারী হুড়কো খুলতেই বুকটা ধক করে উঠল। ছ-ফুট দরজার মাথা ছাড়িয়ে বিশালদেহী এক মানুষ। অল্প আলোয় অস্পষ্ট অবয়ব। গায়ে লাল আলখাল্লা। মুখ ভর্তি সাদা দাড়ি। কপালে সিঁদুর। শক্তসমর্থ বৃদ্ধ আমাকে সরিয়ে দিয়ে ঘরে ঢুকলেন। টান টান চাদর পাতা রণেনের বিছানায় বিশালদেহী মানুষটা ধপ করে বসে পড়লেন।
আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। চোখ লাল। দৃষ্টি স্থির। মুখে প্রবল গাম্ভীর্য। কিন্তু ঠোঁটের কোণে হাল্কা হাসির রেখা। শান্ত মুখ, ভাবুক চাহনি। আমার পর্যবেক্ষণ বলছে, মানুষটা আক্রমণকারী নয়।
একবার কেশে গলা পরিষ্কার করে নিয়ে স্পষ্ট বাংলা উচ্চারণে বললেন, ‘বলুন কী জানতে চান?’
এই তল্লাটের অনেকেই নিখুঁত উচ্চারণে বাংলা ভাষায় কথা বলেন। কথায় কোনও অবাঙালি টান ধরা পড়ে না। এই মানুষটিও তেমনই। আমি ওঁর মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘আমি নই। আমার বন্ধু রণেন জানতে চায়। বাইরে গিয়েছে ও।’
—আমি জানি। ও গিয়েছে অঘোরপন্থী রূপনাথের কাছে। ওটা তান্ত্রিক না ছাই।
—আপনি কে?
—আমি মাতৃসাধক। কীসের একটা টানে এখানে...
কথা শেষ হবার আগেই কারেন্ট চলে এল। ঘর আলোকিত। ঘরের লাগোয়া বারান্দায় কম পাওয়ারের আলো টিম টিম করে জ্বলছে। আমি ঘরের খোলা দরজা বন্ধ করব ভেবে উঠে দাঁড়াতেই সাধক মানুষটি বললেন, ‘চলুন বাইরে বসি।’
বাইরে অপরিসর বারান্দা। শীতের হাল্কা আমেজ। পাশাপাশি বসলাম আমরা। সামনে মন্দিরের চূড়া। নীচে তাকালে চোখে পড়ে মন্দিরের সুবিশাল অঞ্চল। নীচের একটা ছোট মন্দিরের দিকে আঙুল তুললেন সাধক। মন্দির চূড়ায় ধাতব ত্রিশূলে ঠিকরে পড়ছে বৈদ্যুতিক আলো। ওদিকে তাকিয়ে সাধক বললেন, ‘ওখানে নরবলি দেওয়া হতো।’
‘অ্যাঁ।’ আমার বুকটা ধক করে উঠল। একটা ঢোঁক গিলে বললাম, ‘আজকাল?’
—সরকার বন্ধ করে দিয়েছে। তবে সরকারের কথা সবাই কি আর শোনে!’ আমার মুখের উপর উদাসীন দৃষ্টি মেলে মানুষটি বললেন।
আমার বুকে হাতুড়ি মারল কেউ যেন! হৃৎপিণ্ডের ধক ধক শুনতে পাচ্ছি। গলা শুকিয়ে কাঠ। এখনও নরবলি হয় নাকি? আমার পাশে বারান্দার চেয়ারে বসা সাধক কি বুঝে ফেললেন মনের কথা? আকাশের দিকে আড়াআড়ি চোখ মেলে বললেন, ‘গোপনে তো কত কিছুই হয়। দেশ-বিদেশের মানুষ আসে টাকার থলি নিয়ে। তন্ত্রমন্ত্র কিনতে চায়। আরও কত কী করে।’
খানিক মৌন থেকে আমার দিকে চোখ ফেরালেন সাধক। আপনি থেকে এবার সম্ভাষণে তুমি। বললেন, ‘কী জানতে চাও তুমি?’
আমি খুব মামুলি একটা প্রশ্ন করলাম, ‘আমার কি চাকরি হবে?’
‘ছেঁদো কথা রাখো তো!’ বিরক্ত হলেন সাধু। বললেন, ‘চাকরি করলে খেতে পাবে, না করলেও অভাব হবে না। ছবি এঁকে অনেক কামাবে তুমি।’
আমি ছবি আঁকি, মানুষটা বুঝল কীভাবে? আমার ভাবিত মুখের দিকে তাকিয়ে তৎক্ষণাৎ উত্তর ছুঁড়ে দিলেন, ‘তন্ত্রসাধনা দশমহাবিদ্যা অনেক কিছু জানান দেয়।’ আমার গলা একদম খাদে। স্বরে মাখন। জিজ্ঞেস করলাম, ‘তন্ত্রসাধনা করে আর কী জানতে পেরেছেন আপনি?’
—এই যেমন তোমার দাদুর কথা। চাইলে তোমাকে দেখাতে পারি।
—সে কী!
আমার মুখে কথা নেই। কোনও রকমে ঢোঁক গিলে বললাম, ‘দ...দরকার নেই। দাদু যেখানে আছেন সেখানেই থাকুন। ভালো থাকুন।’
—ভয় পাচ্ছো? জানবে, জীবন আর মরণ দুই মাত্রাতে বিচরণ করতে পারলে ভয়ের কিচ্ছু নেই।
আমার মুখে কথা নেই। একটু ধাতস্থ হয়ে বললাম, ‘আমি ভালো ছবি আঁকতে চাই।’
—হবে হবে। তবে সত্যকে ধরে রাখবে। তোমার জীবনের অনেক দাম। একটু থেমে আবার বললেন, ‘আমি বগলা সাধক। দশমহাবিদ্যা শুনেছ তো? দশমহাবিদ্যার অনন্ত শক্তি। প্রকাশ পেয়েছে বিভিন্ন রূপে। কালী, তারা, কমলা, বগলা, ষোড়শী, ভুবনেশ্বরী, ভৈরবী, ছিন্নমস্তা, ধূমাবতী আর মাতঙ্গী। আমি বগলা মাতার সাধক। মা বগলা সত্যের পূজারি। সামান্য মিথ্যে সহ্য করতে পারেন না।’ কথা শেষ করেই মা বগলার স্তব শুরু করলেন,
‘ওম হ্রিং বগলামুখী সর্ব দুষ্টানাম।
বাচম-মুখম-পদম স্তম্ভ জীহবা।
কীলয় বুদ্ধিং বিনাশয়।
হ্রিং ওম স্বাহা।’
স্তব শেষে চোখ মুদে স্থির বসে রইলেন। খানিক পর শান্ত চোখ মেলে বললেন, ‘কই তোমার বন্ধু তো এল না!’
—আপনি জানেন ও কোথায় গিয়েছে?
চোখ বন্ধ করে অনেকক্ষণ বিড়বিড় করে মন্ত্র জপলেন সাধু। তারপর চোখ খুলে বললেন, ‘তোমার বন্ধু শুক্রেশ্বর শ্মশান ঘাটে। শব খুঁজে বেড়াচ্ছে। ভূত সাধনা করবে। অতই সোজা?’
কী বলব বুঝতে পারছি না। মানুষটির সব কথাও যে মাথায় ঢুকছে এমন নয়। তবু ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ভূত সাধনা খুব কঠিন?’
—কঠিন তো বটেই। তার উপর তোমার বন্ধু মিথ্যে কথা বলে। শক্তিমন্ত্র জপের অনুপযুক্ত। তোমাকে বলেছে এখনই ফিরবে! মিথ্যে কথা। ও সারারাত শ্মশানে কাটাবে।
সাধু উঠে দাঁড়ালেন। আমি প্রণাম করে বললাম, ‘আপনি চলে যাচ্ছেন?’
‘যাচ্ছি।’ সাধু মন্দিরের দিকে তাকিয়ে হাত জোড় করে প্রণাম করলেন, ‘প্রপদ্যে শরণম দেবী শ্রী কামাখ্যা সুরেশ্বরম/শিবস্য দয়িতং শুদ্ধং কামাখ্যাম কাম রূপিণী...।’ তারপর আমার দিকে ঘুরে বললেন, তোমার দাদু আমার অনুগত। বড়ই আপনজন। আমার শিষ্যদের অনেক রকম সাহায্য করেছেন। তাই তোমাকে সাবধান করে দিতে আমার আগমন।’
‘বলুন,’ মাথা নিচু করে আমি বললাম।
—শোনো, শবদেহের খোঁজে পথভ্রষ্ট সাধক পাগল হয়ে ওঠে। আত্মীয়-বন্ধু এমনকী সন্তানকেও বলি দিয়ে দেয়।
সাধু চলে গেলে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করলাম। ঘড়িতে রাত এগারটা। তখনও বাইরে অনেক হোটেল দোকান খোলা। বাস ট্যাক্সিও চলছে হয়তো। আমি ব্যাগ গুছিয়ে নিয়ে দ্রুত চিঠি লিখলাম। ‘রণেন, বিশেষ কাজে আমি চলে যাচ্ছি। শ্মশান থেকে ফিরে সকালে আমাকে দেখতে পাবি না। কলকাতায় দেখা হবে।’ হোটেলে ঢুকে রুটি, স্কোয়াশের তরকারি আর সুগন্ধি প্যাঁড়া খেলাম। গত রাতের মতোই। তারপর একটা ট্যাক্সি নিয়ে সোজা গুয়াহাটি স্টেশন। অনেক টাকা গচ্ছা গেল। যাক! প্রাণটা তো গচ্ছা যায়নি। অনেক দাম যে ওটার!