সন্তানের বিদ্যাশিক্ষায় নজর দেওয়া প্রয়োজন। অতিরিক্ত পরিশ্রমে শরীরে অবনতি। নানাভাবে অর্থ অপচয়। কর্মপরিবর্তনের সম্ভাবনা বৃদ্ধি।প্রতিকার: ... বিশদ
মঞ্চের মতো ছবির জগতেও দুর্দান্তভাবেই শুরু করেন রাজলক্ষ্মী দেবী। তাঁর প্রথম চলচ্চিত্রে অভিনয় ১৯৩২ সালে। নিউ থিয়েটার্সের ‘পল্লীসমাজ’ ছবিতে। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের এই কাহিনির চিত্ররূপ দিয়েছিলেন তৎকালীন নটসম্রাট শিশিরকুমার ভাদুড়ী। বিভিন্ন রঙ্গালয়ে অভিনয়কালীন রাজলক্ষ্মী দেবীর পরিচয় হয় শিশিরকুমারের সঙ্গে। শিশিরকুমারের সঙ্গে যুক্ত থিয়েটার শিল্পীরাই মূলত এই ছবিতে অভিনয় করেছিলেন। যেমন শিশিরবাবু নিজে, তাঁর ভাই বিশ্বনাথ ভাদুড়ী, কঙ্কাবতী দেবী, প্রভাবতী দেবী। রাজলক্ষ্মী দেবীরও সেই সূত্রেই অভিনয়। তবে, ‘পল্লীসমাজ’ খুব একটা চলেনি। ছবিটা প্রযোজনা করে নিউ থিয়েটার্সের সম্ভবত আর্থিক ক্ষতিই হয়েছিল।
‘পল্লীসমাজ’ ছবির ভাগ্য যত খারাপই থাক, রাজলক্ষ্মী দেবীর ভাগ্য ওই একটি ছবিতে অভিনয় করেই খুলে গেল। তাঁর অভিনয় দেখে কর্তৃপক্ষ এতটাই আপ্লুত হয়ে গেলেন যে, নিউ থিয়েটার্স তাঁকে বাঁধা মাইনের শিল্পী করে নিল। তবে এটা বলতেই হবে যে, এই নির্বাচনের মর্যাদা তিনি রেখেছিলেন। তার উপর ভরসা করে যে কর্তৃপক্ষ ভুল করেননি, তা প্রতি মুহূর্তে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। এরপর থেকে নিউ থিয়েটার্সের প্রায় সব ছবিতে ছোট-বড় যে চরিত্রেই তিনি অভিনয় করেছেন, তার প্রত্যেকটিতেই তিনি দর্শকদের প্রশংসা আদায় করে নিয়েছিলেন। সিরিয়াস চরিত্রেই শুধু নয়, কমেডি চরিত্রে তাঁর অভিনয় দেখেও দর্শকদের পেটে খিল ধরে যেত। রাজলক্ষ্মী দেবীর কমেডি অভিনয় দক্ষতার প্রথম প্রমাণ পাওয়া গেল ডি জি’র ছবিতে। ডি জি অর্থাৎ ধীরেন গাঙ্গুলি নিউ থিয়েটার্সের ব্যানারে ‘মাসতুতো ভাই’ ছবিটি পরিচালনা করলেন। এই ছবিতে জনৈক মেমসাহেবের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন রাজলক্ষ্মী দেবী। আর তাঁর সে কী অভিনয়! সারা প্রেক্ষাগৃহ হাসিতে ফেটে পড়েছিল।
‘মাসতুতো ভাই’ ছবিটি হয়তো সকলের দেখা নেই। তবে রাজলক্ষ্মী দেবীর কমেডি অভিনয় প্রসঙ্গে একটি ছবির কথা উল্লেখ করলে সকলেরই স্মৃতি সতেজ হয়ে উঠবে। ‘চাওয়া পাওয়া’ ছবির মজার দৃশ্য। তুলসী চক্রবর্তী জানতে পেরেছেন সুচিত্রা সেনকে খুঁজে দিতে পারলেই নগদ ১০ হাজার টাকা পুরস্কার পাওয়া যাবে। উত্তম-সুচিত্রা তার কাছেই এসে উঠেছেন। তুলসী তো মনে মনে বিড়বিড় করছেন, ‘১০ হাজার টাকা পুরস্কার...।’ ঘরে কী একটা কাজ করছিলেন রাজলক্ষ্মী দেবী। একটু নির্লিপ্তভাবেই বললেন, ‘কীসের পুরস্কার! সকালবেলা নেশা টেশা করেছ নাকি!’ তুলসী চক্রবর্তী তখন তাঁকে গোটা ব্যাপারটা বোঝালেন। খানিকটা যেন বুঝলেন তিনি। —‘ও মেয়ে যে সেই মেয়ে তা তুমি কী করে জানলে। সঙ্গে মানুষ রয়েছে...।’ তাঁর সংশয় যেন কাটে না। তুলসী তখন স্ত্রীকে কাছে ডেকে নিয়ে পরামর্শ দিলেন, ‘এই খবরটা তোমাকেই বের করতে হবে। তুমিই পারবে। এবেলা পোলাও, ওবেলা লুচি খাইয়ে গোপন খবরটা তুমিই নিতে পারবে গিন্নি।’
সুচিত্রা সিঁদুর পরেন না। রাজলক্ষ্মী গেলেন গোপন খবর আনতে। সুচিত্রাকে ডেকে নিয়ে এসে বললেন, ‘কাল যখন এসেছিলে পর্দার আড়াল থেকে দেখেছিলুম। সেই থেকে আলাপ করার জন্য... এসো মা এসো। যেমন আমার মেয়ের রূপ, তেমনই আমার জামাইয়ের চেহারা।’ সুচিত্রাও কম যান না। পাল্টা বললেন, ‘পর্দার আড়াল থেকে জামাইকে দেখেছেন।’ সুচিত্রার এই কথায় যেন লজ্জায়, সম্ভ্রমে মরে যান রাজলক্ষ্মী। অস্ফুটে উচ্চারণ করলেন, ‘দুষ্টু মেয়ে।’ এই অভিনয়ের সময় কে বলবে, পর্দায় বেশির ভাগ সময়ই তাঁকে জাঁদরেল চরিত্রে দেখা গিয়েছে!
নিজের এই দুই ধরনের অভিনয় নিয়ে রাজলক্ষ্মী দেবী বলতেন, ‘মানুষকে হাসানো আর কাঁদানোই তো আমাদের পেশা। পৃথিবীতে এসে ভালো কাজ তো কিছু করতে পারলাম না। তবু যদি এই দুঃখের পৃথিবীতে কয়েকটা মানুষের মুখে কখনও একটু হাসি এনে দিতে পারি , সেটাই বা কম কী! মনেও খানিকটা তৃপ্তি পাই।’
উত্তরপ্রদেশের মেয়ে বলে হিন্দি ভাষায় অনায়াস দক্ষতা ছিল রাজলক্ষ্মী দেবীর। নিউ থিয়েটার্স তখন বাংলার পাশাপাশি হিন্দি ছবিও প্রযোজনা করত। বাংলা থেকে যেসব ছবি হিন্দি ভার্সনে রূপান্তরিত হতো, তাতে অনেক সময়ই আর্টিস্ট বদলে যেত। কিন্তু রাজলক্ষ্মী দেবীকে বদলানো হতো না। তিনি নিজ চরিত্রেই বিরাজমান থাকতেন। ১৯৩৮ সালে নিউ থিয়েটার্স ‘অভিজ্ঞান’ নামে একটা ছবি প্রযোজনা করেছিল। নায়িকার শাশুড়ির চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন রাজলক্ষ্মী দেবী। জীবন গাঙ্গুলি, মলিনা দেবীরাও এই ছবিতে অভিনয় করেছিলেন। পরিচালনা করেছিলেন প্রফুল্ল রায়। যখন হিন্দিতে ছবিটা হল, তখন নাম হল ‘অভাগীন’। বেশিরভাগ আর্টিস্টই বদলে গেল, কিন্তু রাজলক্ষ্মী রইলেন সেই একই চরিত্রে। আর সব থেকে মজার কথা, হিন্দি ভার্সনে যেন বাংলার থেকেও ভালো অভিনয় করেছিলেন তিনি।
(ক্রমশ)