সন্তানের বিদ্যাশিক্ষায় নজর দেওয়া প্রয়োজন। অতিরিক্ত পরিশ্রমে শরীরে অবনতি। নানাভাবে অর্থ অপচয়। কর্মপরিবর্তনের সম্ভাবনা বৃদ্ধি।প্রতিকার: ... বিশদ
একটা আকস্মিক পথ দুর্ঘটনা যেমন কেড়ে নিয়েছিল প্রবাদপ্রতিম অভিনেতা ছবি বিশ্বাসকে, তেমনই সেই সময়ের আর এক শক্তিশালী অভিনেত্রীকেও হারাতে হয়েছিল গাড়ি দুর্ঘটনায়। তাঁর নাম রাজলক্ষ্মী দেবী। যদিও গাড়ি অ্যাক্সিডেন্টের সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর মৃত্যু হয়নি। সে ঘটনায় পরে আসব। দাপুটে অভিনেত্রী হয়েও রাজলক্ষ্মী দেবীর রৌদ্রোজ্জ্বল কীর্তি সবসময় যেন মেঘে ঢাকা থাকত। জীবনে বড় বা ছোট কোনও পুরস্কার তো তিনি পানইনি। এমনকী, প্রচুর নামী-অনামী শিল্পী নানা সময়ে বিএফজেএ (বেঙ্গল ফিল্ম জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন) পুরস্কার পেয়েছেন। রাজলক্ষ্মীর জীবনে সেটুকু সম্মানও জোটেনি। অথচ তাঁর নামের পাশে বন্ধনীর মধ্যে চিরকাল শোভা পেয়েছে ‘বড়’ শব্দটি। অভিনয় প্রতিভায় আক্ষরিক অর্থে ‘বড়’ তিনি ছিলেনই। কিন্তু তাঁর অভিনয় ক্ষমতাকে বোঝানোর জন্য বড় শব্দটির উৎপত্তি হয়নি। রাজলক্ষ্মী নামে সেই সময় আরও একজন অভিনেত্রী ছিলেন। এই রাজলক্ষ্মী দেবী ছিলেন তাঁর থেকে বয়সে বড়। দু’জনের মধ্যে তফাত করতেই তাঁর নামের পাশে বড় শব্দটির উল্লেখ থাকত।
রাজলক্ষ্মী দেবীর জন্ম ঠিক কত সালে, তা নিয়ে মতভেদ আছে। পরবর্তীকালে তাঁর বসবাস ও কর্মস্থান কলকাতা হলেও রাজলক্ষ্মীর জন্ম কলকাতা থেকে বহুদূরে, উত্তরপ্রদেশের মিরাটে। সম্ভবত ১৯০২ সালে। রাজলক্ষ্মী নিজে অবশ্য ঘনিষ্ঠ মহলে বলতেন যে, তাঁর জন্ম ১৯০০ সালে। যদিও তার স্বপক্ষে কোনও স্পষ্ট যুক্তি ছিল না। আর এই জন্ম সাল নিয়ে তাঁর একটা আক্ষেপও ছিল। যেহেতু তিনি মনে করতেন তাঁর জন্মসাল ১৯০০, তাই স্বাভাবিকভাবেই তিনি ছিলেন বিংশ শতাব্দীর মানুষ। তাঁর আক্ষেপ ছিল, মাত্র ১ বছরের জন্য তিনি ঊনবিংশ শতাব্দীর মানুষ হতে পারেননি। আক্ষেপের কারণটা শুনবেন! একটা বছর আগে জন্মালে তিনি বিদ্যাসাগর, রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মের শতাব্দীর জাতক হয়ে যেতেন। তিনি মজা করে বলতেন, বিংশ শতাব্দীতে বেশিরভাগই ট্যাঁরা-ব্যাকা মানুষ জন্মেছেন। এ যুগে ভালো মানুষের সংখ্যা নেহাতই কম। তাই এক বছরের ব্যবধানে জন্মানোটা তাঁর কাছে বড়ই দুঃখের ছিল।
রাজলক্ষ্মী দেবী অভিনয়ে এসেছিলেন একটু বেশি বয়সে। তিনি গান জানতেন, নাচও জানতেন। অভিনয় জগতে আসার আগেই তিনি এই দুটি জিনিস ভালো করে রপ্ত করে নিয়েছিলেন। সে যুগের অন্যান্য অভিনেত্রীদের মতো তাঁর অভিনয় জীবনও শুরু হয়েছিল রঙ্গমঞ্চে। সেটা ১৯৩০ সাল। রাজলক্ষ্মীর নিজের হিসেবেও তাঁর বয়স তখন তিরিশ বছর। স্টার থিয়েটারে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘গৃহপ্রবেশ’ নাটকে রাজলক্ষ্মীর প্রথম অভিনয়। আর্ট থিয়েটার নামে একদল সংস্কৃতিমনস্ক মানুষ তখন স্টার থিয়েটার পরিচালনা করতেন। সেই সময় ‘মীরকাশিম’, ‘কর্ণার্জুন’ প্রভৃতি জনপ্রিয় নাটকের রমরমা। তার মধ্যে রবীন্দ্রনাথের নাটক মঞ্চস্থ করার পরিকল্পনা শুধু ব্যতিক্রমী সিদ্ধান্ত নয়, সাহসিকতার পরিচয়ও বটে।
সেই সাহসিকতার পরিচয় দিয়ে ‘গৃহপ্রবেশ’ নাটকে রাজলক্ষ্মী আবির্ভূত হলেন ভিখারিণীর চরিত্রে। এই চরিত্রে গান ছিল। নাচ-গানের সঙ্গে অভিনয়টাও যে তিনি জানেন প্রথম আবির্ভাবেই তার প্রমাণ দিলেন রাজলক্ষ্মী। সে যুগে মহিলা শিল্পীদের গান জানা আবশ্যিক ছিল। রাজলক্ষ্মীও সেই যোগ্যতাতেই সুযোগ পেয়েছিলেন ‘গৃহপ্রবেশ’ নাটকে। তাঁর গানের গলাটিও ছিল চমৎকার। গানের পাশাপাশি অভিনয়ও তাঁর এতটাই ভালো হল যে তারপর থেকে তিনি অভিনয়ের যোগ্যতাতেই ডাক পেতে লাগলেন। সেই শুরু। পরবর্তী ২০-২২ বছরে তিনি অসংখ্য নাটকে অভিনয় করেছেন। ‘শর্মিষ্ঠা’, ‘মহানিশা’, ‘চিরকুমার সভা’ ‘স্বামী-স্ত্রী’, ‘প্রতাপাদিত্য’, ‘সাজাহান’, ‘রিহার্সাল’, ‘সংগ্রাম ও শান্তি’, ‘দুই পুরুষ’ তালিকাটা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর। বহু নাটকে অভিনয়-নাচে-গানে দর্শকদের মাত করে দিতেন তিনি। তাঁর স্মরণশক্তিও ছিল অসাধারণ। অনেক আগে অভিনয় করা বিভিন্ন চরিত্রের সংলাপ তিনি বৃদ্ধ বয়সেও নির্ভুল আউড়ে যেতেন।
এই নাটক করতে করতেই ঊনবিংশ শতাব্দীতে না জন্মানোর আক্ষেপ কিছুটা হলেও মিটেছিল রাজলক্ষ্মীর। ‘গৃহপ্রবেশ’-এর পর তিনি রবীন্দ্রনাথের আরও নাটকে অভিনয় করেছেন। নাট্যনিকেতন মঞ্চে (পরবর্তীকালে বিশ্বরূপা) ‘গোরা’ নাটকে গোরার মা আনন্দময়ীর চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন তিনি। সেই নাটকে রাজলক্ষ্মীর একক কণ্ঠে কোনও গান ছিল না। সবই সমবেত সঙ্গীত। নাটকটিতে তাঁর অভিনয় স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের প্রশংসা আদায় করে নিয়েছিল। রাজলক্ষ্মী অবশ্য রবীন্দ্রনাথের মুখ থেকে সরাসরি এই প্রশংসাবাণী শুনতে পাননি। অন্য লোক মারফত কবিগুরুর আশীর্বাদ তাঁর কাছে এসে পৌঁছেছিল। আর এতে তিনি এতটাই খুশি হয়েছিলেন যে, আগের শতাব্দীতে না জন্মানোর দুঃখে অনেকটাই প্রলেপ পড়েছিল।
তাঁর কাহিনিতে শুধু অভিনয় করেছিলেন বলেই নয়, রবীন্দ্র অনুরাগী বলতে যা বোঝায় রাজলক্ষ্মী ছিলেন তেমনই। লেখাপড়ায় প্রচণ্ড আগ্রহ থাকলেও বেশি দূর পর্যন্ত পড়াশোনা করা হয়ে ওঠেনি তাঁর। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের বহু লেখা তিনি পড়েছেন। সব ধরনের লেখা খুঁজে খুঁজে পড়তেন। আসলে যতটা সম্ভব বিভিন্ন বই পড়ে জ্ঞানার্জনের চেষ্টা করতেন। প্রথাগত শিক্ষায় শিক্ষিত না হতে পারার একটা দুঃখ তাঁর ছিলই। সেই দুর্বলতা এইভাবে কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করতেন প্রতিনিয়ত।