আবেগের বশে কোনও কাজ না করাই ভালো। দাম্পত্য জীবনে বনিবনার অভাবে সংসারে অশান্তি বাড়বে। কর্মে ... বিশদ
নিস্তব্ধ নির্জন ঘর, দেবতা বিশ্রাম করছেন খাটে। ঘরের এককোণে চুপ করে বসে আছেন মতিলাল। প্রদীপটা তখনও মিটমিট করে জ্বলছে। সময় যেন আর কাটতেই চাইছে না। মাঝে একটু তন্দ্রাচ্ছন্ন মতো হয়ে পড়েছিলেন মতিলাল। সেই রেশ কাটাতে তিনি ঘরের ভেতর পায়চারি করতে শুরু করলেন। রাত যে বেশ গভীর হয়েছে তা বোঝা যাচ্ছে। কাশী ক্রমশ শান্ত হচ্ছে। লোক চলাচল অনেকক্ষণ আগেই বন্ধ হয়ে গিয়েছে। মতিলাল পায়চারি বন্ধ করে ফিরে এলেন নির্দিষ্ট আসনে। দুই হাঁটুর ওপর চিবুকটা স্থাপন করে তিনি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে শুরু করলেন— কী ঘটে তা দেখার জন্য!
হাতে ঘড়ি নেই , ফলে কটা বেজেছে তা বোঝারও কোনও উপায় নেই। হঠাৎ মতিলাল দেখলেন ঘরে তিনি আর একা নন। এক বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ কোথা থেকে প্রবেশ করেছেন ঘরের ভিতরে এবং তিনি তাঁর দিকে দৃকপাত না করে এগিয়ে গেলেন দেবতার খাটের দিকে।
ভদ্রলোকের বয়স সত্তর-পঁচাত্তর তো হবেই। পরনে গরদের ধুতি, গায়ে নামাবলি। চুলগুলো ছোট ছোট করে কাটা। লম্বা একটা শিখা ঝুলছে মাথার পেছন দিকে। সেটি কাঁধ স্পর্শ করেছে। ধবধবে সাদা দীর্ঘ উপবীত তাঁর কোমর ছুঁয়ে ঝুলছে।
বৃদ্ধ মানুষটি এরপর দেবতাকে তাঁর শয্যা থেকে তুলে নিয়ে এসে স্থাপন করলেন তাম্রকুণ্ডে। আসন পাতলেন, কোষাকুষি নামিয়ে এনে রাখলেন দেবতার সামনে। গঙ্গাজলের ঘটি থেকে জল ঢাললেন কোষাতে। ঘষে নিলেন চন্দন। আসনশুদ্ধি ও আচমন করে শুরু হল তাঁর পুজো। সে এক দীর্ঘ পুজো। বেশ অনেকক্ষণ বাদে একসময় বৃদ্ধ উঠে দাঁড়ালেন। পঞ্চপ্রদীপ জ্বালিয়ে শুরু হল আরতি। ঘণ্টার আওয়াজে ঘর তখন মুখরিত। পুজো শেষ করে বৃদ্ধ সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করলেন দেবতাকে। তারপর বাতাসে মিলিয়ে গেলেন। দেবতা কিন্তু তাঁর শয্যায় আর ফিরে গেলেন না। বৃদ্ধ তাঁকে তাম্রকুণ্ডে রেখেই অদৃশ্য হয়েছেন।
এতক্ষণে ভয়ে নিজের জায়গায় চুপ করে বসেছিলেন মতিলাল। আস্তে আস্তে তিনি দরজার সামনে এসে তালা খুলতে বললেন। ঘণ্টার আওয়াজ শুনেই পরিবারের সবাই তখন ঠাকুরঘরের সামনে এসে দাঁড়িয়ে আছেন। বাড়ির গৃহকর্তা দরজা খুলে দেওয়া মাত্রই বাইরে বেরিয়ে এলেন মতিলাল।
ভদ্রলোক মতিলালের কাছে জানতে চাইলেন, ঘরের ভেতরে আপনি কী দেখলেন? কে পুজো করছিলেন দেবতাকে।
মতিলাল বললেন, এক বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ দেবতার পুজো করছিলেন। তারপর তিনি সেই বৃদ্ধের চেহারার বর্ণনা দিলেন।
মতিলালের মুখে ব্রাহ্মণের চেহারার বর্ণনা শুনে পরিবারের সবাই চমকে উঠলেন। ভদ্রলোক বললেন, এইরকম চেহারা!
মতিলাল বললেন, হ্যাঁ।
ভদ্রলোক বললেন, আপনি আজ যাঁকে পুজো করতে দেখলেন তিনি আমার স্বর্গত পিতা। কিন্তু তিনি কেন রোজ পুজো করতে এত রাতে আসেন!
মতিলাল বললেন, আজ আমার সাহস হয়নি তাঁকে এ কথা জিজ্ঞাসা করার। তবে ঘরে ঢুকে তিনি আমার দিকে একবারও তাকাননি। আমাদের কোনও ক্ষতি করার ইচ্ছা যে তাঁর নেই তা খুব ভালোভাবেই বুঝেছি। আপনার এই প্রশ্নের উত্তর আপনাকে আমি কাল রাতে দেবো। আজ অনেক রাত হয়ে গিয়েছে। আমি যেখানে আছি সেই জায়গাটার দূরত্ব এখান থেকে অনেকটা। আজ রাতে আপনার বাড়িতেই আমাকে থাকতে হবে।
ভদ্রলোকের নির্দেশে বাড়ির একটি ঘরে মতিলালের থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন ওই পরিবারের সদস্যরা। পরদিন খুব ভোরেই ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা করে মতিলাল বললেন, আজ সন্ধের সময় আবার আমি আপনাদের বাড়িতে আসব। আমি আসার পরেই আপনি পুজো শুরু করবেন।
সারাটা দিন মতিলাল ঘুরে বেড়ালেন কাশীর এ মাথা থেকে ও মাথা। গেলেন কাশীর সচল বিশ্বনাথ ত্রৈলঙ্গ স্বামীজির আশ্রমে।
সন্ধ্যার সময় মণিকর্ণিকায় ডুব দিয়ে পরিষ্কার শুদ্ধ বস্ত্র পরে চলে এলেন ভদ্রলোকের বাড়িতে। মতিলালকে দেখেই তিনি বললেন, আমি এইমাত্র চা খেলাম। আপনি খেলে আমিও আর এক কাপ খেতে পারি।
গম্ভীরভাবে মতিলাল বললেন, এখন আমার চায়ের প্রয়োজন নেই। চলুন পুজোর ঘরে।
দুজনে মিলে প্রবেশ করলেন পুজোর ঘরে। যথারীতি পুজো শেষ করে ভদ্রলোক দেবতাকে শয়ন করিয়ে দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। সেই ঘরে তখন ঘুমন্ত দেবতার সঙ্গে একা রয়ে গেলেন মতিলাল।
ঠিক বারোটার সময় ঘরে আর্বিভূত হলেন সেই বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ। আজ মতিলাল যথেষ্ট সাহসী। তিনি মুখোমুখি হলেন বৃদ্ধের। বললেন, আজকের পুজোটা কী আমি করতে পারি।
বৃদ্ধ বললেন, করো, কেমন করতে পার দেখি!
গতকাল বৃদ্ধ যেভাবে পুজো করেছিলেন ঠিক সেইভাবেই পুজো সাঙ্গ করলেন মতিলাল। তারপর সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করলেন দেবতাকে।
পুজো সমাপ্ত করে মতিলাল বৃদ্ধকে বললেন, আপনার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে।
বৃদ্ধ বললেন, বলো।
মতিলাল বললেন, এত কষ্ট করে রোজ রাতে আপনি কেন এই ইহলোকে ফিরে আসেন!
উত্তরে বৃদ্ধ বললেন, সাধে কী আসি বাবা! তুমি আজ সারাদিন জলস্পর্শ করনি শুদ্ধভাবে দেবতার পুজো করবে বলে। কী সুন্দর পুজো করলে! কিন্তু আমার কুলাঙ্গার পুত্রটা অনাচারী। আজকে সন্ধ্যাতেও চা খেয়ে অশুদ্ধ ভাবে দেবতার পুজো করল। এ আমি সইতে পারি না। আমার এক পূর্বপুরুষ স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে এই দেবতাকে লাভ করেছিলেন। দেবতা আমাদের পরিবারের রক্ষক। তাঁকে অশ্রদ্ধা করছে আমার পুত্র। ও এটা কী পুজো করে? এটা ভড়ং। ওকে বলে দিও এই দেবতাকে গঙ্গায় বিসর্জন দিয়ে আসতে । তারপর তার ফল ও হাতেনাতে পাবে। ওরা আমার বংশধর, ওদের ক্ষতি হোক তা আমি চাই না। তাই রোজ রাতে আমি দেবতাকে পুজো করতে আসি। প্রথমদিকে ওরা আমার ঘণ্টার আওয়াজ পেত না। কিন্তু সকালে এই ঘরে ঢুকেও এদের মনে কোনও প্রশ্ন জাগেনি— কেন দেবতা শয্যা ত্যাগ করে নেমে আসেন তাম্রকুণ্ডে। তারপর ঘণ্টার আওয়াজ যাতে ওরা শুনতে পায় আমি তার ব্যবস্থাও করলাম। তাতেও ওদের টনক নড়ল না।
মতিলাল বললেন, আমি আপনার পুত্রকে আপনার সব কথা জানাব।
বৃদ্ধ বললেন, দেখো কথা বলে! তবে আমার এখানে আসতে সত্যি কষ্ট হয়।
মতিলাল ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসছেন, বৃদ্ধ বসে আছেন ভূমিতে। তিনি বললেন, বাবা দাঁড়াও, তোমার বন্ধুকে একটা ছোট্ট কথা আমার হয়ে জানিও। গয়ায় গিয়ে পিতার পিণ্ডদান করাটা কী খুব কষ্টকর! যদি সম্ভব হয় সেটা যেন করে আসে।
মতিলাল চট্টোপাধ্যায় ঘরের বাইরে এসে ব্রাহ্মণ পুত্রকে তাঁর পিতার অনুযোগের কথা জানালেন।
পুত্র কথা দিলেন, আর হবে না এরকম। শুদ্ধভাবে দেবতার পুজো আমি করব। আর গয়ায় গিয়ে পিতার পিণ্ডও দিয়ে আসব।
তারপর থেকে রাত বারোটায় ওই বাড়ির তালা বন্ধ ঠাকুর ঘরে আর কোনওদিন ঘণ্টা বাজেনি।
(ক্রমশ)