আবেগের বশে কোনও কাজ না করাই ভালো। দাম্পত্য জীবনে বনিবনার অভাবে সংসারে অশান্তি বাড়বে। কর্মে ... বিশদ
কে বলছ? বীরেন জিজ্ঞেস করে।
দাদা, আমি অনুপ।
কোন অনুপ?
গলার স্বরে বুঝতে পারছ না, বেলঘরিয়ার অনুপ।
ও, মিত্রা সিনেমার অনুপ? বীরেন চিনতে পারে।
সিনেমা কতদিন আগে ছেড়েছি, তুমি এখন কোথায়?
আমি রূপলেখায়, বইয়ের কাজ।
বইয়ের কাজ ভালো? অনুপ জিজ্ঞেস করে।
ভালো তো, তুই এখন কোথায়?
অনুপ বলল, হল বন্ধ হওয়ার অনেক আগে বরিশাল ক্লথ স্টোরে ঢুকেছিলাম।
কাপড়ের কাজ জানিস?
জানতাম, আমি আগে তো বেলঘরিয়ায় ওই কাজই করতাম, বাজার আগুন লেগে পুড়ে গেলে আমাকে মিত্রা সিনেমায় ঢুকিয়ে দিয়েছিল কাউন্সিলারের ভাই।
হুঁ, আজ কি ছুটি?
পয়লা বৈশাখের চাপ গেল পরশু, কদিন একটু হাল্কা, তুমি?
বীরেন বলল, আমার এখন অফ সিজিন শুরু বলতে পারিস, যা চাপ সব শীতকালে, লাস্ট বইমেলা গেল গড়বেতায়।
অনুপ বলে, আমাদের আবার আরম্ভ হবে, কাপড়ের দোকানে অফ সিজিন নেই বলা যায়, ক’দিন বাদে ঈদের বাজার লাগবে, ঈদ যেতে যেতে পুজোর বাজার।
মিত্রা বন্ধ হওয়ার আগে ছেড়েছিলি? বীরেন জিজ্ঞেস করে।
হুঁ, বুঝতে পারছিলাম নতুন মালিক হল রাখবে না।
তুই বইয়ের লাইনে আসবি?
বুঝতে পারছি না, এখানে কাজ করাবে কিন্তু বেতন দিতে হাত খোলে না, খাটনি খুব।
বীরেন জিজ্ঞেস করল, চাপের সময় এক্সট্রা পাস?
পয়লা বৈশাখে টাকা দেয় না, শাড়ি কিংবা পাঞ্জাবি, হাজার টাকার ভিতরে যা হয়, শুধু পুজোয় দেয়।
চুপ করে থাকে বীরেন। কী কথা বলবে বুঝে উঠতে পারছে না। অনুপের সঙ্গে তার কাজ হয়েছিল মিত্রা সিনেমায়। সে কম দিন হল না। অনুপ লাইটম্যান। বীরেন কাউন্টারে। খুব কম মাইনে। তার পোষায়নি। পাড়ার একজনের হাত ধরে ক’দিন বাদেই কলেজ স্ট্রিট পাড়ায় শ্রীমা পাবলিশার্সে ঢুকল, এখন রূপলেখায়। বইয়ের কাজ খুব কঠিন না, কিন্তু সব কাজেরই একটা ধরণ আছে। খবর রাখতে হয় বেশি। রূপলেখার সব বইয়ের খোঁজ না রাখলে সে মেলায় মেলায় ঘুরবে কী করে? শীতের সময় ঘুরতে হয় জেলায় জেলায়। বইমেলায়। আবার কোন বইয়ের বিষয় কী, তাও জানতে হয়। জানলে খরিদ্দারকে বলা যায়। বইয়ে বীরেনের আগ্রহ অনেক দিনের। লাইব্রেরি থেকে বই এনে পড়াও ছিল তার অভ্যেস। সুতরাং কাজটা বেশ মনে ধরেছে। তবে বেতন কম। ছোট সংসার, চলে যায়। মেয়ের বিয়ে হয়েছে শ্রীমার কর্মচারীর সঙ্গে। তাই তার রূপলেখায় আসা। এক জায়গায় শ্বশুর-জামাই থাকা ঠিক না।
অনুপ বলল, বীরেনদা, বলাইয়ের খবর জানো?
জানি। বীরেন স্তিমিত স্বরে বলল।
কোম্পানি ওকে ছাড়িয়ে দিয়েছে?
ও যায়নি অনেকদিন, কাজ থাকে কী করে? বীরেন বলল।
ওর তো বড় অসুখ। অনুপ বলল।
তুই কি গিয়েছিলি?
ও থাকে না তো বাগমারিতে। বলল অনুপ।
দেশে ফিরে গেছে।
দেশ তো গড়বেতা।
হ্যাঁ, আমার কাছে এসেছিল। বীরেন কথা বানাতে থাকে।
রূপলেখায় ?
না, বীরেন বলল, গড়বেতা বইমেলায়।
ফোন নম্বর আছে?
বীরেন বলল, আমার ডায়েরিতে লেখা আছে, ডায়েরি বাড়িতে। ও কি কাজের জন্য এসেছিল ?
না, তা আসেনি।
বীরেন গড়বেতা গিয়েছিল মেলা করতে। সেখানেই দেখা। কলকাতা ছেড়ে বলাই দেশে ফিরে গেছে। কবরেজি চিকিৎসা করছে। ব্যথা নেই এখন। তবে কঙ্কালসার চেহারা। দেখেই বোঝা যায় যে কোনও দিন মরে যাবে। বীরেন এসব বলল না। বলল, কাজ দেশেই করছে। বীরেন ওর ভাইয়ের সঙ্গে গণগণির ডাঙা দেখতে গিয়েছিল। শিলাবতী নদীর ধারে লাল মাটির ভাঙন দেখে মনে হয়েছিল বড় বিস্ফোরণ হয়ে গেছে ওখানে। বলাইয়ের রোগটার সঙ্গে খুব মিল। বলাইয়ের ভাই কানাই খুব সার্ভিস দিয়েছিল তাকে। কানাই তার খিদমত খেটেছে ক’দিন। যদি একটা কাজ পায়। বইয়ের কাজ। তার দাদা করত ঢালাই কারখানার কাজ। অসুখটা ওখান থেকে এসেছে মনে হয়।
ভালো আছে? জিজ্ঞেস করে অনুপ।
আছে, দেশে ওদের অনেক সম্পত্তি, আমাকে গণগণির ডাঙায় নিয়ে গেল, নেমতন্ন করল।
তাহলে কেন কলকাতায় কাজ করতে এসেছিল?
এমনি, গাঁয়ে কেউ থাকতে চায়, কলকাতায় আসতে চায় সকলে। বীরেন বলল।
অনুপ বলল, আমাদের হাসনাবাদে কিছু নেই, আমার হাসনাবাদ ফিরে যাওয়া হবে না।
বীরেন বলল, একদিন আয়, এখন দুপুরে চাপ নেই, ফোনে এত কথা হয় না।
যাব বীরেনদা, বলছি অসীমের খোঁজ জান ?
অসীম মিদ্দে?
হ্যাঁ, মিদ্দে অসীম।
বীরেন ভাবল বলে, মিদ্দে অসীম বেঁচে নেই। আচমকা বুক চেপে বসে পড়েছিল এই বিধান সরণিতে। সঙ্গে ছিল ঢাউস বইয়ের ব্যাগ। খুব ভার। হার্ট অ্যাটাক। সময় দেয়নি। আড়াই-তিন মাইল দূরে বসেও তা জানে না অনুপ। খবর যায়নি। বীরেন বলল, শুনেছি আরামবাগ চলে গেছে।
দেশের বাড়ি?
আরামবাগে দেশের বাড়ি কি না জানে না বীরেন। মনে হল, তাই বলে দিল। অসীমের হার্ট ভালো ছিল না। ভার নিতে কষ্ট হতো। দম বন্ধ হয়ে আসত। সেই কথা জিজ্ঞেস করল অনুপ, ভালো আছে কি না। হ্যাঁ, ভালো আছে, এক সাধুর দেওয়া শিকড়-বাকড়ে ভালো হয়ে গিয়েছিল। আরামবাগে বইয়ের দোকান করেছে। স্কুল বই ছাড়া, গল্পের বইও রাখে। নিজেই বই ছাপবে বলছে। প্রকাশক হয়ে যাবে। শুনে অনুপ বলল, ও পারবে ঠিক, কলকাতায় আসে?
আসে, এলেই রূপলেখায় আসে।
ফোন নম্বর আছে? অনুপ জিজ্ঞেস করল।
বীরেন সেই একই কথা বলল। নম্বর ডায়েরিতে। ডায়েরি বাড়িতে। অনুপ চুপ করে থাকে। বীরেন বলল, রাখি, আমার বইয়ের অর্ডার সাপ্লাই করতে যেতে হবে।
২
অনুপের মনে হয় চাকরিটা ছেড়ে দেয়। বরিশাল ক্লথ স্টোরে ঢুকেছিল। তা এখন হয়ে গেছে জয়পুর ক্লথ স্টোর। হাত বদল হয়ে মালিক এখন গগন শর্মা। শর্মা বলেছে, অনুপের না পোষালে ছেড়ে দিতে পারে। তার কোনও ছুটি নেই। সাতদিন আসতে হবে। তবে সানডে বেলা তিনটে থেকে। সপ্তাহে এক বেলা করে ছুটি। শর্মা তুই-তোকারি করে। খুব চাপে রাখে। টার্গেট দিয়ে দেয়। ফুলফিল করতেই হবে। না পারলে ছেড়ে দে। একজনের কাজ গেছে এর ভিতরে। অনুপ পরের দিন রূপলেখায় ফোন করতে বীরেন বলল, ব্যস্ত আছি, পরে করিস।
তুমি রোববার ফ্রি আছ ?
রোববার চন্দননগর যাব।
অনুপ বলল, আমার জন্য একটা কাজ দেখো বীরেনদা।
বীরেন বলল, তুই কি আরামবাগ যেতে পারবি?
সে তো অনেক দূর, আমি থাকি গড়িয়া। অনুপ বলল।
তাহলে হয়তো একটা ব্যবস্থা হতো।
তোমার রূপলেখায় হবে না ?
বীরেন বলল, আমি চেষ্টা করছি নিজের ব্যবসা করতে, আয় এক সঙ্গে ব্যবসা করি।
ব্যবসা করব, কীসের ব্যবসা? অনুপ জিজ্ঞেস করে।
বইয়ের, তুই আয়, প্ল্যান করি।
দুদিন বাদে এল অনুপ। সত্যিই এল। বলল, গগন শর্মা তার চাকরি খেয়ে নেবে এবার। বলছে রোববার সকালে সোদপুরে ডিউটি দিতে। সেখানেও ক্লথ স্টোর আছে। সকালে খোলা, বিকেলে বন্ধ। শ্যামবাজারে বিকেলে খোলা সকালে বন্ধ। সম্ভব না। খাটিয়ে মেরে দেবে। অনুপের চোখমুখ বসে গেছে। বীরেনের রূপলেখায় এখন কদিন ঝিমুনি চলছে। মালিক দোকানেই থাকে। মালিক তারই মতো কর্মচারী ছিল। বই নিয়ে অসম, ত্রিপুরা, দিল্লি, কানপুর ঘুরে বেড়াত। বই বেচেই ফিরত। ঘুরতে ঘুরতে বইয়ের বাজার বুঝে গিয়েছিল। তারপর নিজেই রূপলেখা গড়ে তুলে বই ছাপছে। বীরেন বলল, সে ওই রকম কিছু করতে চায়।
হবে বলছ ?
হবে। বলল বীরেন, আমি বই লিখব।
তুমি লিখবে, লেখা বললেই কি লেখা যায়?
বীরেন বলল, সে বহুদিন ধরে লেখে। তার পাণ্ডুলিপি তৈরি। রূপলেখা ছাপতে চায়। সে রাজি নয়। নিজেই বের করতে চায়। লাভ নিজের কাছেই রাখতে চায়। অনুপ চুপ করে থাকে। বুঝতে পারে না কী বলবে? বীরেন কুণ্ডুর লেখা কেন লোকে পড়বে? বড় লেখকের লেখা ছাপলে তবে হতে পারে। তার মনের কথা যেন পড়ে নিয়েছে বীরেন, বলল, বই বেচার দায়িত্ব তার। সে জানে কীভাবে বেচতে হয় বই। দরকারে সে রবীন্দ্রনাথের নামে ছেপে দেবে তার লেখা।
বইয়ের নাম হবে যোগাযোগ। রবি ঠাকুরেরও যোগাযোগ আছে। তারপর টাকা উঠে গেলে সেই বই নিজের নামে। এমন হয় নাকি? হয়, একজনের লেখা শ্রীমা পাবলিশার্স ছেপেছিল, কুড়িটা গল্প। তার ভিতরে একটি বাদে সব গল্পই অন্য লেখকের। নাম বদল করে নিজের নামে ছেপেছিল লেখক। ধরা পড়ার আগে হাজার বই বিক্রি করে দিয়েছিল। এমন তো হয়। অনুপ বলল, বড় লেখকের বই ছাপলে কী হয়?
ছাপাই যায়। বীরেন বলল, কিন্তু নিজেদের বই ছাপাই ভালো, সবটাই আমাদের, বড় লেখকের বই পেতে টাকা খরচ করতে হবে, রয়্যালটি দিতে হবে।
অনুপ কী বলবে বুঝে উঠতে পারে না। সে বইয়ের কাজ জানে না। কাপড়ের কাজ, ভাঁজ খোলা আর বন্ধ করা খুব ভালো পারে। আর গুণমান বিচার করতে পারে। সে বলল, বই না, আমরা কাপড়ের ব্যবসা করতে পারি, ফুলিয়া, ধনেখালি থেকে কাপড় কিনে...
তাকে থামিয়ে দেয় বীরেন, বলল, বেচবি কীভাবে, ফেরি করে বেড়াবি, তুই কর গে যা।
অনুপ চলে গেল। অনুপ কী করবে বুঝে উঠতে পারছে না। বীরেন চায় হাজার পনেরো। ব্যবসা শুরু হয়ে যাবে। একসঙ্গে পাঁচখানি বই ধরবে। অনুপের বউ বলল, তোমার টাকায় নিজের বই ছেপে নেবে বীরেনদা, তুমি যেখানে করছ, কর।
একবেলাও ছুটি নেই। অনুপ ক্ষুব্ধ হয়ে বলল।
অনুপের বউ তন্দ্রা বলল, ছুটি কারও নেই, ব্যবসা করলে আরও নেই, শনি রবি সোম মঙ্গল সব এক।
তখন অনুপ বলল, তার ছুটি ভালো লাগে। ছুটির দিনে ঘুমতে ভালো লাগে। ছুটির দিনে গঙ্গার ধারে বেড়াতে যেতে ভালো লাগে। সে বলল, আমি পারব না, আমার ছুটি চাই।
কেন?
আমার ছুটির দিনে শুয়ে পা দোলাতে ভালো লাগে, গগন শর্মার চাকরি যায় যাক।
তন্দ্রা একটা কাজ করে। প্রাইমারি ইস্কুলের ডি-গ্রুপ কর্মচারী। বেতন পায় তার চেয়ে বেশি। আর তন্দ্রার ছুটি আছে। অনুপ পরের দিন আবার বীরেনকে ফোন করল। বীরেন বলল, তার বই সে প্রেসে পাঠাবে, অনুপ জিজ্ঞেস করল, তুমি কখন লেখ বীরেনদা ?
কেন রাত জেগে, লেখকরা তেমনিই লেখে।
সারারাত?
রাত দুটো-আড়াইটে। বীরেন কথা বানাতে ওস্তাদ।
তখন সব মনে আসে? অনুপ জিজ্ঞেস করে।
কী মনে আসবে?
যে গল্প লেখ? অনুপ বলল।
হ্যাঁ, সকলে আমার চেনা লোক তো। বীরেন বলল।
আমি যদি রাত জাগি?
কী করবি রাত জেগে? বীরেন জিজ্ঞেস করে।
অনুপ বলল, লিখব।
তুই কি লেখক যে লিখবি? বিরক্তির সঙ্গে বলল বীরেন।
তুমি যে লেখ তাও তো জানতাম না।
বীরেন বলল, তখন আমি লিখতাম গোপনে।
অনুপ বলল, আমিও লিখতাম গোপনে, অসীমও লিখত গোপনে, অসীমের সঙ্গে আমার যোগাযোগ হয়েছে বীরেনদা, অসীম বলেছে আমার বই ছাপবে, থিম শুনেছে, ঐতিহাসিক...
বীরেন চুপ করে গেল। বুক ধক ধক করতে লাগল। অনুপ কি তাহলে সত্যিই পারবে নিজের কথা আর স্বপ্নের একটা আকাশ এঁকে দিতে? বীরেন বলল, অসীমকে নিয়ে আমার কাছে আসিস, মনে থাকবে তো?
অলংকরণ : সুব্রত মাজী