উচ্চতর বিদ্যায় সাফল্য আসবে। প্রেম-ভালোবাসায় আগ্রহ বাড়বে। পুরনো বন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাতে আনন্দলাভ হবে। সম্ভাব্য ক্ষেত্রে ... বিশদ
এবার বলি দেবী ত্রিপুরমালিনীর কথা। পীঠ নির্ণয় তন্ত্রে আছে ‘ভীষণা ভৈরবস্তত্র দেবী ত্রিপুরমালিনী’। পাঞ্জাব প্রদেশে এই সতীপীঠ জলন্ধর পীঠ নামে খ্যাত। কিন্তু এই পীঠ সম্বন্ধে নানারকম বিভ্রান্তিকর তথ্য পাওয়ার কারণে এর সঠিক অবস্থান কিছুতেই নির্ণয় করতে পারিনি। অবশেষে কাশীর এক মাতাজির পরামর্শে আমি জলন্ধরে গিয়েই জলন্ধর পীঠের অনুসন্ধান করব এই স্থির করলাম। তাই একদিন বারাণসী থেকেই দুপুর বারোটা পঞ্চাশের বেগমপুরা এক্সপ্রেসে জলন্ধরের পথে রওনা হলাম।
ভাগ্যক্রমে এই ট্রেনে আমার সহযাত্রীদের মধ্যে পাঁচজন মহিলা বৈষ্ণোদেবী যাত্রী ছিলেন। আমি জলন্ধর পীঠ যাচ্ছি শুনে ওঁদেরই একজন বললেন, ‘জলন্ধর পীঠ দেবী কা মুখ্য পীঠ। লেকিন উধার যাকে দেবীতালাও বোলনা পড়েগি। তব মালুম হো যায়েগি সবকো।’
ব্যস। সেদিন এবং রাতটা বেশ ভালোভাবেই কাটল। পরদিন সকালে জলন্ধর ক্যান্ট থেকে সিটিতে এসে রওনা হলাম দেবী তালাওয়ের পথে। ভাড়া শেয়ারের অটোয় দশ টাকা।
এক বিশাল প্রাচীর ঘেরা অঞ্চলের মধ্যে দেবীতালাও বা জলন্ধর পীঠ। তোরণ পার হলেই প্রকট স্থানে পৌঁছনো যায়। প্রথমেই চোখে পড়ে দেবীতালাও। বিশাল একটি স্বচ্ছ জলের সরোবর। এখানে দেবীর বাম স্তন পতিত হয়েছিল। কালিকাপুরাণে আছে ‘জলন্ধরে স্তনযুগং স্বর্ণহার বিভূষিতম্’। দেবী এখানে ত্রিপুরমালিনী। যেখানে দেবীপীঠ সেখানেই ভৈরব। ভৈরবও তাই এখানে বিরাজমান। এই পীঠ হল ষষ্ঠ মহাপীঠ।
জলন্ধর মাহাত্ম্যে আছে, পুরাকালে জলন্ধর নামে এক দৈত্যের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে দেবতারা যুদ্ধ ঘোষণা করলে বহুবর্ষ ধরে দেব-দানবের এক তুমুল যুদ্ধ চলতে থাকে। ভগবান বিষ্ণু ও মহাদেবের কপট মায়ায় জলন্ধর যখন জর্জরিত, মরণাপন্ন, তখন দুই দেবতাই জলন্ধর পত্নী বৃন্দার অভিশাপের ভয়ে জলন্ধরকে প্রত্যক্ষ দর্শন দিয়ে বর প্রার্থনা করতে বললেন। জলন্ধর তখন করজোড়ে বলল, ‘হে সর্বশক্তিমান প্রভু, যদিও আপনারা আমায় কপট যুদ্ধে হত্যা করলেন তবুও আমাকে প্রত্যক্ষ দর্শন দেওয়ার ফলে আমার মতো তমোগুণসম্পন্ন ও অহংকারী একজন দৈত্য উদ্ধার প্রাপ্ত হল। তাই অন্তিমকালে আমার প্রার্থনা এই যে, যুদ্ধকালীন সময়ে আমার দেহের যে সমস্ত অংশ এই প্রদেশের বিভিন্নস্থানে পড়েছে সেই সমস্ত অঞ্চল যেন তীর্থের মহিমা পায়। বিভিন্ন দেবদেবীর মঠ মন্দির যেন গড়ে ওঠে এই স্থানকে ঘিরে। স্নান-তর্পণে দেবভক্তগণ যেন অশেষ পুণ্যফল প্রাপ্ত হন। শ্রীবিষ্ণু ও মহাদেব জলন্ধরের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করতে তথাস্তু বলে সেই বরই প্রদান করলেন। তখন থেকেই এই শিবালিক পর্বতমালার প্রদেশে দ্বাদশযোজন ক্ষেত্র জুড়ে চৌষট্টি মন্দির ও নানা তীর্থ গড়ে ওঠে। জলন্ধরের কান যেখানে পড়েছিল বর্তমানে সেই স্থানের নাম কাংড়া। এখানে বজ্রেশ্বরী দেবীর মন্দির আছে। আর জলন্ধরের পৃষ্ঠদেশ যেখানে পড়েছিল লম্বালম্বিভাবে সেই অংশ এবং আশপাশের জনপদ ‘জলন্ধর’ নামেই অভিহিত।
মন্দিরে প্রবেশ করলে প্রথমেই চোখে পড়ে প্রবেশ পথের ডানদিকে এক উন্নতমানের সুবিশাল ধর্মশালা।
যাই হোক, এবার মাতৃমন্দিরের পথে মন্দিরের পাশেই দৃষ্ট হয় উচ্চ বেদিকায় বাঁধানো এক বিশাল অশ্বত্থ গাছ। একে বলা হয় কল্পবৃক্ষ। ধর্মপ্রাণ নরনারীরা এই কল্পবৃক্ষতলে ধূপদীপ ইত্যাদি প্রজ্বলন করেন। অনেকের বিশ্বাস মন্দিরের বাইরে এই কল্পবৃক্ষেই দেবীর অবস্থান। দেবী এখানে সর্বক্ষণ বিরাজ করেন। কেন না এই বিশাল ভূখণ্ড হল জলন্ধরের মাথা। দেবীশক্তি না থাকলে মাথা নড়ে উঠবে। ফলে বিপর্যয় অবশ্যম্ভাবী। শুধু তাই নয় কেউ কোনও শুভকামনা নিয়ে এখানে মানত করলে তা বিফলে যায় না।
কল্পবৃক্ষে মাথা ছুঁইয়ে উচ্চ সোপান বেয়ে ওপরে উঠে এখানকার অধিষ্ঠাত্রী দেবী ত্রিপুরমালিনীকে দর্শন করলাম। আমার অনেক দিনের আশা পূর্ণ হল। দেবীর রম্যমূর্তি শ্বেতপাথরের। তাঁর দু’পাশে সিদ্ধিবিনায়ক গণেশ। এই দেবী এখানে বিশ্বমুখী নামেও পরিচিতা। জলন্ধরে বিশ্বমুখী, তারা কিষ্কিন্ধ্যা পর্বতে।
দেবীপীঠ দর্শনের পর মন্দির চত্বরেই দর্শন করলাম দেবীতালাওয়ের পাশে ভৈরবকে। শিবলিঙ্গ ছাড়াও এখানে রয়েছে পীতবর্ণের এক বিশাল ভৈরবমূর্তি। সচরাচর এমন মূর্তি চোখে পড়ে না।
এরপর এলাম এখানকার সিদ্ধসাধক হেমগিরি মহারাজের সমাধি মন্দির দেখতে। সমাধি মন্দির দর্শনের পর পরশুরাম মন্দির। তারও পরে বালাজি মন্দির। আরতির সময় এসেছিলাম। তাই বোঁদে ও অমৃতি প্রসাদ পাওয়া গেল।
এরপর এলাম অমরনাথের গুহায়। সারা ভারতের বহুতীর্থ আমি একাধিকবার দর্শন করলেও অমরনাথে আমি বারবার বাধাপ্রাপ্ত হয়ে যেতে পারিনি। এখন দুধের স্বাদ ঘোলে মেটালাম। এখানকার অমরনাথের গুহামন্দির অনেকটা উচ্চস্থানে। তবু দারুণ উৎসাহ নিয়ে সেখানে গিয়ে দর্শন করে ধন্য হলাম।
এই মন্দিরচত্বরে দেবীতালাওকে ঘিরে অনেক মন্দির আছে। আমি প্রায় সবকটিই দর্শন করে দেবীতলাওতে স্নান করে ধন্য হলাম।
মন্দিরের বাইরেও এই অঞ্চলের কাছে দূরে আরও অনেক মন্দির আছে। তবে আমি আর সে সবের দর্শন না করে বাসস্ট্যান্ডে এসে রওনা দিলাম অমৃতসরের পথে। সেখানে দুর্গিয়ানা মন্দির, স্বর্ণমন্দির ও জালিয়ানওয়ালাবাগ দেখে রাতের ট্রেনে রওনা হব হরিদ্বারের পথে। হর হর গঙ্গে। জয় মা গঙ্গে।
(ক্রমশ)
অলংকরণ : সোমনাথ পাল