উপস্থিত বুদ্ধি ও সময়োচিত সিদ্ধান্তে শত্রুদমন ও কর্মে সাফল্য। ব্যবসায় গোলযোগ। প্রিয়জনের শরীর-স্বাস্থ্যে অবনতি। উচ্চশিক্ষায় ... বিশদ
পরবর্তী ডাকেই শিশিরকুমার তাঁর প্রাণাধিক প্রিয় পুত্র পয়সকান্তির ছবি বন্ধুকে পাঠিয়ে দিলেন। সেই ছবির সঙ্গে তিনি একটা চিঠিও পাঠালেন। তিনি তাঁর বন্ধুকে লিখেছিলেন, আপনার কথামতো আমি ছবিটা পাঠালাম। আপনি এই ছবিটা বাইরের কাউকে দেখাবেন না। বিশেষ করে ব্যাঙ্কস ভগ্নীদ্বয়কে। তাঁদের ছবি আঁকা শেষ হলে আপনি আমার পুত্রের ছবির সঙ্গে তাঁদের আঁকা ছবিটা মিলিয়ে নেবেন। আশা করি আপনি আমার এই ছোট্ট অনুরোধটা রাখবেন।
ছবি হাতে পাওয়ার পর মহাত্মার বন্ধু তাঁর এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে সবকথা জানিয়ে বললেন, আগামী রবিবার তুমি কী ভাই আমার সঙ্গে ব্যাঙ্কস ভগ্নীদের বাড়িতে যাবে? সেই বন্ধুও এইসব ব্যাপারগুলিকে বুজরুকি বলে মনে করতেন। তিনি বললেন, রবিবার সকালে আমি তোমার জন্য কোনও কাজ রাখব না। আমি তোমার সঙ্গে যাব। আমরা দুজনে মিলে দুই বোনের সমস্ত ভন্ডামি, বুজরুকি ফাঁস করে দেব। তবে আমরা যে আগামী রবিবার যাব একথা তাঁদের আগে থেকে জানিও না। আমরা আচমকা তাঁদের বাড়িতে উপস্থিত হব।
মহাত্মার বিদেশি বন্ধু বললেন, ঠিক আছে আমরা আগাম কোনও খবর না দিয়েই আগামী রবিবার সকালে তাঁদের বাড়ি যাব। তুমি সকাল ন’টা নাগাদ আমার বাড়িতে চলে এসো। আমার বাড়ি থেকে খুব কাছেই তাঁদের বাড়ি। আমরা গল্প করতে করতে চলে যাব।
রবিবার দিন দু’জনে একসঙ্গে প্রাতঃরাশ সেরে রাস্তায় নামলেন। চমৎকার, মনোরম এক সকাল। মিনিট পনেরোর মধ্যে তাঁরা পৌঁছে গেলেন ব্যাঙ্কস পরিবারের বাড়িতে। সেদিন অবশ্য দুই বোনের একজনই বাড়িতে ছিলেন। যিনি বাড়িতে ছিলেন তিনিই দরজা খুলে তাঁদের কাছে আসার কারণটা জানতে চাইলেন। মহাত্মার বন্ধু বললেন, আমার ভারতবর্ষের এক বন্ধুর পুত্র সদ্য প্রয়াত হয়েছেন। তাঁর অনুরোধেই আজ আমরা আপনার বাড়িতে এসেছি। আমার ভারতীয় বন্ধুর খুব ইচ্ছা আপনারা দুই বোন মিলে তাঁর পুত্রের একটা ছবি এঁকে দেবেন। কারণ তাঁর কাছে সেই মৃত পুত্রের কোনও ছবি নেই।
মহিলা বললেন, আমার অপর বোন এখন বাড়িতে নেই। তাছাড়া আপনাদের আসতে আর কিছুক্ষণ দেরি হলে আমিও বিশেষ একটা কাজে বেরিয়ে যেতাম। আপনাদের উচিত ছিল একটা খবর দিয়ে আসা। তবে এসেই যখন পড়েছেন তখন আসুন আমিই ছবিটা এঁকে দেব।
মহাত্মার বন্ধু বললেন, শুনেছি আপনারা একসঙ্গে ছবি আঁকেন?
মহিলা মৃদু হেসে বললেন, কথা না বাড়িয়ে আপনারা আসুন আমার সঙ্গে।
ভদ্রমহিলা দুই বন্ধুকে নিয়ে একটা মাঝারি মাপের ঘরে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করে দিলেন। ঘরে গোটাতিনেক জানলা থাকলেও একটি বাদে সবগুলোই বন্ধ ছিল। দুই বন্ধুর দেখে মনে হয়েছিল বাকি দুটি জানলা বহুকাল খোলা হয়নি। তবে উন্মুক্ত জানলাটি দিয়ে চমৎকার রোদ খেলে বেড়াচ্ছিল ঘরের মধ্যে। আর সেই জানলার সামনে দাঁড় করান ছিল একটি ইজেল। ঘরে আসবাব বলতে ছিল একটি সোফা ও ছোট্ট একটা চৌকি। তার উচ্চতা খুব একটা বেশি নয়।
দুই বন্ধুকে সেই সোফায় বসতে অনুরোধ করে মহিলা বললেন, আমি কী আমার নিজস্ব ক্যানভাসে ছবি আঁকব, না আপনারা সঙ্গে ক্যানভাস এনেছেন!
মহাত্মার বন্ধু বললেন, আমরা সঙ্গে ক্যানভাস এনেছি, আপনি আমাদের ক্যানভাসেই ছবি আঁকবেন।
সঙ্গে আনা প্যাকেট থেকে ক্যানভাসটি বের করে মহিলার হাতে দেওয়া মাত্র তিনি সেটি ইজেলে চাপিয়ে বললেন, এবার আমি কাজ শুরু করব। মিনিট কুড়ি সময় লাগবে। আমি যখন কাজ করব, তখন আপনারা সোফা ছেড়ে একদম উঠবেন না বা কোনও কথাও বলবেন না। আর আমি যাঁর ছবি আঁকতে যাচ্ছি তাঁর নামটা আপনারা কী আমাকে জানাবেন!
মহাত্মার বন্ধু বললেন, মৃত ব্যক্তির নাম পয়সকান্তি ঘোষ। পিতার নাম শিশিরকুমার ঘোষ।
ভদ্রমহিলা বললেন ঠিক আছে। কিন্তু আমি যা বললাম তা দয়া করে মাথায় রাখবেন। কথা শেষ করেই তিনি ইজেলের উল্টোদিকে রাখা ছোট চৌকিটির ওপর পদ্মাসনে বসে ধ্যানস্থ হলেন। মিনিট দশেক এইভাবে কাটার পর মহিলা হঠাৎই অস্ফুট স্বরে কথা বলতে শুরু করলেন— আমি এক যুবককে দেখতে পাচ্ছি, বয়স পঁচিশ বা ছাব্বিশ, তার বেশি নয়। এরপর তিনি অদেখা মৃত যুবকের হুবহু চেহারার বর্ণনা দিতে শুরু করলেন।
মহিলার কথা শুনে চমকে উঠেছিলেন শিশিরকুমারের বন্ধু। কারণ তিনি পয়সকান্তির ছবি আগেই দেখেছেন। মহিলা যে পয়সকান্তির কথাই বলছেন তা বুঝতে তাঁর এতটুকু দেরি হল না। তিনি খুব বিস্মিত হলেও মহিলার কথামতো সোফায় চুপ করে বসে রইলেন।
বর্ণনা শেষ করেই ভদ্রমহিলা আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে ধীর পদক্ষেপে এসে দাঁড়ালেন ক্যানভাসের সামনে। খুব ক্লান্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,ওই যুবক যখন পৃথিবীতে আমাদের মাঝে ছিলেন তখনকার ছবি আঁকব, না এখন যেখানে তিনি আছেন সেই ছবি!
মহাত্মার বন্ধু কথাটা শুনে বেশ অবাক হলেন। তিনি বললেন, না, আপনি জীবিত অবস্থার ছবি আঁকুন।
ভদ্রমহিল তাঁর কথার কোনও উত্তর দিলেন না, ধীরে ধীরে ডানহাতটি তুলে মেলে ধরলেন ক্যানভাসের বুকে। তারপর স্থির চোখে তাকিয়ে রইলেন সেদিকে।
এরপরই ঘটল এক অদ্ভুত ঘটনা। হঠাৎই খোলা জানলা দিয়ে একরাশ কুয়াশা বা সাদা ধোঁয়া ঘরে প্রবেশ করে মহিলা ও ক্যানভাসটিকে প্রায় ঢেকে দিল।
এই দৃশ্য দেখে দুই বন্ধু বেজায় ঘাবড়ে গেলেন। বলা যেতে পারে ভয়ও পেয়েছিলেন। কোথা থেকে এত ধোঁয়া এল! কিন্তু তাঁদের জন্য আরও বিস্ময় তখনও অপেক্ষা করে ছিল। যেমনভাবে হঠাৎই ঘরের মধ্যে ধোঁয়া প্রবেশ করিছিল ঠিক সেইভাবেই ধোঁয়ার কুণ্ডলী মিলিয়ে গেল শূন্যে। আর তারপর! সেই সাদা ক্যানভাসের বুকে ধীরে ধীরে ফুটে উঠতে শুরু করল একটা অবয়ব। চোখ, নাক, কান, ঠোঁট। কিন্তু হঠাৎই সেই অবয়ব আবার কোথায় মিলিয়ে গেল। ক্যানভাস তখন আবার শূন্য। কয়েক মুহূর্ত বাদে আবার সেই অবয়ব ফিরে এল ক্যানভাসের বুকে। দৃশ্য- অদৃশ্যের খেলা বেশ কিছুক্ষণ চলার পর অবশেষে ক্যানভাসের বুকে ফুটে উঠল পয়সকান্তির ছবি। এরপর ভদ্রমহিলা খুব ক্ষীণ স্বরে বলে উঠলেন ছবি আঁকা শেষ হয়েছে। আপনারা এবার এটা নিতে পারেন। দুই বন্ধু কোনওরকমে ইজেল থেকে ক্যানভাসটি মুক্ত করে নেমে এলেন রাজপথে।
তখনও তাঁদের শরীরের কাঁপুনি পুরোপুরি থামেনি।
(ক্রমশ)