উপস্থিত বুদ্ধি ও সময়োচিত সিদ্ধান্তে শত্রুদমন ও কর্মে সাফল্য। ব্যবসায় গোলযোগ। প্রিয়জনের শরীর-স্বাস্থ্যে অবনতি। উচ্চশিক্ষায় ... বিশদ
ফেরার পথে আর হেঁটে নয়, গাড়িতে করেই বাড়ি ফিরে এলেন দুই বন্ধু। তারপর নিস্তেজ নার্ভকে সতেজ করার জন্য দু কাপ গরম পানীয় নিয়ে তাঁরা মুখোমুখি বসলেন। তখনও তাঁদের ঘোর পুরোপুরি কাটেনি। তবে মন থেকে সমস্ত অবিশ্বাস তাঁদের দূর হয়ে গেছে। তাঁরা দুজনেই বুঝতে পেরেছিলেন, ওই বাড়ির সেই ঘরে যখন ছবি আঁকা হচ্ছে তাঁরা তিনজন ছাড়াও অদৃশ্য কোনও ব্যক্তি বা শক্তি সেখানে উপস্থিত ছিলেন।
নীরবতা ভাঙলেন মহাত্মা শিশিরকুমারের বন্ধু। তিনি তাঁর বন্ধুকে বললেন, যখন ছবি আঁকার কাজ চলছিল তখন কিন্তু আমরা তিনজন ছাড়া ঘরে আর কেউ ছিলেন না। ওই ঘরে ইজেল আর ক্যানভাস বাদে আঁকার অন্য কোনও সরঞ্জামও আমাদের নজরে আসেনি। তাহলে ছবিটা কীভাবে আঁকা হল!
বন্ধু বললেন, কোনওকালেই আমার ঈশ্বর, ভূত-প্রেতে বিন্দুমাত্র বিশ্বাস ছিল না। কিন্তু আজ তোমার সঙ্গে ওই বাড়িতে গিয়ে ওই দৃশ্য দেখার পর সত্যি আমার চোখ খুলে গিয়েছে। তবে এই ছবিটা ওই ভদ্রমহিলা নন, কোনও অদৃশ্য শক্তি বা অশরীরী শিল্পী এসে এঁকেছেন। আর এই কাজে সেই অদৃশ্য শক্তি ওই মহিলাকে মিডিয়াম হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন।
দিনদুয়েক বাদে শিশিরকুমার ঘোষের ‘একদা অবিশ্বাসী’ বন্ধু ক্যানভাসটি মহাত্মার ঠিকানায় পাঠালেন, সঙ্গে দিলেন একটি দীর্ঘ লেখা। নিজের চোখে দেখা সেই সকালের পুরো চিত্রটি তিনি তাঁর লেখনীর মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছিলেন। পরবর্তীকালে বন্ধুর সেই মূল্যবান লেখাটি তিনি তাঁর ‘হিন্দু স্পিরিচুয়্যাল ম্যাগাজিন’-এ বেশ বড় করে প্রকাশ করেছিলেন।
শিশিরকুমার ঘোষের অন্যতম একটি বিখ্যাত গ্রন্থ হল ‘শ্রীঅমিয় নিমাই চরিত’। সেই পুস্তকের ষষ্ঠ খণ্ডটি তিনি তাঁর প্রাণাধিক প্রিয় পুত্র পয়সকান্তিকে উৎসর্গ করে লিখেছিলেন—‘শ্রীমান্ পয়সকান্তি, এই গ্রন্থের ষষ্ঠ খণ্ড আমি তোমার হস্তে দিলাম। আমার বয়ঃক্রম সত্তর, তোমার পঁচিশ, এইরূপ সময়ে তুমি আমাকে হঠাৎ একদিনের পীড়ায় ছাড়িয়া গেলে। আমি তোমার বিরহ যে সহ্য করিতে পারিব ইহা স্বপ্নেও ভাবি নাই, কিন্তু তবু সহ্য করিতেছি। ইহা কী রূপে করিলাম?
তুমি আমার নিত্য সঙ্গী ছিলে। অতি বৃদ্ধ, জীর্ণ রুগণ, আমার দ্বারা ভজন-সাধন সম্ভব ছিল না। কিন্তু তুমি আমার সে অভাব পূরণ করিতে। তুমি বিখ্যাত সঙ্গীতাচার্য ছিলে। তোমার কণ্ঠে মধু-বর্ষণ হইত। তুমি আমাদের কীর্তন, কি তানসেনের ভজন, যখন গাহিতে তখন পশুপক্ষী পর্যন্ত মুগ্ধ হইত। তুমি আমার সঙ্গে থাকিয়া আমাকে অনুক্ষণ ভগবৎ-গুণসুধা পিয়াইতে।
সুতরাং তুমি যখন আমাকে ছাড়িয়া গেলে, তখন বিরহের সঙ্গে সঙ্গে আর এক বিপদ উপস্থিত হইল। আমার ভজন একপ্রকার বন্ধ হইয়া গেল।
তবু, তুমি যখন আমায় ত্যাগ করিয়া গেলে, তখন আমি শ্রীভগবানকে মনের সহিত ধন্যবাদ দিয়াছি। যদিও শুনিলে বিশ্বাস হয় না, কিন্তু তিনি জানেন ইহা সত্য কি না। তানসেনের ন্যায় সঙ্গীতজ্ঞ জগতে কেহ জন্মগ্রহণ করেন নাই। তিনি যে পদ প্রস্তুত করেন তাহা ভাবে ও তাল-লয়ে অদ্বিতীয়। তাহা লোপ হইয়া যাইতেছিল।
যাহা কিছু এখন আছে, তাহা রঙ্গপুরের শ্রীমান্ রামলাল মৈত্রের কণ্ঠে। তুমি তাহার নিকট এই তানসেনের পদগুলি অভ্যাস করিয়াছিলে। তুমি সর্বদা বলিতে,‘কবে আমি তানসেনের নিকট যাইব, যাইয়া তাঁহার সমুদয় পদ শিখিব’ এখন তোমার সেই সুযোগ হইয়াছে।
তুমি প্রভুর কৃপায় ভক্তিধন পাইয়াছিলে, এখন মহানন্দে শ্রীভগবানের ভজন করিতেছ, সুতরাং তোমার অভাবের নিমিত্ত আমি স্বার্থপর হইয়া কেন দুঃখ করিব? বিশেষতঃ সংসারে তোমার কোন বন্ধন ছিল না, তুমি চিরদিন মুক্ত ছিলে।
তুমি আমাকে ছাড়িয়া গেলে, তোমার একখানি ছবি আমার আনিবার ইচ্ছা হইয়াছিল। মার্কিন দেশের এক বিখ্যাত মিডিয়াম আমার সে মনস্কাম পূর্ণ করিয়াছেন। চিত্রখানি ২০ মিনিটে দিবাভাগে লোকের সাক্ষাতে অদৃশ্য হস্তে চিত্রিত হয়। সে এত চমৎকার যে এ জড়জগতে বোধহয় এইরূপ সূক্ষ্ম কারিগরি হইতে পারে না, অন্ততঃ কোন কারিগর এক মাসের কমে ও রূপ সম্পূর্ণ ছবি আঁকিতে পারেন না। এই ছবিখানি সর্বদা আমার সম্মুখে থাকে।
আমি এই ছবি দেখি, আর আমার মনে উদয় হয় যে আমাদের জীবনদাতা আমাদিগকে জীবন দিয়া একেবারে ভুলিয়া যান নাই। আমাদের কথা তাঁহার মনে থাকে। কারণ তিনি ভালোবাসার আকর, তিনি জীবন দিয়া এ জগতে কিছুকাল রাখিয়া, পরে মৃত্যু-অন্তে আমাদিগকে আর এক জগতে লইয়া যান।
সেখানে শোক তাপ মৃত্যু রোগ কি অন্ধকার নাই, সেখানে আমরা আমাদের প্রীতির বস্তু লইয়া চিরদিন বাস করিব। যখন ইহা মনে উদয় হয়, তখন সেই যে ভগবান আমাদের জীবনের জীবন, তাঁহাকে প্রাণের সহিত ভজনা করিতে পারি না বলিয়া মাথা কুটিয়া মরিতে ইচ্ছা হয়। তুমি সুস্বরে গীত গাহিয়া তাঁহাকে অর্চনা কর, আর আমার যাহাতে শীঘ্র মোচন হয়, সে নিমিত্ত তাঁহার শ্রীচরণে নিবেদন করিও।’ শিশিরকুমার ঘোষ, বাগবাজার।
(ক্রমশ)