উপস্থিত বুদ্ধি ও সময়োচিত সিদ্ধান্তে শত্রুদমন ও কর্মে সাফল্য। ব্যবসায় গোলযোগ। প্রিয়জনের শরীর-স্বাস্থ্যে অবনতি। উচ্চশিক্ষায় ... বিশদ
হিঙ্গুলায়া মহাস্থানং জ্বালা মুখ্যাস্তথৈব চ। একান্ন সতীপীঠের অন্তর্গত এই জ্বালামুখীতে আমি প্রথম গিয়েছিলাম তেইশ বছর বয়সে। তারপর তো বিভিন্ন সময়ে কয়েকবার।
এ যাত্রায় কাংড়া দুর্গ দেখার পর এখানে রাত্রিবাস না করে বাসস্ট্যান্ডে এসে পঁচিশ কিমি দূরে জ্বালামুখীতে পৌঁছলাম।
পথের মহাপ্রস্থানের ফলে আগেকার সেইসব পথ যেন অচেনা মনে হতে লাগল। প্রথমবার মন্দির সংলগ্ন একটি ধর্মশালায় উঠেছিলাম। তারপর যখন যেখানে সুযোগ পেয়েছি, তখন সেখানেই। এই পুণ্যতীর্থ দর্শনে কেউ এলে এখানে কোনও থাকার জায়গার অভাব হবে না। কেননা জ্বালামুখী এখন ধর্মশালা নগরী।
মন্দিরের পথ ধরে সামান্য এগতেই পাহাড়ের গা থেকে ঝরে পড়া ঝর্ণার জলে একটি কুণ্ড নজরে আসে। যাত্রীরা এখানে স্নান দান করেন। নাম সূর্যকুণ্ড। এর একপাশে নারায়ণের একটি চরণচিহ্নও আছে। তার পরেই মায়ের মন্দির। মন্দিরের চূড়ায় সোনার কলসে একটি সোনার পতাকা লাগানো আছে। এটি পাঞ্জাবকেশরী মহারাজা রঞ্জিত সিংহের অবদান। ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি এই মন্দির নির্মাণ করিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, তাঁর সুযোগ্য পুত্র খড়্গ সিংহ এই মন্দিরের দরজা চৌকাঠ প্রভৃতি রুপো দিয়ে মুড়ে দিয়েছিলেন। সেই রুপোর নকশার কাজ এমনই শিল্পমণ্ডিত যে তদানীন্তন ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ সেই দরজার কারুকার্যের নমুনা তৈরি করিয়ে নিয়ে যান।
দরজা পার হয়ে ভিতরে ঢুকলেই মুখ্য জ্যোতিদর্শন। পাহাড়ের দেওয়ালে রৌপ্য নির্মিত কুলুঙ্গিতে প্রজ্বলিত অগ্নিশিখাই দেবীর কল্পরূপ। অনির্বাণ এই শিখার মধ্যে দুটি অগ্নিশিখাই বেশি প্রকট। অগ্নিশিখা দুটি নীলাভ। কখনও লেলিহান শিখায় লকলকিয়ে দীপ্ত হয় কখনও বা ক্ষীণ। এর মধ্যে বড় অগ্নিশিখাকেই মুখ্য জ্যোতি বলা হয়। উনি পূর্ণব্রহ্মজ্যোতি মুক্তি-প্রদায়িনী মহাকালীর প্রতীক। অন্যটির নাম অন্নপূর্ণা। ইনি ভাণ্ডার পরিপূর্ণ করেন। এ ছাড়াও দেওয়ালের বিভিন্ন ফাটল থেকে নবদুর্গার প্রতীক হিসেবে আরও সাতটি অগ্নিশিখা প্রজ্বলিত আছে। মুখ্য জ্যোতিসহ মোট নয়টি। এই সাতটি অগ্নিশিখাকে বলা হয় সপ্তমাতৃকা। যেমন শত্রু বিনাশের দেবী হলেন চণ্ডিকা। সর্বব্যাধি দূরীকরণের দেবী হলেন হিংলাজ মাতা। শোক ও দুঃখ বিনাশের জন্য বিন্ধ্যবাসিনী। ধনধান্যে পূর্ণতার দেবী মহালক্ষ্মী। বিদ্যাদাত্রী দেবী হলেন মহাসরস্বতী। সন্তান সুখ-প্রদায়িনী দেবী হলেন অম্বিকা আর আয়ু ও সুখদাত্রী হলেন অঞ্জনা মাতা।
জ্বালাময়ী এই দেবীকে দর্শন করতে বহু দূর-দূরান্ত থেকে যাত্রীরা এসে থাকেন। এই একমাত্র তীর্থ যেখানে কোনও পাণ্ডার উপদ্রব নেই। যাত্রীরা নিজেরাই যা নিয়ে আসেন, তা অগ্নিশিখায় স্পর্শ করিয়ে প্রসাদ করে নেন। পরে সেই প্রসাদ বিতরণও করেন।
শিখদের দশম গুরু গোবিন্দ সিংহ এই মন্দিরে বসে প্রতিদিন গ্রন্থসাহিব পাঠ ও দেবী পূজা করতেন। সম্রাট আকবরও একবার এখানে এসেছিলেন দেবীর মহিমা অনুধাবন করে দেবীকে দর্শন করতে। বাদশাহ আকবরের দেওয়া একটি ছত্র খণ্ডিত অবস্থায় আজও মায়ের দরবারে আছে। এই প্রসঙ্গে বিশদ জানতে আমারই লেখা হিমালয়ের নয় দেবী বইটি পড়ে দেখতে পারেন।
অনুসন্ধানে জেনেছি, এখানে মন্দির নির্মাণ যে ঠিক কোন কালে হয়েছিল তা আজও কেউ বলতে পারেন না। তবে আদি মন্দিরের সূচনা করেছিলেন মহারাজ ভূমিচন্দ্র। নগরকোট কাংড়ায় বজ্রেশ্বরীর ছোট মন্দির তৈরির পর এক গোয়ালার মুখে এখানকার সতীপীঠের মহিমা শুনে সেই অগ্নিশিখাকে ঘিরে একটি মন্দির নির্মাণ করে শাক-দ্বীপ থেকে ভোজক জাতির দু’জন ব্রাহ্মণকে নিয়ে এসে এখানে পূজার কাজে নিযুক্ত করেন। এঁদের নাম শ্রীধর ও কমলাপতি। সেই ভোজক ব্রাহ্মণবংশই অদ্যাবধি পালাক্রমে দেবীর সেবাপুজো করে আসছেন।
মুখ্য জ্যোতি দর্শনের পর বাঁদিকে বাঁধানো সিঁড়ির ধাপে পা দিলেই গণপতি ও শঙ্করাচার্যের মূর্তি চোখে পড়ে। এরপর আরও উপরে উঠলে দর্শন হয় মহাকাল, মহাবীর, বালকনাথ ও কালভৈরবের।
দোতলার দক্ষিণদিকের অংশটির নাম ‘গোরখ ডিব্বা’। নাথ সম্প্রদায়ের গুরু গোরক্ষনাথ এখানে তপস্যা করতেন। এটিকে ‘গোরখনাথ কি ধুনা’ও বলেন কেউ কেউ। এখানে আছে রাধা-কৃষ্ণের একটি প্রাচীন মন্দির। গোরখনাথ ডিব্বার একটু উপরে উঠলে শিবশক্তি ও লাল শিবালয় দৃষ্ট হয়। শিবশক্তি লিঙ্গের সঙ্গে একটি জ্যোতিও দর্শন হয়।
এখানে রুদ্রকুণ্ড নামে একটি কুণ্ডও আছে। এই কুণ্ডের জল অনবরত ফুটছে। তবে হাত দিলে বোঝা যায় জল কিন্তু মোটেই গরম নয়, ঠান্ডা। এখানে গোমুখী ও ব্রহ্মকুণ্ড নামে আরও দুটি কুণ্ড আছে।
মন্দির থেকে এক ফার্লং দূরে পাহাড়ের উপর আছে সিদ্ধ নাগার্জুন। এখানকার প্রাকৃতিক দৃশ্য অতি মনোরম। সেই সৌন্দর্য দর্শনে নাগার্জুনের একবার ভাবসমাধি হয়। এর এক ফার্লং দূরে পূর্বদিকে আছেন অম্বিকেশ্বর মহাদেব। ইনি হলেন উন্মত্ত ভৈরব। এই মন্দিরের কাছাকাছি অন্য মন্দিরে আছেন রাম-সীতা। একে টেরা বা তেরছা মন্দির বলা হয়। একবার ভূমিকম্পের সময় মন্দিরটি হেলে তেরছা হয়ে যায়। সেই থেকেই এই নাম টেরা বা তেরছা মন্দির। জ্বালামুখী তীর্থ দর্শনে শুধু মন্দির ও পার্বত্য প্রকৃতি নয় নগরসৌন্দর্যও সকল যাত্রীর মনকে মোহিত করে।
(ক্রমশ)
অলংকরণ : সোমনাথ পাল