শিক্ষার জন্য দূরে কোথাও যেতে পারেন। প্রেম-প্রণয়ে নতুন যোগাযোগ হবে। বিবাহের কথাবার্তাও পাকা হতে পারে। ... বিশদ
ক’দিন ধরে খুব বেচইন হয়ে আছেন সম্রাট আকবর। বেশ মন খারাপ। তবু অম্বরের গুলাব নিজেকে ব্যস্ত রেখেছেন। অম্বরের গুলাব নিয়ে আগ্রায় ফিরে আসার কয়েকদিনের মধ্যে বাদশা আকবর অনুভব করলেন এ গুলাব নিশ্চয়ই পারস্যের বাগিচায় ফুটে ছিল, অম্বররাজ বিহারীমল তাকে তুলে নিয়ে এসে পুঁতেছিলেন তাঁর বাগিচায়। সেই গুলাব এখন ফুটে আছে আগ্রায়। ক’দিনেই রাজপুত-আওরত তার খুশবুতে ভরিয়ে দিয়েছে প্রাসাদের অন্দরমহল।
জাঁহাপনার অন্দরমহলে এখন সেই গুলাবের রওশনি। সম্রাটের চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে তার আগুন রূপে। রাজপুত-আওরতের পরনে লাল টকটকে ঘাগরা, লুটিয়ে থাকে ঘরের মেঝেয়, তাতে জরির কাজ, এখানে-ওখানে চুমকি বসানো, গায়ে একই রকম জরি ও চুমকি-বসানো লাল উড়নি, উড়নির একটা দিক ঘুঙ্ঘট হয়ে নেমে এসেছে কপালের অনেকটা নীচে। তাতে আরও খুবসুরত লাগে রাজপুত আওরতকে।
সম্রাটের সঙ্গে বাতচিত করার মুহূর্তে কখনও সেই ঘুঙ্ঘট সরে গেলে সম্রাট দেখতে পান ফর্সা কপালের মাঝখান জুড়ে আছে ঝকঝকে সোনার টায়রা, তার মধ্যে কারুকাজ করা বিশাল লকেট। নাকে একটি বুলাক, দুই হাত জোড়া কত রঙের বেলোয়ারি। সম্রাট দেখতে থাকেন মুগ্ধ হয়ে। আরও চমকে ওঠেন যখন রাজপুত-আওরত ঘরের মধ্যে চলে-ফেরে আর সারাক্ষণ ঝমর-ঝমর ঝমর-ঝমর। দু পায়ের পাঁয়জোরের ঝমর শব্দ চলকে দিতে থাকে তাঁর শরীরের খুন।
সম্রাট আকবরের এখন অনেকখানি সময় কাটছে তাঁর খাসমহলে। প্রায় ঘুরঘুর করেন রাজপুত-আওরতের কাছাকাছি। হিন্দুস্থানের বাদশার দিলে এক বেহদ্দ খুশ।
এক মধ্যরাতে রাজপুতকন্যা ঘুম ভেঙে তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, জাঁহাপনা, রূপমতী কে? আপনি নিদের ঘোরে ‘রূপমতী, রূপমতী’ বলে ডাকছিলেন।
পাঁচ সাল হয়ে গেল বাদশা আকবরের রাজত্বকাল, হিন্দুস্থানের হরেক ভাষার সঙ্গে তাঁর পহচানা ঘটছে রোজ। তাঁর নিজের ভাষা তুর্কি, জানতেন ফারসি ভাষাও, কিছুটা আরবিও, হিন্দুস্থানে এসে হিন্দিভাষাও শিখছেন একটু-একটু। জানতে চেষ্টা করছেন স্থানীয় বৃজভাষাও কিন্তু রাজপুত-আওরতের ভাষা বুঝতে বেশ ধকল যাচ্ছে তাঁর। তবু বিবির ভাষা যেমনটাই হোক, তার খসমকে বুঝে নিতে হয়।
সম্রাট হেসে রাজপুতকন্যাকে কাছে টেনে নিয়ে বললেন, তুমিই আমার রূপমতী। এই নামটা শুধু তুমি আর আমি জানব। আর জানবে কবিবর।
রাজপুতকন্যা আরও তাজ্জব হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, কবিবর কে?
সম্রাট হেসে বললেন, এই দুনিয়ায় আমার এক মুরশিদ। আমাকে রোজ হরেক কিতাব পড়ে শোনান। খুব দানেশমন্দ আদমি। পরে তোমার সঙ্গে জান-পহচানা হবে। রূপমতী তাকিয়ে থাকেন জিজ্ঞাসু চোখে। ইদানীং সকালের আম দরবারের পরে দুপুরের খানা, খানা শেষ হলে বিশ্রাম নিতে বাদশা অন্দরমহলে থাকেন। নয়িবিবির সঙ্গে কিছু বাতচিত, কিছু পেয়ার।
সম্রাটের ব্যস্ত জীবনে হঠাৎই উদাসী হাওয়া। কিন্তু তাঁর কি আশিক হয়ে পেয়ার করার সময় আছে! না দিল শান্ত আছে।
সম্রাট আকবর যে আজ বেতাব হয়ে আছেন তা ধরা পড়েছে রূপমতীর চোখেও, সে-কথা বলতেই সম্রাট ঘাড় নেড়ে জানালেন আজ তাঁর দিল খুব একটা বশে নেই। বললেন, রূপমতী, একটা সাম্রাজ্যের অধীশ্বর হওয়া মানে কাঁটার উপর বসে থাকা। তার অনেক সমস্যা। তোমাকে এখনই সব বলা মানে তোমার মগজটা ভারী করে দেওয়া। কিন্তু না- বললেও তো নয়, কারণ এই আগুনের আঁচ তোমার গায়েও কিছু লাগবে। একটু শুনে রাখো। কেন বেচইন আজ আমার দিল।
রূপমতী চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে বাদশাহর দিকে।
বাজবাহাদুর আবার মালোয়ার সিংহাসন দখল নিয়েছে শুনে বেফায়দা খিঁচড়ে আছে মনটা। যাকে মালোয়ায় পাঠিয়েছিলেন, সেই আধম খান বেইমানি করেছে তাঁর সঙ্গে। আধম খানকে আগ্রায় ফিরিয়ে নিয়ে যাকে পাঠিয়েছিলেন সেই পির মহম্মদও তাঁর সঙ্গে বেইমানি করেছিল!
রূপমতীর চোখ আরও বড়।
—রূপমতী পির মহম্মদ তার বেইমানির ফল পেয়েছে সঙ্গে সঙ্গে। গালিমফৌজ—শত্রু সৈন্যের তাড়া খেয়ে পা হড়কে পানিতে ডুবে এন্তেকাল হয়েছে তার। কিন্তু আধম খান এখনও কোনও শাস্তি পায়নি।
পির মহম্মদ না-থাকার সুযোগে আবার মালোয়ার তখতে বসেছে বাজবাহাদুর। মালোয়া হাতছাড়া হওয়াটাকে কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না বাদশাহ আকবর।
রূপমতী বললেন, জাঁহাপনা, যারা বেইমানি করে, সময় হলে ঈশ্বরই তাকে শাস্তি দেবেন। সম্রাট ঘাড় নাড়লেন, বললেন, আমার খুবই দুশ্চিন্তা হচ্ছে। হিন্দুস্থানে যার ওপরেই আমি ভরসা করছি সে-ই বেইমানি করছে। জৌনপুরে এত বিশাল ফৌজ নিয়ে এসে চোখ রাঙাচ্ছিল শের খান—মহমদ্দ আদিল শাহ-শূরের আওলাদ। তাকে শায়েস্তা করতে বললাম জৌনপুরের সুবেদার খান জামাম—আলি কুলি খানকে। শের খান শায়েস্তা হলও, কিন্তু খান জামাম যা গনিমত পেল—হাতি-ঘোড়া, ঠিক আধম খানের কায়দায় শের খানের হাতি-ঘোড়া সমস্ত চেপে দিল নিজের কাছে। আগ্রায় যা পাঠাল তা সামান্য। আমি নিজে ঘোড়া ছুটিয়ে, ফৌজ নিয়ে যেইমাত্র আলি কুলি খান আর তার ভাই বাহাদুর খানের কাছে গিয়ে হাজির হলাম, অমনি কুর্নিশ জানিয়ে ফেরত দিল সব গনিমত। বেইমান, সব বেইমান! দিয়েছি শায়েস্তা করে।
রূপমতী মুখে রওশন জ্বালিয়ে শুনছে বাদশাহের জয়ের বার্তা।
—রূপমতী, আমি মাগফেরাত করেছি খান জামামকে। ক্ষমা করলে বাগি ইনসানও বাগ মানে। হিন্দুস্থানে রিয়াসত করতে হলে খান জামামের মতো খানদানি ইনসান খুব দরকার।
সম্রাট আকবর তখন ঝরোখা দিয়ে দেখছেন বাইরের আশমান। শীতের দিন শেষ হয়ে বইছে বসন্তের হাওয়া। ক’দিন ধরে খুব চিন্তিত থাকার পর একদিন আম দরবারের সময়কাল শেষ হলে দেওয়ানের সঙ্গে একান্ত হলেন, বললেন, মালোয়ায় সেনাপতি পাঠাতে হবে।
দেওয়ান শরীর ঝুঁকিয়ে, কুর্নিশ জানিয়ে বললেন, এখনই পাঠিয়ে দিচ্ছি, হুজুর।
—কাকে পাঠাবেন?
—হুজুর, আবদুল্লা খান। এই উজবেগ ভালো তলোয়ার চালাতে জানে।
—সহি বাত। বাজবাহাদুরকে যেন উচিত শিক্ষা দিয়ে আসে। বদতমিজটা—
আবদুল্লা খান উজবেগ একটা মস্ত বাহিনী নিয়ে রওয়ানা দিয়েছে, কিন্তু এখনও কোনও দবির এসে পৌঁছে দেয়নি মালোয়া জয়ের সংবাদ। বাদশা অস্থির হচ্ছিলেন।
রূপমতী তাঁর অন্যমনস্কতা দেখে বললেন, জাঁহাপনা আপনি চিন্তা করবেন না। যে-কাজে মন করেছেন, তা পূর্ণ হবে।
সম্রাট আকবর অবাক হয়ে বললেন, কেন চিন্তা করছি তা কি তুমি জানো?
রূপমতী ঘাড় নেড়ে বললেন, না, জাঁহাপনা। কিন্তু আমার ঈশ্বরকে আমি জিজ্ঞাসা করলাম। তাতে তিনি এরকমটাই বললেন।
বাদশা বিস্মিত চোখে তাকিয়ে রইলেন রাজপুত আওরতের দিকে।
ঠিক কয়েকদিন পরে এক দুপুরে অন্দরমহলে বিশ্রাম নিচ্ছেন সম্রাট, হঠাৎ শুনলেন বাইরে কিছু ঘটনা ঘটছে যার জেরে প্রবল গোলমালের শব্দ ভেসে আসছে ভিতরে। তুমুল হইচই শুনে বেরতে গিয়ে দেখলেন তাঁর ঘর বাইরে থেকে বন্ধ। বাইরে পাহারায় থাকে এক দীর্ঘদেহী খোজা। সে-ই কি!
পিছনে আর একটি দরজা আছে, সেখান দিয়ে বেরতে গিয়ে দেখলেন সর-জানদারের সঙ্গে দু’জন জানদার অস্ত্র উঁচিয়ে পাহারায়। তারা কুর্নিশ জানিয়ে বলল, জাঁহাপনা হুজুর, ওদিকে যাবেন না! কোতল হয়ে গেছেন সামসুদ্দিন মহম্মদ আটগা খান।
সম্রাট চিৎকার করে বললেন, কী বলছ কী?
সর-জানদারের গলার স্বর কাঁপছে, সহি বাত, হুজুর।
সম্রাট আকবরও কাঁপছেন প্রবল উত্তেজনায়। বৈরাম খাঁ কোতল হওয়ার পর ওয়ার আম্মা মহম আনাগা তাঁকে আগলে রাখছিলেন আকবর যথেষ্ট জোয়ান হয়নি এই ভেবে। আকবর অনুমান করছিলেন রিয়াসতের সব সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন মহম আনাগা, আকবরের সঙ্গে কোনও কথা না-বলেই। আকবর ভিতরে ভিতরে ফুঁসছিলেন, শেষে তাঁর খেশ—নিকটাত্মীয় সামসুদ্দিন মহম্মদ আটগা খানকে ভাকিল করে নিরস্ত করার চেষ্টা করলেন মহম আনাগার খোয়াবকে। কিন্তু ভাবতে পারেননি আধম খান আচমকা—
সামসুদ্দিন মহম্মদ আটগা খানকে তিনি যে মন্ত্রী করে অনেক গুরুদায়িত্ব অর্পণ করেছেন তা পছন্দ হচ্ছিল না তাঁর সভাসদদের অনেকেরই। শুধু মহম আনাগা বা তাঁর পুত্র আধম খানেরই নয়, মুনিম খান ও আরও অনেক আমির উমরাহ তার পিছনে ফিসফাস করছে তা জানতেন। কিন্তু এতটা ভাবেননি আধম খান হঠাৎ কোনও প্ররোচনা ছাড়াই—
স্তম্ভিত আকবর বাইরে এসে শুনলেন আধম খান নাকি রুদ্রমূর্তি ধারণ করে ছোটাছুটি করছে খোলা তলোয়ার নিয়ে, তাই তাঁর রক্ষী ভয় পেয়ে বন্ধ করে দিয়েছিল দরজা, পাছে আধম খান আক্রমণ করে বসে সম্রাটকেও।
সম্রাট ভয় পাওয়ার মানুষ নন, আধম খানের কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, কী হল, আধম খান, তুমি নাকি সামসুদ্দিন আটগা খানকে খুন করেছ?
আধম খান নিষ্পৃহ, বলল, মানে ওই আর কি হয়ে গেল।
—হয়ে গেল! তার মানে? আধম খানের স্পর্ধা সীমা ছাড়িয়ে গেল, সম্রাটের হাত ধরে বলার চেষ্টা করল, কিছু মনে করবেন না, জাঁহাপনা।
—তাই নাকি? আকবর তাঁর তরবারি বের করতে যেতেই আধম খান আরও দুঃসাহসী হয়ে দু হাত দিয়ে চেপে ধরল সম্রাটের তরবারি।
আকবর স্তম্ভিত, অনুমান করলেন আধম খানের ঔদ্ধত্যের সীমা নেই, এখনই তার দৌড় না থামালে ভবিষ্যতে আরও খেসারত দিতে হবে। সেই মুহূর্তে তাঁর ডান হাতের মুষ্টি প্রবল গতিতে ছুটে গেল আধম খানের চোয়াল বরাবর, সেই আঘাতে ছিটকে পড়ল আধম খান। আকবর সেখানেই থামলেন না, তাঁর সর জানদার, জানদার, শিলদাররা ততক্ষণে ছুটে এসেছে চারদিকে, তাদের বললেন, এই বতমিজটাকে নীচে ফেক দাও।
সম্রাটের হুকুম শুনেও তাঁর রক্ষীরা থমকে গেল কয়েক মুহূর্ত এত উপর থেকে যাকে ফেলে দেওয়ার হুকুম করলেন তিনি মহম আনগার আওলাদ। মহম আনাগা তো সম্রাটের...
সর-জানদার ইতস্তত করছে দেখে সম্রাট আরও জোর হুঙ্কার দিলেন, ফেক দেও।
সর-জানদারের ইঙ্গিতে জানদার আর সিলদাররা মিলে ঝাঁপিয়ে পড়ে তুলে নিয়ে আধম খানের দেহ, তারপর ঝপাং করে ছুড়ে দিল নীচে। অনেকটা নীচে সশব্দে পড়ল দেহটা, কিন্তু নীচে পড়ার সময় কোনও আলসের কোণে ঠেকে যাওয়ায় আধম খানের শরীর থেকে প্রাণ বেরল না, শুধু শোনা যাচ্ছে একটা গোঙানির শব্দ। আকবর তাতে আরও ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন, উসকো লে আও উপর। দুসরে বার ফেক দো।
জানদাররা তখন তটস্থ, আবার দুদ্দাড় করে নেমে গেল নীচে। সবাই মিলে হ্যাঁচড়াতে হ্যাঁচড়াতে নিয়ে এল উপরে, তারপর আবার ছুঁড়ে ফেল দিল নীচে যাতে গোঙানির শব্দ আর না শোনা যায়।
আধম খানের যারা ইয়ার-দোস্ত, যারা সারাক্ষণ তার আহম্মকি কাজে মদত দিত, তারা সম্রাটের রুদ্রমূর্তি দেখে কোথায় পালিয়ে গেল কে জানে!
সম্রাট কিছুক্ষণ ভাবলেন,তারপর চলে গেলেন অন্দরমহলে যেখানে অসুস্থ মহম আনাগা শুয়েছিলেন, তাঁকে গিয়ে বললেন, আধম খান বাড়াবাড়ি করছিল। তাকে আমি শাস্তি দিয়েছি।
মহম আনাগা আকবরের মুখ দেখে কী বুঝলেন কে জানে, শুধু বললেন, সম্রাট যা করেছেন, ভালোর জন্যই করেছেন।
বাদশাহ ঘেমেনেয়ে যখন ফিরে এলেন তাঁর নিজের মহলে, দেখলেন তাঁর দিকে কীরকম তাজ্জব চোখে তাকিয়ে আছে প্রাসাদের নয়ি বিবি। অল্প হেসে বললেন, এ বাদশাহ অন্য বাদশাহ, রূপমতী। রিয়াসত রাখতে গেলে মাঝেমধ্যে নিষ্ঠুর হতে হয়।
(ক্রমশ)
অলংকরণ : ইন্দ্রনীল ঘোষ