শিক্ষার জন্য দূরে কোথাও যেতে পারেন। প্রেম-প্রণয়ে নতুন যোগাযোগ হবে। বিবাহের কথাবার্তাও পাকা হতে পারে। ... বিশদ
আজ থেকে বছর ত্রিশ, চল্লিশ আগেও ‘তাঁদের’ রমরমা উপস্থিতির কথা অনেক মানুষজনই বেশ বুঝতে পারতেন। সেইসময় কলকাতা এবং তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে বেশ কিছু পরিত্যক্ত, পুরনো বাড়ি ছিল। সেইসব বাড়ির বিভিন্ন তলায় তাঁরা সপরিবারে বসবাস করতেন। দিনের বেলায় তাঁদের চলাফেরা মোটেই টের পাওয়া যেত না। যেই সূর্যদেব সেদিনের মতো পশ্চিমাকাশে ঢলে পড়তেন, আর তখনই হাতে আঁকশি নিয়ে এক সাইকেল আরোহী টুক টুক করে একের পর এক ল্যাম্পপোস্টের আলো জ্বালাতে জ্বালাতে হারিয়ে যেতেন এপাড়া থেকে অন্য পাড়ায়। হলদে হয়ে যাওয়া সেই বাল্বের ম্রিয়মান আলো কিন্তু আজকের মতো কোনওদিনই রাস্তা ছুঁতে পারত না। আর তারপরেই শুরু হতো তাঁদের হইহুল্লোড়। কিছু কিছু এলাকার পুরো দখলদারি তাঁরা নিয়ে নিতেন। যেমন বরাহনগর কুটিঘাট অঞ্চলের বসাকবাগানের দীর্ঘ পথটি রাতের বেলায় পার হতে অতি বড় সাহসীরও বুক কেঁপে উঠত। একদিকে বিশাল এক কেয়া ঝোপ, আর রাস্তার ধারে বসাকদেরই কোনও পূর্বপুরুষ সার দিয়ে ছোট ছোট এক ধরনের ফলের গাছ পুঁতেছিলেন। অদ্ভুত আকৃতির সবজে রঙের পাকানো এক ধরনের ফল । ওপরের মোটা সবুজ খোসাটা ছাড়িয়ে ফেললেই বেরিয়ে আসত সাদা শাঁস। অদ্ভুত তার স্বাদ। তাকে আমরা আদর করে জিলিপি ফল বলে ডাকতাম। তবে এই বাগানের সেই কুখ্যাত গাব গাছটিই ছিল মানুষের ত্রাসের কারণ। কারণ ওই গাব গাছে প্রতিবছরই কেউ না কেউ গলায় দড়ি দিতেন। ফাঁসি ঝোলা গাব গাছ নামে সে বিখ্যাত ছিল। অনেকেই এই গাছের তলায় রাত-গভীরে তাঁদের দর্শন পেয়েছেন বলেও শোনা যেত। বর্তমানে সেই গাব গাছ অতীতের খাতায় নাম লিখিয়েছে। এই রাস্তার শেষ মাথার একটি বাড়িও যথেষ্ট কুখ্যাত ছিল। বালিগঞ্জের এক ধনী ব্যক্তির বাগানবাড়ি ছিল সেটি। রাতের দিকে বহু মানুষই সেই বাড়ি থেকে ঘুঙুরের আওয়াজ শুনতে পেতেন।
এই রকমই একটি রাস্তা হল রায় মথুরানাথ চৌধুরী স্ট্রিট। কুটিঘাট রোডের বুক থেকে উঠে মা গঙ্গার গা ঘেঁষে অধুনা লুপ্ত সতীদাহ ঘাট ছুঁয়ে সে এঁকেবেঁকে গিয়ে মিশেছে প্রামাণিক ঘাট রোডে । এখানেই রয়েছে সেই বিখ্যাত কাঁথাধারী মঠ। বহু কাল আগে সপার্ষদ মহাপ্রভু চৈতন্যদেব গঙ্গাবক্ষে নৌকাযোগে পুরী যাচ্ছিলেন। তাঁরা গঙ্গার ধারে ছোট্ট একটি চালা দেখে সেখানে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেবেন বলে ঠিক করেন। ওই চালাটি ছিল ভক্ত এক ব্রাহ্মণের। গৃহকর্তার আতিথেয়তায় মুগ্ধ হয়ে মহাপ্রভু বিদায় নেওয়ার সময় তাঁর সঙ্গের কাঁথাটি ব্রাহ্মণের গায়ে জড়িয়ে দেন। সেই কাঁথা আজও রয়েছে বর্তমান মঠে। এই মঠ পেরিয়ে একটু এগোলেই বাঁদিকের সেই ঘাটটি আজও বহু অত্যাচারের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ঘাটটির নাম শিলাঘাট। নকশাল আন্দোলনের শেষক্ষণে একদিন, যেদিনটি আজও কলঙ্কিত হয়ে আছে ‘বরাহনগর কিলিং’ নামে, ওই ঘাটেই খুন করা হয়েছিল অসংখ্য তরুণকে। তারপর তাঁদের ভাসিয়ে দেওয়া হয় গঙ্গায়। তাই রায় মথুরানাথ চৌধুরী স্ট্রিটের ওই অংশটি সম্পর্কে বহু মানুষ নানারকম কথা কিছুদিন আগে পর্যন্ত বলতেন। বর্তমানে বহুতল বাড়ি ও ভেপার ল্যাম্পের আলো এই অঞ্চলের ভৌতিক বদনাম একদম মুছে দিয়েছে।
তবে কলকতায় এখনও অনেক বিখ্যাত ভুতের বাড়ি আছে। যাদের নিয়ে পাতার পর পাতা লেখা যায়। যেমন ঐতিহাসিক হেস্টিংস হাউস। এর কুখ্যাতি আজও সমান ভাবে বিদ্যমান। ওই বাড়িটি এখনও বিখ্যাত হয়ে রয়েছে ভারতের প্রথম বড়লাটের জন্য। তিনি নাকি আজও ওই বাড়িতে মাঝেমাঝেই চলে আসেন। কেন আসেন? সেই প্রশ্নের উত্তর হয়তো অনেকেই জানেন ।
তাঁরা আছেন কিংবা নেই তা নিয়ে প্রবল দ্বিমত, তর্কবিতর্ক থাকলেও যাঁরা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন তাঁরা আছেন সেইসব মানুষজন অন্ধকার নামলেই নিজেদের সঁপে দিতেন দশরথ-নন্দন ‘শ্রীরামচন্দ্র’-এর চরণে । পারতপক্ষে রাতের অন্ধকারে তাঁরা বাড়ির বাইরে বেরতে চাইতেন না। বেরতে বাধ্য হলে তাঁরা বিড়বিড় করে অবিরাম রামনাম জপতে জপতে কাজ শেষ করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাড়ি ফিরে আসতেন। রাতে ঘুমোবার সময় তাঁদের ঘরের সমস্ত আলোই ফটফট করে জ্বলত। তাঁরা বিশ্বাস করতেন — দিনের আলোকে যদি ‘তাঁরা’ ভয় পান, তাহলে ঘরে যদি রাতে আলো জ্বেলে রাখা যায় তাহলে অবশ্যই তেনারা সেই ঘরে প্রবেশ করার সাহস দেখাবেন না। জানি না এইভাবে আলো জ্বেলে সত্যি তাঁদের আটকানো আদৌ সম্ভবপর কিনা!
এবার আপনাদের আমি একটা সত্যি ঘটনা শোনাব। এই গল্পটি আমি শুনেছিলাম এক খ্যাতিমান সাহিত্যিকের মুখ থেকে। আজ থেকে বছর পঁয়ত্রিশ আগের ঘটনা। উত্তরবঙ্গের এক সাহিত্যসভায় যোগ দিতে গিয়েছেন কলকাতার বেশ কয়েকজন বিশিষ্ট সাহিত্যিক। সেই দলে নবীনতম সাহিত্যিক হিসাবে সেই লেখকও ছিলেন। পরবর্তীকালে এক সন্ধ্যার আড্ডায় তিনি আমাদের এই গল্পটা শুনিয়েছিলেন।
সময়টা ছিল শীতকাল। দার্জিলিং মেলে চেপে সদলবলে তাঁরা গিয়ে নামলেন নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে। সেখানে তাঁদের জন্য উদ্যোক্তারা সকাল থেকেই গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করেছিলেন। গোটা তিনেক গাড়িতে ভাগাভাগি করে লেখকরা উঠে পড়লেন। একসময় গাড়ি গিয়ে পৌঁছল তাঁদের জন্য ঠিক করে রাখা বনবাংলোতে। দুপুরের আহারের পর জমে উঠল জমজমাট আড্ডা। কিন্তু কোথাও যেন তাল কেটে যাচ্ছে। কেন এরকম হচ্ছে! আসলে ওই দলের দুই বর্ষীয়ান সাহিত্যিকের মধ্যে কোনও কারণে একটা সমস্যা তৈরি হয়েছিল। তাঁদের মধ্যে তখন কথা বন্ধ। তাই বিবাদমান দু’জনেই দু’জনের রসিকতায় কোনওরকম উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছিলেন না। এইভাবে কখন যেন সময় হয়ে গেল বিকেলের সভার। সেই সাহিত্য সভা শেষে তাঁরা যখন আবার বাংলোয় ফিরলেন, তখন বেশ রাত হয়েছে। উদ্যোক্তারা প্রত্যেকের জন্য আলাদা ঘরের ব্যবস্থা করেছেন। আলাদা ঘরে শুতে হবে শোনা মাত্র দলের অন্যতম এক প্রবীণ সদস্যের হৃদকম্পন শুরু হল। কারণ তিনি প্রবলভাবে ভূতের অস্তিত্বে বিশ্বাস করতেন। এদিকে তাঁর সঙ্গে যিনি রুম শেয়ার করতে পারেন, সেই মানুষটির সঙ্গেই তো আবার প্রবল ঝগড়া চলছে।
এই পরলোকের বাসিন্দারাই সেই রাতে দুই পুরনো বন্ধুর বিবাদ মিটিয়ে দিয়েছিলেন। ভূত বিশ্বাসী সেই প্রখ্যাত লেখক ও সম্পাদক হাতের কাছে রাখা প্যাড টেনে নিয়ে নাকি লিখেছিলেন, ‘ঝগড়া আপাতত স্থগিত থাক। আজ রাতে তুমি আমার ঘরে শুতে পারবে কি?’ চিঠি পড়ে আর এক বিখ্যাত সাহিত্যিক ও সম্পাদক মৃদু হেসে বন্ধুর সঙ্গে রাত কাটাতে চলে এসেছিলেন।
ভূত নিয়ে লেখক ও শিল্পীদের আগ্রহ এবং উৎসাহ কোনওকালেই নেহাত কম ছিল না। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও প্ল্যানচেট করতেন। তাঁর সেই আসর আলো করে গিয়েছেন বহু বিখ্যাত আত্মা। অপরদিকে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় স্বয়ং প্রেত দর্শন না করলেও তাঁর পিতা মতিলাল চট্টোপাধ্যায় কাশীতে ‘পুত্রের ওপর ভয়ঙ্কর ক্রুদ্ধ সদ্য প্রয়াত পিতার প্রেতকে’ কোনওক্রমে শান্ত করেছিলেন। সেই গল্প কথাসাহিত্যিক তাঁর বন্ধুদের কাছে মাঝে মাঝেই করতেন।
তখনও ‘কপালকুণ্ডলা’ লেখার কাজে হাত দেননি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তিনি তখন নেগুয়া (পূর্ব মেদিনীপুর)-তে থাকতেন। কার্যোপলক্ষে তাঁকে একদিন যেতে হয়েছিল নেগুয়ার বাইরে একটি জায়গায়। সেখানে রাত্রিবেলায় তিনিও শুভ্র বসন পরিহিতা এক রমণীকে দেখেছিলেন। ভূতে বিশ্বাস শুধু ভারতীয় লেখকর বা শিল্পীরাই করতেন এরকম ভাবাটা কিন্তু একদমই অনুচিত হবে। ধরা যাক শেক্সপিয়রের কথা। তাঁর লেখায় তাঁদের উপস্থিতি আমাদের বারেবারে নজরে এসেছে। ‘হ্যামলেট’ নাটকে হ্যামলেট তাঁর বন্ধু হোরাসিয়োকে কী বলেছিলেন একবার মনে করার চেষ্টা করুন। তিনি বলেছিলেন,‘There are more things in heaven and earth Horatio, Than the dreamt of in your philosophy.’
পরবর্তী সংখ্যা থেকে আপনাদের সেইসব কাহিনী শোনাবার চেষ্টা করব। (চলবে)