শিক্ষার জন্য দূরে কোথাও যেতে পারেন। প্রেম-প্রণয়ে নতুন যোগাযোগ হবে। বিবাহের কথাবার্তাও পাকা হতে পারে। ... বিশদ
যদি বাসনা করেছ ওরে মন যাবে কাশী বৃন্দাবন, তবে আর দেরি কেন? বসে কেন অকারণ? মন হল মাতিকা (নালা)। তাকে যেদিকে নিয়ে যাবে সেদিকেই সে যাবে। তাই মন যখন সুদূরের পিয়াসী তখন সব বাধা অতিক্রম করে বেরিয়ে পড়াই ভালো। যাত্রা হোক শুরু আনন্দভ্রমণে।
প্রথমে কাশী অর্থাৎ বারাণসীর কথাই বলি— গঙ্গা বরুণা অসি তিন নিয়ে বারাণসী। সেই বারাণসী বা কাশীধাম একদা ষোড়শ মহাজনপদের অন্তর্গত ছিল। শাক্ত, শৈব, বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের চরম বিকাশক্ষেত্র এই পবিত্র ভূমি মূলত শৈবতীর্থ রূপেই প্রসিদ্ধ। পুরাণমতে, মহাদেবের ত্রিশূলোপরি অর্ধচন্দ্রাকৃতি এই কাশী নগরী দর্শন মাত্রেই মোক্ষলাভ হয়। এই স্থানে মৃত্যু বা দেহ বিসর্জন দিলে মানব শিবত্ব লাভ করেন এমন ধারণও পোষণ করেন অনেকে। গঙ্গার পশ্চিমকূল বারাণসী সমতুল। এই প্রবাদবাক্য কাশী মাহাত্ম্যকে আরও মহিমান্বিত করেছে।
আমি যখন মাতৃগর্ভে তখন থেকেই কাশীতে। তবে জন্মেছি হাওড়ায়। আমার শৈশব, বাল্য, কৈশোর ও যৌবনের অনেক দিবারাত্রি এই কাশীতেই অতিবাহিত হয়েছে। প্রথমে আমরা থাকতাম পাঁড়ে ঘাটে। পরে গোধূলিয়ার কাছে অগস্ত্যকুণ্ডায়। সঙ্কটমোচন মন্দিরের প্রধান সেবায়েত ঝা’জির সঙ্গে প্রায়দিনই বিড়লা মন্দিরের দোতলায় বসে তাঁর গানের সঙ্গে তবলায় সঙ্গত করতাম। ওই সময় আমি উস্তাদ মসিদ খান ও তাঁর সুযোগ্য পুত্র কেরামতুল্লা খানের কাছে তবলা শিখতাম। আমার আত্মকথন থাক, এবার কাশী বা বারাণসীর কথা বলি।
ব্রিটিশ আমলে এখানকার শিংরৌলিতে ক্যান্টনমেন্ট হলে এর নাম হয় বেনারস ক্যান্টনমেন্ট। তবে বর্তমানে এটি স্বনামে মহিমান্বিত। ১৯৫৬ সালের ২৪ মে থেকে সরকারি আদেশ বলে বেনারস আবার বারাণসী হয়ে যায়।
কাশী আমাদের এক অন্যতম প্রসিদ্ধ তীর্থস্থান। তেত্রিশ কোটি দেবতার অধিষ্ঠান এখানে। তবে কাশী মানেই বিশ্বনাথ ও অন্নপূর্ণা। কাশী মানেই সঙ্কটা ও সঙ্কট মোচন। দুর্গাবাড়ি ও বিড়লা মন্দির। সারনাথ ও রামনগরের রাজবাড়ি। কাশী মানেই রাজঘাট থেকে অসিঘাট পর্যন্ত অর্ধচন্দ্রাকৃতি ঘাট। কাশী মানেই উত্তর বাহিনী গঙ্গার পুণ্যসলিলে স্নান ও গঙ্গা বক্ষে ভ্রমণ। ইদানীং সন্ধ্যার সময় ধর্মব্যবসায়ীদের আয়োজিত থিয়েট্রিক্যাল গঙ্গারতিও নয়নাভিরাম।
ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে কাশী বা বারাণসীতে আসার অনেক ট্রেন আছে। তবে ইদানীং সবাই হাওড়া থেকে বিভূতি এক্সপ্রেসেই আসা যাওয়া পছন্দ করেন। স্টেশন এলাকা থেকে গোধূলিয়ার মোড় বা দশাশ্বমেধ ঘাট পর্যন্ত প্রচুর হোটেল ও ধর্মশালা আছে। এরমধ্যে ভারত সেবাশ্রম সংঘ, পাঁড়ে ধর্মশালা, জয়পুরিয়া ধর্মশালা ও হরসুন্দরী ধর্মশালা উল্লেখযোগ্য।
কাশীতে এসে অন্নপূর্ণা ও বিশ্বনাথকে দর্শন না করলে মন ভরে না। আর বিশ্বনাথের আরতির তো তুলনা নেই। তবে বর্তমানে অত্যধিক ভিড়ের কারণে দর্শন মনের মতো হয় না। সময়ও নষ্ট হয় অনেক।
কাশীতে এলে দশাশ্বমেধ ঘাট থেকে কেদারঘাট পর্যন্ত ঘাটে ঘাটে হেঁটে যাওয়ার আনন্দই আলাদা। তবে নৌকাযোগে কেদার ও মণিকর্ণিকার ঘাট পর্যন্ত ঘুরিয়ে দেখানোর ব্যবস্থাও আছে।
বারাণসী ভ্রমণার্থীরা একদিন সকালের দিকে সারনাথ এবং দুপুর অথবা বিকেলে যেতে পারেন বিড়লা মন্দিরে। এটি কাশী হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৩শো একর জমি নিয়ে এর বিস্তৃতি। পণ্ডিত মদনমোহন মালব্যের একক প্রচেষ্টায় গড়ে উঠেছে এই জ্ঞানপীঠ। বিড়লা মন্দির দর্শনের পর সব যাত্রীরাই আসেন সঙ্কটমোচন মন্দিরে পুজো দিতে। প্রতি শনি ও মঙ্গলবার এখানে প্রচুর ভক্ত সমাগম হয়। এখান থেকে হাঁটাপথের দূরত্বে ১৯৬৪ সালে ঠাকুরদাস সুরেখা নির্মিত ‘তুলসী মানস মন্দির’ দেখে সবাই আসেন কাছেই দুর্গাবাড়িতে। এটি মাংকি টেম্পল নামে খ্যাত। বর্তমানে অত্যধিক উপদ্রবের কারণে স্থানটি বানরমুক্ত করা হয়েছে।
বারাণসী থেকে এবার একদিন যাওয়া যেতে পারে চুনার বিন্ধ্যাচলে। এখানের জন্য ট্যুর বাস অথবা একটি গাড়ি নিতেই হবে। চুনার ও বিন্ধ্যাচলও বেড়ানোর মতো জায়গা। গঙ্গার দক্ষিণ কূলে অবস্থিত চুনারের প্রধান আকর্ষণ হল এর ঐতিহাসিক দুর্গটি। মহারাজ বিক্রমাদিত্যের ভাই রাজা ভর্তৃহরি এই দুর্গটি স্থাপন করেন। বিন্ধ্যাচলের বিন্দুবাসিনী ৫১ পীঠের অন্তর্গত এক মহাপীঠ। এখানে সতীর বাম পদাঙ্গুলি পড়েছিল। এরপর অদূরবর্তী পাহাড়ে অষ্টভুজা, পাতালকালী ও কালীকুঁয়ায় গিয়ে কালী খো দর্শন করে সন্ধ্যায় ফিরে আসা।
হাতে বেশি সময় থাকলে একদিন গাড়িতে অথবা নৌকা যোগে রামনগরের দুর্গ দেখা বা মণিকর্ণিকার ঘাট থেকে কয়েক পা এগিয়ে সঙ্কটার পুজো দিয়ে বীরেশ্বর দর্শন। এঁরই দোর ধরে স্বামী বিবেকানন্দের আবির্ভাব। এরপর গলিপথে হেঁটে এখানকার ভৈরব, বাবা বিশ্বনাথের কুকুরবাহন রুদ্ররূপ ‘কালভৈরব’ দর্শন করে ফিরে আসা। চারপাঁচ দিন সময় হাতে থাকলে খুব ভালোভাবেই ঘুরে দেখা যায় বাবা বিশ্বনাথের কাশী বা বারাণসী।(চলবে)