শিক্ষার জন্য দূরে কোথাও যেতে পারেন। প্রেম-প্রণয়ে নতুন যোগাযোগ হবে। বিবাহের কথাবার্তাও পাকা হতে পারে। ... বিশদ
সুবাহ্ কাল বাদশা আকবরের পছন্দের সময়। ফজরের আলো ফোটার আগে তিনি অলিন্দে গিয়ে ইন্তেজার করেন কখন আসমানের পুব কোণে উদয় হবে সূর্যের। আজও অপেক্ষা করছিলেন, অপেক্ষার শেষে চোখ মেলে দেখলেন লাল সূর্যের লাফিয়ে দিগন্তের সীমানা পার হয়ে উঠে আসা।
সেই দৃশ্যে বাদশাহ চোখ বুজলেন। মহাকাল শুরু করলেন আরও একটি দিন।
বেশ কিছুকাল ধরে তাঁর মনের মধ্যে সারাক্ষণ সওয়াল হচ্ছে এক আশ্চর্য বিষয়ের। কে সেই মহাশক্তি যিনি চালনা করছেন সারে জাহান! কে সেই ঈশ্বর যিনি নিয়ন্ত্রণ করছেন কোটি কোটি ইনসানের জীবন! যে কোনওভাবে হোক তাঁকে জানতেই হবে সেই অদৃশ্য শক্তির কথা। সৃষ্টিকর্তার পরম রহস্য জানার জন্য তিনি বেচইন হয়ে উঠছেন বেশ কিছুকাল।
সম্রাটের এই বেতাব হওয়ার সূচনা কামারঘা জঙ্গলে শিকারে গিয়ে। সেদিন ছিল ২৬ সফর মাস, অল হিজরি ৯৮৬। এক হুকুমনামা পাঠিয়ে কামারঘার বকশিকে বলেছিলেন জঙ্গলের সব পশুকে তাড়িয়ে এক জায়গায় আনতে। জঙ্গলে গিয়ে বল্লম ছুঁড়ে এক টিপে হরিণ, ভালু বা শের গাঁথতে পারা তাঁর খুব মৌজের বিষয়।
টানা দশদিন ধরে মিশকিন-পাইকরা মিলে বহু পশুকে এক জায়গায় নিয়ে এসে তাঁকে খবর দিয়েছিল। মির বকশি, মির আতিস, সর জানদার, সিলদার সবাইকে নিয়ে জঙ্গলে ঢুকেছিলেন বেশ খোশমেজাজে। দিলশঙ্করের হাওদায় বসে এগচ্ছেন জঙ্গলের সেই জায়গাটায়। হাতে বল্লম, চোখ খুঁজছে শিকার, ঘুরছেন এদিক-ওদিক, চোখে পড়ল একটা বড়সড় হরিণ। হাতের বল্লম বাগিয়ে ছুঁড়তে যাবেন, হঠাৎ চোখের সামনে একটা আশ্চর্য আলোর ঝলকানি। দিলের এ-কোণ থেকে ও-কোণে দ্রুত বয়ে গেল একটি বিদ্যুৎ রেখা। শরীরে এক অদ্ভুত ঝাঁকুনি।
তাঁর হাতের বল্লম হাতেই রয়ে গেল, কে যেন পিছন থেকে টেনে রেখেছে হাতটা।
চারপাশে যারা ছিল— জানদার, সিলদার, একটু দূরে দুই মির, তারা সবাই ইন্তেজার করছে কখন সম্রাটের বল্লম ঝটিতি ছুটে যাবে হরিণটার মাথা লক্ষ্য করে, রক্তাক্ত হরিণ ছটফট করে লুটিয়ে পড়বে মাটিতে। কিন্তু বাদশাহ হাত উঁচু করে রেখেছেন তো রেখেছেন, বল্লম রয়ে গেছে যেমন-কে-তেমন। মির বকশি দূর থেকে ছুটে এসে জিজ্ঞাসা করলেন, কী হল, হুজুর?
বাদশাহ নামিয়ে নিলেন বল্লম, কিছু বলতেই পারছেন না কাউকে, শরীর কাঁপছে কেন যেন! হঠাৎ বললেন, শিকার হবে না আজ।
— হবে না! সবাই তাজ্জব হয়ে তাকিয়ে আছে বাদশাহের দিকে। দশদিন ধরে এতগুলো মিশকিন আর পাইক মিলে তাড়িয়ে নিয়ে এসে জড়ো করল শিকারগুলো!
তারা নিশ্চয় ভাবছে রাজা-বাদশাহদের মেজাজ-মর্জিই আলাদা। হঠাৎ মনে হল শিকার করব, তারপর মনে হল শিকার করব না। বাদশাহের মনের কথা আন্দাজই করতে পারল না কেউ!
কামারঘা থেকে সম্রাট আকবর ফিরে এলেন বেখুদির মতো— কী এক তাজ্জব মৌজ নিয়ে। কী জানি কেন ওই অদ্ভুত আলোটা দেখলেন, কে তাঁর ভেতরে উস্কে দিচ্ছিল সেই অনুভূতি যা কিছুকাল ধরে তাঁকে বুঁদ করছিল আল্লার চিন্তায়। সারাক্ষণ একটাই ভাবনা— ইসলামি রীতি-নীতি কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে মুসলিম সমাজ! সেই ভাবনা থেকেই ইবাদতখানায় বিতর্কের সূচনা করেছিলেন, কিন্তু— কয়েকদিন ধরে ইবাদতখানায় যা ঘটল তা ঘোর চিন্তায় ফেলল তাঁকে। ইসলামি ধর্মের রীতি-নীতি সবার কাছেই এক, কিন্তু তার তাবির যতবার শুরু হচ্ছে, ততই তুলকালাম হচ্ছে কোঠির মধ্যে। একজন তাত্ত্বিক আলোচনা শুরু করতেই অন্যজন ‘বেশরা’, ‘বেশরা’ বলে চিৎকার, অন্যজন বলা শুরু করতেই আগের জন চিল্লাচ্ছে ‘বেশরা’, ‘বেশরা’। প্রত্যেকের ব্যাখ্যাই যদি ‘বেশরা’— ইসলামের বিধান বহির্ভূত হয়ে থাকে, শরিয়তির বাইরে হয়ে থাকে তা হলে কে ঠিক!
সারা সুবাহ্ কাল বিষয়টা নিয়ে ভেবে ঠিক করতে পারছিলেন না কে দিশা দেখাতে পারবে তাঁকে।
হঠাৎ ইয়াদ হল এখনই দেওয়ান-ই-খাসে যেতে হবে, কাজি-উল-কুজত তাঁর জন্য ইন্তেজার করছেন, বেশ কিছু আর্জির বিচার করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন বলে বাদশাহের সঙ্গে আলোচনা করতে চান, কিন্তু যাওয়া হল না, সেই মুহূর্তে বীরবরকে দেখে তাঁর মনে উল্লাস। কাজি-উল-কুজতকে খবর দিলেন তিনি এখন ব্যস্ত, পরে এ-বিষয়ে কথা বলবেন।
চবুতরা পার হয়ে বাদশাহ মহলের কাছে এসে বীরবর বললেন, জাঁহাপনা, রাতে আপনার চোখে নিদ এসেছিল তো!
বীরবর জানেন ইবাদতখানার কাজিয়া শুনে সম্রাট খুবই বেচইন, তাঁর চোখে এখনও বিষণ্ণতা।
—বীরবরজি, আমি কিন্তু একটুও আন্দাজ করতে পারিনি ইবাদতখানায় এরকম তুলকালাম হবে!
—জাহাঁপনা, খুব আপশোস কি বাত। এত সব দানাদার আদমি এমন বেওমকা ভাষা বলবেন তা কী করে আন্দাজ করবেন আপনি!
সম্রাটকে আনমনা দেখাচ্ছিল, বললেন, বীরবরজি, ইসলাম বিষয়ে আমার যা ধ্যান-ধারণা ছিল তা ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে!
—জাহাঁপনা, একটা হাজার বছরের ধর্মমত, এখনই নাখোশ হবেন না। আরও আলোচনা চলুক।
—না, বীরবরজি, ইবাদতখানায় যাঁরা নিজেদের মধ্যে লড়াই করছিলেন, শরিয়তি আইন বিষয়ে তাঁরা সবাই নিজেদের সেরা বলে মনে করেন। তাঁরাই যদি একমত না হতে পারেন, অন্যেরা কী বলবে! বললে তা আমি মানবই বা কেন! বরং—
বীরবরকে চমকে দিয়ে বাদশাহ হঠাৎ বললেন, আমি অন্য ধর্মের গুরুদের সঙ্গে ঈশ্বর বিষয়ে আলোচনা করতে চাই। তাঁদের ধর্মে এ বিষয়ে কী লেখা আছে! তাঁরাই বা ঈশ্বর নিয়ে কী ভাবেন!
বীরবর ভাবছিলেন ইবাদতখানায় যাঁরা তাবির করছিলেন, তাঁরা যদি শোনেন, তাঁদের মতামত অগ্রাহ্য করে বাদশাহ অন্য ধর্মের গুরুদের সঙ্গে আলোচনা করছেন, তাঁর পরিণাম কী হবে কে জানে!
কথাটা বলতেই বাদশাহ চোখ লাল করে বললেন, বীরবরজি, হিন্দুস্তানে আমার মুখের উপর কেউ সওয়াল করতে পারে বলে আপনি মনে করেন! আপনি এখনই অন্যদের খবর দিন।
একটু ইতস্তত করে বীরবর বললেন, জাঁহাপনা, এ দেশে পার্শি ধর্মগুরুরা আছেন— যাঁরা জরথ্রুস্টীয় মতে বিশ্বাসী। খ্রিস্টান মিশনারিরা আছেন, পুরুষোত্তম আর দেবীর মতো হিন্দু শাস্ত্রজ্ঞরা আছেন, হরিবিজয় সুরীর মতো অনেক জৈনগুরু আছেন, ইরানের ফতেউল্লা শিরাজির মতো আলিম আছেন, গোয়ায় জেসুইট পাদ্রিরা আছেন— আপনি সবার সঙ্গে কথা বলে জানতে পারেন কোন ধর্মে ঈশ্বরকে কীভাবে ভাবা হয়। সবার কাছ থেকে শুনলে আপনার ধারণা হবে ঈশ্বর কোন ধর্মে কীভাবে বিরাজ করেন। তারপর সবাইকে বলবেন আপনার মত। বাদশাহের মুখে তজল্লির আলো, বললেন, সহি বাত। গুজরাত ফতে করতে গিয়ে আলাপ হয়েছিল পর্তুগিজ পাদ্রিদের সঙ্গে। গোয়ায় কাউকে পাঠাই তাঁদের সিক্রিতে আসার দাওয়াত দিয়ে।
বীরবর বললেন, জাঁহাপনা, হাজি হবিবুল্লাকে পাঠানো যেতে পারে।
—সহি বাত। তার সঙ্গে কয়েকজন কারিগরকেও পাঠাই। গোয়ায় অনেক তসবির, অনেক কারুকাজ দেখে এসেছি যা এখানে নেই। কারিগররা যা কিছু নতুন দেখবে তা অবিকল নকল করে নিয়ে আসবে যাতে এখানে তারা নিজের মতো গড়তে পারে।
গোয়ার পাদ্রিদের উদ্দেশ্যে একটা চিরকুট লিখে, অনেক সওগত দিয়ে পাঠালেন হাজি হবিবুল্লাকে। খুব উত্তেজনা মনের ভেতর।
— বীরবরজি, হিন্দুশাস্ত্র যাঁরা ভালো জানেন, তাঁদের এত্তেলা পাঠান।
কাঠমোল্লারা খবর রাখছিল বাদশাহের কাছে কারা-কারা আসছেন, তাঁর কানে কী মসলত দিচ্ছে! ওই পর্যন্তই, তাদের অবশ্য হল্লা বাধানোর তাগদ নেই, কিন্তু কেল্লায় ছড়িয়ে পড়ল কানাকানি।
সর-জানদার আর সিলদাররা সেদিন ঘিরে রইল ইবাদতখানা। দুই নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ— পুরুষোত্তম ও দেবী এলেন ইবাদতখানায়, বসলেন বাদশাহ আকবরের মুখোমুখি। তাঁরা বোঝালেন হিন্দুধর্মের পৌত্তলিকতার কথা। ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর, শ্রীকৃষ্ণ, রামের কথা। দেবী মহামায়ার কথা। আকবর শুনলেন মন দিয়ে, বললেন শিকার করতে গিয়ে তাঁর যে অদ্ভুত আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা হয়েছিল তার কথা। দুই ব্রাহ্মণ সায় দিয়ে জানালেন হিন্দুশাস্ত্রেও এভাবে পরমপুরুষের নিকটবর্তী হওয়ার কথা লেখা আছে।
বাদশাহ আকবরের তখন আরও জানার ইচ্ছে। বীরবর খবর দিয়েছেন জৈন সন্ন্যাসীদের। পরের দিনই ইবাদতখানায় এলেন জৈন ধর্মজ্ঞরা— হরিবিজয় সুরী, ভানুচন্দ্র উপাধ্যায়, বিজয়সেনা সুরী, জিনচন্দ্র।
বীরবর খেয়াল করছিলেন হিন্দু সন্ন্যাসীদের কথা ঠিক যেরকম উৎসাহ নিয়ে আকবর শুনলেন, একই রকম নিবিষ্ট হয়ে শুনলেন জৈন সন্ন্যাসীদের কথা। বরং জৈনদের জীবনযাপন ও কৃচ্ছ্রসাধন বিষয়ে তাঁর উৎসাহ আরও বেশি। কেল্লার সবাই তাজ্জব হয়ে দেখল হরিবিজয় সুরীর অনুরোধে বাদশাহ কারাগারের সমস্ত বন্দিকে মুক্ত করে দিলেন, ছেড়ে দিলেন খাঁচায় বন্দি সব পাখিকেও। কিছু কিছু দিনে বন্ধ করলেন পশুহত্যাও। এও রটে গেল জিনচন্দ্র নাকি বাদশাহকে বুঝিয়ে-সুজিয়ে দীক্ষিত করছেন জৈনধর্মে। কেল্লায় তখন ঘোর অস্থিরতা। কী চাইছেন বাদশা!
বাদশা নির্বিকার। গুজরাতের নওসরি থেকে এলেন পার্সি সন্ত দস্তুর মেহেরজি রানা। সাদা দাড়ি-গোঁফে দেখাই যায় না তাঁর বিশাল মুখের বেশিটাই, দু’চোখে এক অদ্ভুত চাউনি যা বাদশাহকে বুঁদ করে রাখল। জরথ্রুস্টের এই অনুগামীর কথাও শুনলেন মন দিয়ে, গোঁফের উপর দুই আঙুল বোলাতে বোলাতে কীরকম বেঁহুশ হয়ে গেলেন। এতটাই আকৃষ্ট হলেন যে, সমস্ত আগুনের উৎস সূর্যকে মেনে নিলেন দেবতা বলে, আবুল ফজলকে ডেকে বললেন, ফয়রান যাও, ইবাদতখানার কাছে সারাক্ষণ নার জ্বালানো থাকবে, সেই আগুন যেন কখনও না নেভে। আর বীরবল, দোশো বিঘা জমি দিয়ে দাও এঁকে।
একদিন শিখগুরুদের কথাও শুনলেন। তাঁদের বিশাল ধর্মগ্রন্থ ‘গ্রন্থসাহেব’ দেখে তাজ্জব। তাঁদের কথায় খুশি হয়ে হুকুম দিলেন পাঞ্জাবের সমস্ত রায়তের খাজনা মকুব। কেল্লায় তখন মহাগোল।
আরও গোল বাধল গোয়া থেকে তিন পাদ্রি রোডোলফো অ্যাকোয়াভিভা, ফ্রান্সিস হেনরিক ও অ্যান্থনি মনসারেট পৌঁছনোর পর। পাদ্রি রোডোলফো বেশ গোঁড়া খ্রিস্টান, যিশুখ্রিস্ট ছাড়া কাউকে রেয়াত করেন না। খ্রিস্টের মাহাত্ম্য বোঝাতে গিয়ে ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক বিষয়ে কিছু কটুকথা বললেন যা মুহূর্তে বিষ ছিটোল গোটা কেল্লায়।
বীরবরের কাছে খবর পৌঁছল কেল্লার হোমরা-চোমরাদের কেউ কেউ এখনই বাগি। তিন পাদ্রি যে মুহূর্তে কেল্লার বাইরে বেরবেন, আক্রমণ হতে পারে তাঁদের উপর। বীরবর সর-জানদারকে ডেকে পাঠিয়ে বললেন, পাদ্রিদের নিরাপদে পৌঁছে দিয়ে আসতে। সম্রাট আকবর তখন গভীরভাবে ভাবছেন সব ধর্মের আদত কথাগুলি। বীরবর দাঁড়িয়েছিলেন কাছেই, বললেন, শেখ মুবারককে এত্তেলা দিন।
দুই জহিন জওয়ান— ফৈজি ও আবুল ফজলের ওয়ালেদ শেখ মুবারক এক দানাদার আদমি, তাঁর সঙ্গেও দীর্ঘক্ষণ কথা বললেন। বললেন, আমি খুতবা পড়ব। দুনিয়ার সব ধর্মের কথা বুঝে আমার আন্দাজ ধর্ম বিষয়ে শেষ কথা বলবেন একমাত্র হিন্দুস্তানের বাদশাহই।
শেখ মুবারক বললেন, আপনি ঠিকই ভেবেছেন, জাহাঁপনা। দুনিয়ার আরও রাজা-বাদশাহ— আমির তাইমুর সাহিব-কিরণ কিংবা মির্জা উলুগ বাগ গুরগাঁও বা আরও অনেকে খুতবা পড়েছিলেন।
—আপনি একটা খসড়া দিন।
পরের দিন শেখ মুবারক হাজির হলেন খুতবার খসড়া নিয়ে। সম্রাটকে পড়ে শোনানো হল সেটি। খুতবার শেষে একটি চমৎকার কাসিদা আছে সেটি লিখেছে ফৈজি।
সেদিনই প্রধান আলিমদের কয়েকজনকে এত্তেলা পাঠিয়ে নিয়ে এসে তাঁদেরও পড়ে শোনানো হল খুতবার বয়ান। তাঁদের মধ্যে ছিলেন দুই প্রধান শরিয়ত বিশারদ মখ্দুম-উল-মুল্ক ও শেখ আবদুন নবি— যাঁরা বিবাদ করছিলেন ইবাদতখানায়। সবাই বয়ানটি পড়ে তাকাচ্ছিলেন বাদশাহের দিকে। বাদশাহ তাঁদের দিকে এমন চোখে তাকিয়ে আছেন যে, কারও কিছু বলার সাহসই হল না। নিঃশব্দে বয়ানের নীচে সই করে দিলেন।
রজব মাস, অল হিজরি ৯৮৭, ফতেপুর সিক্রির দরগায় হাজির হতে বলা হল সবাইকে। তখনও প্রায় কেউই জানেন না কী হতে চলেছে আসরের নামাজের পর। বাদশাহ বসে আছেন এক জেল্লাদার তখ্তের উপর। তাঁকে ঘিরে কেল্লারত সব হোমরা-চোমরা আদমিরা। শেখ মুবারকের হাতে সেই খাগের কাগজ, তিনি চেঁচিয়ে ঘোষণা করলেন, আজ এই তনজিহি দিনে হিন্দুস্তানের শাহেনশাহ আবুল-ফতে জালাল-উদ্দিন আকবর হিন্দুস্তানের সমস্ত প্রজার উদ্দেশ্যে পাঠ করছেন এই মহ্জরনামা।
তাঁর ঘোষণা শেষ হতে বাদশাহ উঠে দাঁড়ালেন, তাঁর হাতে সেই খাগের কাগজে লেখা বয়ানটি। তাঁর ঠিক পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বীরবর, তাঁরও হাতে একটি খাগের কাগজ, তিনি খুব আস্তে আস্তে পড়ছেন বয়ানটি, আকবর তাঁর হাতের কাগজটির দিকে চোখ রেখে বীরবরের কথা শুনছেন, আর বলে চলেছেন, ‘হিন্দুস্তান এখন নিরাপত্তা, ন্যায়, শান্তি ও দানের জায়গা...’
দরজার চবুতরায় উপস্থিত যাবতীয় আমির-উমরাহ, মনসবদার থেকে শুরু করে আম-আদমি শুনছে বাদশাহ বলছেন, ‘বাদশাহ আকবর ‘সুলতানে আদিল’ বা ন্যায়-পরায়ণ শাসক। শাহানশাহির ইসলামের ইমামও। অতঃপর ধর্মীয় বিষয় নিয়ে উলেমা ও অন্যান্য গোষ্ঠীর মধ্যে বিবাদ-বিতর্ক ঘটলে, শরিয়তি ব্যাখ্যায় সন্দেহ হলে, চূড়ান্ত সমাধানের দায়িত্ব অর্পিত হবে শাহেনশাহের উপর। তিনি ‘আকল’ বা জ্ঞান দিয়ে ‘ইজতেহাদ’ বা অনুসন্ধান করে যে রায় দেবেন, সেই রায়ই মানতে বাধ্য হবেন সবাই। তা হলেই হিন্দুস্তান ইসলামের তরিক্কি হবে, সুশাসিত হবে শাহানশাহি। তাঁর শাসনকালে সব প্রজা নিজেদের খায়েস অনুযায়ী ধর্মাচরণ করতে পারবে, কেউ অন্য ধর্মের কাজে নাক গলাতে পারবেন না। সহ্য করা হবে না কোনও ধর্মবিরোধ। শরিয়তি আইন সংক্রান্ত বিরোধে শাহেনশাহর বিচারই হবে চূড়ান্ত। মোগল-ই-আজমে শুধুমাত্র ‘তকলিদ’ বা ইসলামি শরিয়তের প্রথাগত অনুকরণের দোহাই দিয়ে কাজ চলবে না। বরং ‘ইজতেহাদ’ বা ‘তহকিক’ বা পরিস্থিতি বিচার করে যুক্তিসম্মত শরিয়তি নির্দেশ প্রয়োগ করাই হবে শ্রেষ্ঠ। বিচারের এই সিদ্ধান্তের ধারক ও বাহক একমাত্র সম্রাট আকবর। ...’
‘মহ্জরনামা’ বা দাবিপত্র পড়তে গিয়ে বেশ সমস্যা হচ্ছিল কেননা বীরবর চাইছিলেন তাঁর পড়া যেন অন্য কেউ শুনতে না পান। নিচু স্বরে পড়ায় সম্রাট নিজেও শুনতে পাচ্ছিলেন না ভালো করে, কিছুটা পাঠ করার পরে সম্রাট বসে পড়লেন, হাতের কাগজটি দিয়ে দিলেন কাছেই দাঁড়ানো হাফিজ মুহম্মদ আমিনের হাতে। তিনিই পাঠ করলেন ‘মহ্জরনামা’র বাকি অংশ।
শেষ অংশে ছিল ফৈজির রচিত একটি কাসিদা:
‘আল্লা, তুমি আমাদের স্বাধীনতা দিয়েছ/ দিয়েছ একটি জ্ঞানী হৃদয়, একটি শক্ত হাত/ আমাদের পথ দেখায় সমতা ও ন্যায়ের পথে/ আর আমাদের সমতা ছাড়া দূর করে দেয় আর সব ভাবনা/ তাঁর চিন্তন আর সব ভাবনার চেয়ে অনেক উঁচুতে/ তিনিই সবার উঁচুতে, আল্লাহু আকবর-ই।’
‘মহ্জরনামা’ শেষ হতেই বাদশাহ চললেন বাদশাহমহলে। যাওয়ার আগে বীরবরকে বললেন, বীরবরজি, আজ আমার জিন্দেগানিতে সবচেয়ে মৌজের দিন। মনে হচ্ছে আমার শরীরে ভর করেছে এক জহুরা— অলৌকিক শক্তি। আজ আমার কোনও পেরেশানি নেই। আমি এবার দিল ভরে গুরুজির গানা শুনব। আপনি ব্যবস্থা করুন অনুপ তালাওয়ে।
বীরবর খেয়াল করছিলেন পিছনে আম-আদমির নিঃশব্দ ফিরে যাওয়া। ফিরছেন উলেমা ও অন্য গোঁড়া ইসলামি নেতারা। তাঁদের মধ্যে জেহাদের আগুন জ্বলছে।
(ক্রমশ)