বা ঙা লি র বঙ্গবন্ধু
মৃণালকান্তি দাস
বাইগার এঁকে-বেঁকে গিয়ে মিশেছে মধুমতী নদীতে। এই মধুমতীরই অসংখ্য শাখা নদীর একটি হল বাইগার। নদীর দু’পাশে তাল, তমাল, হিজলের সবুজ সমারোহ। বাইগারের তীর ঘেঁষে ছবির মতো সাজানো সুন্দর গ্রাম। টুঙ্গিপাড়া। এই গ্রামেই জন্ম তাঁর। ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ। দাদু শেখ আব্দুল মজিদ নাম রেখেছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। সে সময় বলেছিলেন, ‘মা সায়রা, তোর ছেলের নাম এমন রাখলাম যে জগৎ জোড়া খ্যাত হবে।’ এই বয়ান মুজিবকন্যা শেখ হাসিনার। আব্বার আদরের সেই ‘হাসু’।
‘শেখ মুজিব আমার পিতা’ বইয়ে স্মৃতিচারণায় হাসিনা লিখেছেন, ‘আমার আব্বার শরীর ছিল বেশ রোগা। তাই আমার দাদি সব সময়ই ব্যস্ত থাকতেন কীভাবে তাঁর খোকার শরীর ভালো করা যায়। দুধ, ছানা, মাখন ঘরেই তৈরি হতো। ছিল বাগানের ফল, নদীর তাজা মাছ। তবুও দাদির আফসোসের সীমা ছিল না, কেন তার খোকা একটু হৃষ্টপুষ্ট নাদুশ-নুদুশ হয় না। খাবার সময় খুব সাধারণ ভাত, মাছের ঝোল, সবজিই তিনি পছন্দ করতেন। আমার চার ফুপু ও এক চাচা ছিলেন। এই চার বোনের মধ্যে দুই বোন বড় ছিলেন। ছোট্ট ভাইটির যাতে কোনও কষ্ট না হয় এজন্য সদা সর্বদা ব্যস্ত থাকতেন বড় দুই বোন। দাদা-দাদির কাছে খোকার আদর ছিল সীমাহীন।
আমার আব্বার লেখাপড়ার পাশাপাশি খেলাধুলার প্রতি দারুণ ঝোঁক ছিল। ফুটবল খেলতে খুব পছন্দ করতেন। মধুমতী নদী পার হয়ে চিতলমারি ও মোল্লার হাট যেতেন খেলতে। গোপালগঞ্জে স্কুলের টিম ছিল। আব্বা যখন খেলতেন তখন দাদাও মাঝে মাঝে খেলা দেখতে যেতেন। দাদা আমাদের কাছে গল্প করতেন যে, ‘তোমার আব্বা এত রোগা ছিল যে, বলে জোরে লাথি মেরে মাঠে গড়িয়ে পড়ত। আব্বা যদি ধারে কাছে থাকতেন তবে সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করতেন। আমরা তখন সত্যিই খুব মজা পেতাম। আমি যখন ওই সমস্ত এলাকায় যাই, অনেক বয়স্ক লোকের সঙ্গে পরিচয় হয়, যাঁরা আজও আব্বার ছোটবেলার কথা বলেন...’
এই সেই শেখ মুজিব, যাঁকে ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি গণঅভ্যুত্থানের গণমঞ্চ থেকে বাংলার আপামর জনতা ‘বঙ্গবন্ধু’ অভিধায় অভিষিক্ত করেছিল। সত্যি তিনি বাংলা ও বাঙালির। বাঙালি জাতি পেয়েছিল বাংলার একজন প্রকৃত বান্ধব। তাই তাঁকে এই শিরোপা দিতে কারও মনে কোনও কুণ্ঠা ছিল না। তখনকার পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও ইতিহাসের ঘূর্ণাবর্ত তাঁকে এই অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে গড়ে তুলেছিল। পাকিস্তানি রাজনৈতিক দরবারের খাজা-গজা, খানবাহাদুর-নায়েব নাজিমের কবল থেকে রাজনীতিকে তিনি নিয়ে এসেছিলেন সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের দোরগোড়ায়। প্রান্তিক মানুষের দাবিদাওয়াকে পরিণত করেছেন রাজনীতির কেন্দ্রীয় ইস্যুতে। পেশ করেছেন পূর্ববাংলার মানুষের বাঁচার দাবি ‘ছয় দফা’। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের কথাই ছিল তাঁর হৃদয়জুড়ে। বলতেন, ‘বাঙালি-অবাঙালি, হিন্দু-মুসলমান সবাই আমাদের ভাই, তাদের রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদের।’
তাঁকে অনেকেই আত্মজীবনী লিখতে অনুরোধ করেছিলেন। বিশেষ করে তাঁর পরমা স্ত্রী যাকে তিনি ‘রেণু’ বলে সম্বোধন করতেন, তিনিই বেশি উৎসাহিত করেছিলেন। পরে শেখ মুজিব লিখেছেন: ‘আমি বলতাম, এমন কী আর করেছি যা লেখা যায়! আমার জীবনের ঘটনাগুলি জেনে জনসাধারণের কি কোনও কাজে লাগবে? কিছুই তো করতে পারলাম না। শুধু এইটুকু বলতে পারি, নীতি ও আদর্শের জন্য সামান্য একটু ত্যাগ স্বীকার করতে চেষ্টা করেছি।’ বলতেন, ‘...জনতার বিরুদ্ধে যেতে শোষকরাও ভয় পায়। শাসক যখন শোষক হয় অথবা শোষকদের সাহায্য করতে আরম্ভ করে, তখন দেশের ও জনগণের মঙ্গল হওয়ার চেয়ে অমঙ্গলই বেশি হয়’।
এই আত্মজীবনী লেখার কাজ আওয়ামি লিগ গঠনের সময় কখন যেন থমকে গিয়েছিল। কারণ তত দিনে বাংলার মানুষের অগাধ আস্থা অর্জন করে বঙ্গবন্ধুতে উন্নীত হতে চলা মুজিবকে কারাবন্দি করে ফেলেছে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকরা। শেখ মুজিবের রহমানের লেখা ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ এক অসামান্য রাজনৈতিক দলিল। তাঁর বাল্যকাল ও কিশোর জীবনের যতটুকু কথা ছাপা হয়েছে, তা সেই সময়কার সামাজিক ও কৃষিভিত্তিক আন্দোলনের উৎসাহ জোগানো ‘ব্রতচারী সমিতি’র আদর্শের খুব কাছাকাছি। গ্রাম্য সংস্কৃতি, নৃত্য সঙ্গীত তথা গ্রাম বাংলার প্রতিটি অণু পরমাণুকে তিনি ভালোবাসতেন জীবন বাজি রেখে। এগুলোই ছিল তৎকালীন ‘ব্রতচারী সমিতির’ কাজের লক্ষণ। যদিও অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে এই কথার সপক্ষে কোনও উল্লেখ নেই। শুধু একটি উক্তি ছাড়া: ‘আমি ব্রতচারী খুব ভাল পারতাম’। তাঁর দেশপ্রেম ও নিষ্ঠা ছিল আকাশচুম্বী এবং সেই লক্ষণ যৌবনকালেই তাঁর মধ্যে দেখা দিয়েছিল। তারপর ধাপে ধাপে তা পরিণতির দিকে এগতে থাকে। বাঙালির জন্য একটি রাষ্ট্র গড়তে মাত্র বাইশ বছরে তিনি বাঙালিকে শুধু বাঙালি জাতীয়তাবাদে ঐক্যবদ্ধ করেননি, বাঙালির আর্থিক, সাংস্কৃতিক মুক্তির জন্য তাঁদের প্রস্তুত করেছিলেন।
এর ফল? তাঁর জীবনের বড় একটি অংশ কেটেছে কারাগারে। পাকিস্তান আমলে দফায় দফায় বন্দিদশার দিনলিপির সংকলন শেখ মুজিবের দ্বিতীয় গ্রন্থ ‘কারাগারের রোজনামচা’। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বারবার বন্দি করেও তাঁর মনোবলে চিড় ধরাতে পারেনি। জন্মের পর থেকে বেশির ভাগ সময় তাঁর ছেলে রাসেল দেখছে, বাবা বাড়িতে থাকেন না। থাকেন কারাগারে। অবুঝ শিশু মনে করেছিল কারাগারটাই তার ‘আব্বার বাড়ি’। পাগল ওয়ার্ডের গায়ের সেলটিতে রাখা হয়েছিল শেখ মুজিবকে। একবার ইদের দিনে বাড়ির পাঠানো খাবার অন্য বন্দিদের বিলিয়ে দিয়ে মনে পড়ল তাঁর— পাগল ভাইদের তো কিছু দেওয়া হল না! পরের দিন মুরগি আনিয়ে নিজে রান্না করে পাঠালেন জনা সত্তর পাগল বন্দির জন্য। জেলে বন্দি কেউ যদি পরীক্ষায় বসতে চায়— তার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়তেন তিনি। পরীক্ষার দিন নিজে ডাব পাঠিয়ে দিতেন।
৭ মার্চ, ১৯৭১। ঐতিহাসিক ভাষণে শেখ মুজিব বলেছিলেন, ‘রক্তের দাগ এখনও শুকোয়নি। আপনারা রক্ত দিয়ে আমাকে ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্ত করে এনেছিলেন। সে দিন এই রেসকোর্সে আমি বলেছিলাম, রক্তের ঋণ আমি রক্ত দিয়ে শোধ করব। মনে আছে? আজও আমি রক্ত দিয়েই রক্তের ঋণ শোধ করতে প্রস্তুত।’ হ্যাঁ, সেদিন বঙ্গবন্ধুর ভাষণের মধ্যে দিয়েই নিরস্ত্র বাঙালি হয়ে উঠেছিল সশস্ত্র। সেদিনের শব্দে অস্ত্র তৈরির এক আশ্চর্য জাদু-শক্তি ছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সেই আহ্বান: ‘এ বারের সংগ্রাম, মুক্তির সংগ্রাম। এ বারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ স্ফুলিঙ্গের মতোই তা ছড়িয়ে পড়েছিল দেশজুড়ে। বাঙালি তাঁর হাত ধরেই স্পর্শ করেছিল স্বাধীন একটি দেশের মাটি। ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে ভারতের প্রত্যক্ষ সাহায্য এবং সোভিয়েত রাশিয়ার প্রত্যক্ষ সমর্থন স্বাধীন বাংলাদেশকে বাস্তব করে তোলে। পাকিস্তান অর্জনের মূল আদর্শ দ্বিজাতিতত্বকে ভুয়ো প্রমাণ করার জন্য অনিবার্য ছিল এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। কারণ, ধর্মের নামে রাজনীতিকে মনে-প্রাণে ঘৃণা করতেন ববন্ধু। সমাজ ও রাষ্ট্রকে ধর্মনিরপেক্ষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য তিনি আজীবন সংগ্রাম করেছেন। বিভিন্ন ভাষণ-বক্তৃতায় বলতেন, ‘কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষ কখনও দুর্নীতি করে না, বরং দুর্নীতি করে তথাকথিত শিক্ষিত-সচেতন মানুষ।’ এসবের মধ্যেই খুঁজে পেয়েছিলেন পাকিস্তানের হাত থেকে বাংলাকে মুক্ত করার শক্তি।
ক্ষমতা হস্তান্তর প্রসঙ্গে আলোচনার জন্য সেই বছর ১৬ মার্চ মুজিব ও ইয়াহিয়ার বৈঠকে ঢাকায় উপস্থিত ছিলেন জুলফিকার আলি ভুট্টোও। আলোচনা ব্যর্থ হওয়ার পর ২৫ মার্চ সন্ধ্যায় ইয়াহিয়ারা ঢাকা ছাড়েন পশ্চিম পাকিস্তানের উদ্দেশে। আর বাংলায় সামরিক শাসন জারি হয়। সেই রাতেই বাঙালির উপর পাকিস্তানি সেনারা ঝাঁপিয়ে পড়ে, শুরু হয় পৃথিবীর ইতিহাসে ভয়াবহ গণহত্যা—অপারেশন সার্চলাইট। পাকিস্তানি সেনারা কামান, ট্যাঙ্ক নিয়ে হামলা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, পিলখানা রাইফেল সদর দপ্তর ও রাজারবাগ পুলিস সদর দপ্তরে। বঙ্গবন্ধু রাত ১২টা ২০মিনিটে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। বঙ্গবন্ধুর এই ঘোষণা বেতারে তাৎক্ষণিক বিশেষ ব্যবস্থায় গোটা দেশে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। এই বার্তা পেয়ে চট্টগ্রাম, কুমিল্লা ও যশোর সেনানিবাসে বাঙালি সেনা ও অফিসাররা স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত হতে শুরু করেন। সেই রাতেই পাক সেনাবাহিনী বঙ্গবন্ধুকে ধানমণ্ডির বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা সেনানিবাসে নিয়ে যায় এবং ২৬ মার্চ তাকে বন্দি অবস্থায় পাকিস্তান নিয়ে যায়। ২৬ মার্চ পাক জেনারেল ইয়াহিয়া আওয়ামি লিগকে নিষিদ্ধ করে বঙ্গবন্ধুকে ‘দেশদ্রোহী’ আখ্যা দেন।
১৬ ডিসেম্বর ঢাকার রেসকোর্স মাঠে পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ বিজয়ী হয়। অর্জিত হয় স্বাধীনতা। এই মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সাহায্য ছিল অনন্য। প্রায় এক কোটি শরণার্থীকে আশ্রয় দেওয়া, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীর অংশগ্রহণ বাংলাদেশের জন্মের ইতিহাসের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত হয়ে আছে। স্বাধীনতার পর ২৭ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে শেখ মুজিবুর রহমানকে অবিলম্বে নিঃশর্ত মুক্তি প্রদানের দাবি জানানো হয়। ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়ন চাপ দিতে থাকে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য। বিশ্বের আরও অনেক দেশ ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য পাকিস্তান সরকারের উদ্দেশে আহ্বান জানায়। আন্তর্জাতিক চাপের মুখে ১৯৭২-এর ৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দেয় পাকিস্তান। প্রথমে লন্ডন, তারপর দিল্লি হয়ে ১০ জানুয়ারি ঢাকায় পৌঁছন শেখ মুজিব। ১২ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন। বঙ্গবন্ধু গভীরভাবে রবীন্দ্রপ্রেমী ছিলেন। রবীন্দ্রনাথের মতোই বিশ্বাস করতেন, মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ। কবিগুরুর ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি তাঁর সমগ্র সত্তা জুড়ে এমনভাবে ছিল, যা স্বাধীনদেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে মর্যাদা পায়।
বঙ্গবন্ধুকে একবার ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্ট জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘আপনার শক্তি কোথায়?’ উত্তরে তিনি বলেছিলেন ‘আমি আমার জনগণকে ভালবাসি’। এরপর তিনি জানতে চান, আর আপনার দুর্বল দিকটা কী? মুজিবের উত্তর ছিল, ‘আমি আমার জনগণকে খুব বেশি ভালোবাসি’। এই ভালোবাসার মূল্য তাঁকে দিতে হয়েছে মাত্র ৫৫ বছর বয়সে। যে ত্যাগ ও তিতিক্ষার বিনিময়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছিল, তার পিছনে সবচেয়ে বড় যাঁর অবদান সেই বঙ্গবন্ধুকেই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পাকিস্তানপন্থী ঘাতকদের হাতে প্রাণ দিতে হয়েছিল। শুধু তিনিই নন, ঢাকা শহরের ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িতে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাঁর স্ত্রী ফজিলাতুন্নেসা, তিন ছেলে শেখ কামাল, শেখ জামাল ও দশ বছরের শিশু শেখ রাসেল, দুই পুত্রবধূ সুলতানা কামাল ও রোজি জামালও নিহত হন ঘাতকের বুলেটে। বিদেশে থাকায় বেঁচে যান বঙ্গবন্ধুর দুই মেয়ে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। ১৫ আগস্ট, সেদিন শুধু বঙ্গবন্ধু নয়, হত্যা করা হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকেও। বহু ভারতীয় গোয়েন্দাকর্তার আক্ষেপ, বঙ্গবন্ধুকে বাঁচানো যায়নি, এটা শুধু নবজাতক এক রাষ্ট্রের নয়, ভারতেরও ব্যর্থতা। সেদিনের ১১ বছরের মেয়েটি আজও ভোলেনি সেদিনের যন্ত্রণার কথা। প্রধানমন্ত্রী সত্তার চেয়েও আজও তাঁর কাছে মুখ্য পিতার কন্যা পরিচয়টুকুই। মুজিব কন্যা।
১৫ আগস্টের বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড ও তার পরবর্তী সরকারগুলোর দিকে তাকালেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে হত্যার কারণ। যারা বাংলাদেশের অভ্যুদয় চায়নি। যারা চায়নি পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হতে। যারা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে চীন ও মার্কিন ভূমিকার সমর্থন করেছে। সেদিন তারা একত্রিত হয়েছিল। সেই কারণেই বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার মাত্র ১৬ দিন পরেই ১৯৭৫-এর ৩১ আগস্ট বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়ের পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু চীন বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দেয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোরতর বিরোধী সৌদি আরব বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পরেই বাংলাদেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলে। ১৫ আগস্ট পাকিস্তান রেডিও বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের খবর জানানোর পাশাপাশি প্রচার করেছিল, ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ নাম বদলে ‘ইসলামিক প্রজাতন্ত্র বাংলাদেশ’ হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের রণধ্বনি, বাংলাদেশের জাতীয় স্লোগান ‘জয় বাংলা’ এক লহমায় বদলে গিয়েছিল— বাংলাদেশ জিন্দাবাদ। ‘বাংলাদেশ বেতার’ হয়ে গিয়েছিল ‘রেডিও বাংলাদেশ’।
লাভ হয়নি। সেই ষড়যন্ত্র রুখে দিয়েছেন শেখ হাসিনা। মুজিব কন্যা। ১৯৮১ সালের ১৭ মে। কালবৈশাখীর প্রবল ঝড়-বৃষ্টি মাথায় সেদিন বিমানবন্দরমুখী লাখো মানুষ। প্রবল বৃষ্টি তাদের সরাতে পারেনি বিমানবন্দর থেকে। সাড়ে ছ’বছর পর দেশের মাটিতে পা দিয়েই শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘সব হারিয়ে আমি আপনাদের মাঝে এসেছি। বঙ্গবন্ধু নির্দেশিত পথে তাঁর আদর্শ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে জাতির জনকের হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণে আমি জীবন উৎসর্গ করতে চাই।’ কথা রেখেছেন হাসিনা। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী আজও হৃদয়ে ধরে আছেন মুজিব আর রবীন্দ্রনাথকে। সেই শক্তিতেই তিনি অগ্রগামী। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে সার্থক করে তুলতে বদ্ধপরিকর। কারণ, ১৯৫৮ সালে আয়ুব খানের সামরিক শাসন জারির পর ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িতে তল্লাশির সময় তাঁর প্রিয় পুতুলটিও পুড়িয়ে ছাড়খার করে দিয়েছিল পাক বাহিনী। জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল ১৯৭৫-র ১৫ আগস্ট। একেকটি গুলির আওয়াজ যেন জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত নাড়িয়ে দেয়। আজও। সেই প্রসঙ্গ উঠলে মুজিব কন্যা বারবার বলেন, সেদিন ইন্দিরা গান্ধীর তথা ভারতের হাত বাড়িয়ে দেওয়ার কথা।
১০০ বছর আগে যে জনপদ ছিল পিছিয়ে থাকা, পরাধীন, সেই জনপদের মানুষকে স্বাধীনতা এনে দিয়েছিলেন একজন দীর্ঘকায় বাঙালি। শেখ মুজিব থেকে বঙ্গবন্ধুতে পরিণত হওয়ার শতবর্ষের সেই দীর্ঘযাত্রা আসলে বাঙালির প্রকৃত স্বাধীনতার আখ্যান। পাকিস্তানের অপশাসন থেকে মুক্তিলাভের জন্যই বাংলাদেশের জন্ম। এই রাষ্ট্রের জন্ম বাঙালি চিন্তা চেতনার এই পীঠস্থান হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে। আর বাংলাদেশের সব ঔজ্জ্বল্য আর সাহসের ভিত্তি একটিই নামের উচ্চারণ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
গ্রাফিক্স সোমনাথ পাল
সহযোগিতায় উজ্জ্বল দাস
15th March, 2020