কর্মপ্রার্থীদের ধৈর্য্য ধরতে হবে। প্রেম-প্রণয়ে আগ্রহ বাড়বে। নিকটস্থানীয় কারও প্রতি আকর্ষণ বাড়বে। পুরোনো কোনও বন্ধুর ... বিশদ
শতাব্দীর হ্রস্বতম অস্কার বক্তৃতা। আবার এটাও বলা যেতে পারে, মাত্র পাঁচটি শব্দ খরচ করে ‘ধন্যবাদজ্ঞাপন’।
হ্যাঁ, হয়তো অভিমানই রয়েছে এর পিছনে। হবে নাই বা কেন, যাঁকে গোটা দুনিয়া চেনে ‘মাস্টার অব সাসপেন্স’ নামে, উন্নাসিক ‘কাহিয়ে দ্যু সিনেমা’ থেকে শুরু করে ‘সাইট অ্যান্ড সাউন্ড’, ‘টাইম ম্যাগাজিন’ সকলেই যাঁকে শতাব্দীর অন্যতম সেরা পরিচালকের তকমায় ভূষিত করেছে, তাঁর কাছেই কি না সেরা পরিচালকের অস্কার অধরা!
স্যার আলফ্রেড জোসেফ হিচকক। সার্কিটে পরিচিত ‘হিচ’ নামেই। ১৮৯৯ সালের ১৩ই অগস্ট, এসেক্সের লেটানস্টোনে হিচককের জন্ম। ১.৭ মিটার উচ্চতার ভদ্রলোকটি পোশাক আশাকে পরিপাটি হলেও, চিত্তাকর্ষক নন মোটেই। কিন্তু মানুষের মন ও চরিত্র বিশ্লেষণে অদ্বিতীয়। সিনেমায় গল্প বলার জাদুতে আজও মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখতে পারেন বিশ্বের আবালবৃদ্ধবনিতাকে। ‘দি বার্ডস’ দেখে মুগ্ধ কুরোসাওয়া তাঁর সেরা ১০০ পরিচালকের তালিকায় প্রথমদিকেই ঠাঁই দেন হিচকককে। সেরা সিনেমা হিসেবে একমাত্র ‘রেবেকা’ই অস্কার জিতেছিল। আর রেবেকা (১৯৪০), লাইফবোট (১৯৪৪), স্পেলবাউন্ড (১৯৪৪), রিয়ার উইন্ডো ( ১৯৫৪) ও সাইকো (১৯৬০)’র জন্য পাঁচবার তিনি সেরা পরিচালকের জন্য মনোনীত হয়েছিলেন। কিন্তু ভাগ্যে একবারও অস্কারের শিকে ছেড়েনি। শেষপর্যন্ত ১৯৬৮ সালে অ্যাকাডেমি তাঁকে সারাজীবনের কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ জি থলবার্গ মেমোরিয়াল অ্যাওয়ার্ডে ভূষিত করে।
অস্কার থেকে বঞ্চিত হলেও, হিচকককে শতাব্দীর অন্যতম সেরা চলচ্চিত্র নির্মাতা বলা যায় নির্দ্বিধায়। তাঁর সিনেমা মানেই হরেক কিসিমের ভয়ে টইটম্বুর, অপরাধ ও পুলিশি জেরা। কাক-দাঁড়কাক-সিগাল ক্ষেপে গিয়ে খুবলে খাচ্ছে তন্বী পরমাসুন্দরী অপাপবিদ্ধকে। ছোট ছোট ফুলের মতো ফুটফুটে স্কুলের ছেলেমেয়েরাও রেহাই পাচ্ছে না দাঁড়কাকের হিংস্র আক্রমণ থেকে। ভাজা মাছটি উল্টে খেতে না পারা ধনী সম্ভ্রান্ত গোবেচারা স্বামীটি হাসতে হাসতে খুন করবেন নিজের স্ত্রীকে। শাওয়ারে স্নানরত সুন্দরী তরুণী বিনা প্ররোচনায় ছোরার আঘাতে খুন হয়ে যাবেন। সাদাকালোয় রক্তের কালচে কুণ্ডলীকৃত রেখা পাক খেয়ে মিলিয়ে যাবে অঝোর শাওয়ার ধারায়। ভয়ে চমকে উঠবে দর্শককুল। এভাবেই সারা পৃথিবীকে ভয়ের কাঁথায় আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে দুরমুশ করতে সিদ্ধহস্ত তিনি।
অথচ, এই মানুষটি সারা জীবন পুলিশকে বড্ড ভয় পেয়েছেন। তখন তাঁর বয়স চার কি পাঁচ। দুষ্টুমিতে তিতিবিরক্ত সব্জিবিক্রেতা বাবা উইলিয়াম একটা চিরকুটে কিছু লিখে ছেলের হাতে দিয়ে নিকটবর্তী লেটানস্টোন থানায় পাঠালেন। আর সেই লেখা পরেই বড়বাবু গারদের দরজা খুলে সটান ভেতরে পুরে দিলেন ছোট্ট ছেলেটিকে। গম্ভীর কণ্ঠে ভর্ৎসনার সুরে বললেন, ‘যারা দুষ্টুমি করে তাদের ঠাঁই হয় গরাদের অন্তরালে’। মিনিট পাঁচেক কারাবাসের সেই স্মৃতি তিনি জীবনে কখনও ভুলতে পারেননি। কিন্তু দুষ্টুমি করা থেকেও নিবৃত্ত হননি কখনও। হিচকক একবার তাঁর ইউনিটের এক রসদদারকে বলেছিলেন, ‘এক সপ্তাহের পারিশ্রমিক সে একদিনেই পেতে পারে! একটা গোটা রাত শুধু হাতে হাতকড়া পরে ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে এটার জন্য।’ উত্তম প্রস্তাব। নিজের হাতে তাঁকে হাতকড়া পরিয়ে ব্র্যান্ডি খাইয়ে হিচকক বিদায় নিলেন। কিন্তু ব্র্যান্ডিতে মেশানো ছিল কড়া ল্যাক্সেটিভ বা জোলাপ। রাত বাড়তেই জোলাপের প্রাবল্যে শুরু হল বিরামহীন তরল দাস্ত। হাত-পা বাঁধা থাকায় মর্মান্তিক অবস্থা ভদ্রলোকের। সকালে নাকে রুমাল চাপা দিয়ে জনগণ প্রত্যক্ষ করছেন সাতদিনের পারিশ্রমিকের লোভে জোলাপ জর্জরিত রসদদারের করুন ‘দুরাবস্থা’! এহেন দুষ্টু হিচকক সারাজীবনে কখনও অমলেট খাননি। কারণ, ডিম ভাঙলেই ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা থকথকে গা গোলানো হলুদ কুসুমের লাভা স্রোতের ভয়। শয়নে-স্বপনে ডিম্বাকৃতি ছিদ্রহীন সাদা হলুদের ল্যাতলেতে একটা বুলডোজার তাঁকে তাড়া করে ফিরত।
১৯১৯ সাল। টাইটেল কার্ড ডিজাইনার হিসেবে রূপোলি পর্দায় অভিষেক হিচককের। কিন্তু ভাগ্য তাঁর জন্য অন্য কিছু ঠিক করে রেখেছিল। কারণ, মানুষের গভীর গহন মনের অন্তঃস্থলের লুকোনো পাতা অক্লেশে পড়ে ফেলতে পারতেন তিনি। তাই তো তাঁর হাত ধরেই জন্ম নিয়েছে ‘দি বার্ডস’, ‘সাইকো’, ‘ভার্টিগো’র মতো একাধিক কালজয়ী থ্রিলার সিনেমা।
‘দি বার্ডস’
সাল ১৯৬১। ১৮ আগস্ট। সান্টা ক্রুজ সেন্টিনেলে একটা খবরের হেডলাইনে চোখ আটকে গেল হিচককের। লাখ লাখ পরিযায়ী সামুদ্রিক পাখি ঝাঁপিয়ে পড়ছে ক্যালিফোর্নিয়ার সমুদ্রের ধারের শহর ক্যাপিটোলার মনারি বে-তে। ভেঙে তছনছ করে দিচ্ছে টেলিভিশন অ্যান্টেনা, গাড়ির কাঁচ, রাস্তার আলো। লুইজিয়ানা স্টেট ইউনিভার্সিটির বিজ্ঞানীরা দেখিয়েছিলেন পাখিগুলোর পাকস্থলী থেকে মিলেছে মনুষ্যকৃত ‘ডোমোয়িক অ্যাসিড’, যা স্নায়ুকোষের পক্ষে মারাত্মক ক্ষতিকর। মস্তিষ্কের ক্ষতি হওয়ায় পাখিরা বিশৃঙ্খল আত্মঘাতী আচরণ করতে থাকে। এই অস্বাভাবিক ঘটনার কিছুকাল আগেই হিচকক পড়ে ফেলেছেন ১৯৫২তে প্রকাশিত দাফেনা দি মারিয়ার ছোটগল্প ‘দি বার্ডস’। নির্জন দ্বীপের তন্দ্রালু বিচ্ছিন্নতা আর মারকুটে পাখি ছাড়া হিচককের ‘দি বার্ডস’-এ দা মারিয়াকে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। মার্চ ২৮, ১৯৬৩। মুক্তি পেল ‘দি বার্ডস’। সানফ্রান্সিসকোর ধনী সুন্দরী আলালের ঘরের দুলালী মেলানি ড্যানিয়েলস (টিপি হেড্রেন) পোষা পশুপাখির দোকানে হাজির, সেখানে তার সঙ্গে দেখা হয় ফৌজদারি উকিল মিচ ব্রেনারের (রড টেলার)। বোন ক্যাথির জন্মদিনে মিচ উপহার হিসেবে দু’টো লাভবার্ডস কিনতে চায়। ঠিক সেই সময়ে হিচকক তাঁর পোষ্য দুটি সাদা টেরিয়ার, জিওফ্রে আর স্ট্যানলিকে নিয়ে রাস্তা পেরচ্ছিলেন।
সমুদ্রের ধারে বোডেগা বে’র নির্জন নিরিবিলি ছবির মতো সাজানো গোছানো পরিপাটি বাড়িতে সপ্তাহান্তে ফিরে আসে মিচ। কয়েকদিন বাদে খাঁচাবন্দি দু’টো লাভবার্ডসকে সঙ্গী করে ‘ডিবি ২/৪ অ্যাস্টন মার্টিন’ গাড়ি চালিয়ে মেলানি পাড়ি জমায় বোডেগা বে’র উদ্দেশ্যে। সেখানে মিচের বাড়ির ঠিকানা জোগাড় করে খাঁড়ি-পথে একা নৌকো ভাড়া করে গোপনে লাভবার্ডস দু’টিকে মিচের বাড়িতে রেখে আসে। ঘাটের কাছে পৌঁছনোর ঠিক আগে বেমক্কা মেলানির মাথা ঠুকরে ফুটো করে দেয় একটি সিগাল। এরপর কাক-দাঁড়কাক-সিগালের মুহূর্মুহু যূথবদ্ধ আক্রমণে ‘বোডেগা বে’র অধিবাসীরা সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন। পাখিদের হাতে খুন হন জিম নামে এক ব্যক্তি। ক্যাথির স্কুলে দলে দলে পাখি জড়ো হয়। পাখিদের আক্রমণে রক্তাক্ত, ক্ষতবিক্ষত হয় বাচ্চারা। পাখিদের দৌরাত্ম্যে স্থানীয় গ্যাস স্টেশনে ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণ ঘটে। শিক্ষিকা অ্যানি, ক্যাথিকে বাড়ি পৌঁছে দিতে এসে উন্মত্ত পাখিদের হানায় মিচের বাড়ির দোরগোড়ায় ক্ষতবিক্ষত হয়ে মারা যান। মোটা কাঠের দরজা বা জানলার কাঁচ ঠুকরে ভেঙে পাখিরা সদলবলে মিচের বাড়ির দখল নিতে চায়। তাদের বাধা দিতে গিয়ে রক্তাক্ত হয় মিচ। রাতের বেলা মেলানি চুপিসারে দরজা খুলল পাখিদের অবস্থান দেখতে। কিন্তু ওই সামান্য সময়ে খোলা দরজা দিয়ে পালে পালে পাখি অতর্কিতে মেলানিকে আক্রমণ করে মৃত্যুর দরজায় পৌঁছে দেয়। পাখিদের হাত থেকে অচৈতন্য মেলানিকে উদ্ধার করে সেবা শুশ্রূষায় বাঁচিয়ে তুলে রাত থাকতেই মিচ সপরিবারে পাড়ি জমায় সানফ্রান্সিসকোর উদ্দেশে। সিনেমাটির সমাপ্তি এখানেই। কোনওরকম তথাকথিত সমাপ্তিসূচক ‘এন্ড’ সিনেমাটির শেষে পর্দায় ভেসে ওঠে না। তারার আলোয় ঠিকানা পড়ে মিচদের মহানিষ্ক্রমণেই ঘটে ‘দি বার্ডস’-এর পরিসমাপ্তি।
১৯৬৮তে, ডিক ক্যাভেট শো-তে হিচকক বলেছিলেন এই সিনেমা তৈরির গল্প। পক্ষী-বিশারদ রে বারউইকের তত্ত্বাবধানে ৩২০০ জঙ্গলি কাক-দাঁড়কাক-চড়াই-সিগালকে হুইস্কি সহযোগে কঠোর ট্রেনিং দেওয়া হয়েছিল। লন্ডনের লেস্টার স্কোয়ারের ওডিয়নে ‘দি বার্ডস’-এর প্রিমিয়ারে দর্শকদের অভিবাদন জানাতে দু’টো ফ্লেমিংগো, ৫০টি স্টারলিং-কার্ডিনাল আর ছ’টি পেঙ্গুইনকে সশরীরে উপস্থিত করেছিলেন হিচকক। অস্কার সালার মতো কিংবদন্তী সুরকার থাকলেও, পাখির ডানা ঝাপটানো ও কিচিরমিচির ছাড়া প্রয়োজন পড়েনি আর কোনও যন্ত্রানুসঙ্গের। পুরনো টেপরেকর্ডারের প্লে ব্যাক হেড আর রেকর্ডিং হেডের যুগলবন্দি ও ‘মিক্সট্রটোনিয়ামের’ সাহায্যেই পাখিদের জিঘাংসা সুচারুরূপে ব্যক্ত। সিনেমাটিতে বলা হচ্ছে বিভিন্ন প্রজাতির পাখিরা কখনওই একসঙ্গে জোট বাঁধে না। ‘দি বার্ডস’ কি তবে দাঁড়কাক-কাক-সিগালদের অসংলগ্ন আচরণের গাঁজাখুরি গল্প? বিখ্যাত পত্রিকা ‘ভ্যারাইটি’ সেই কারণেই কি লিখেছিল ‘দি বার্ডস’ Hitch cock and bull story. আর্কটিক সার্কেল কথাটি তিনবার উচ্চারিত ছবিটিতে। পাখিদের অতর্কিত আক্রমণ নাকি রাশিয়ার ‘এরিয়াল অ্যাটাকের’ সমার্থক! পাখিরা নাকি পারমাণবিক বিস্ফোরণের মাশরুম ক্লাউডসের মতোই ঢেকে ফেলছিল বিশ্বচরাচর। পাখির আক্রমণকে বারেবারে বলা হচ্ছে ‘ব্ল্যাক উইন্টার’। চার্চিলের ভাষায় ‘ফ্রজেন নর্থ’। হিচককের মনে হয়েছিল কমিউনিস্টরা ভাইরাসের মতো পশ্চিমী দেশগুলোকে তাদের মতাদর্শে ছারখার করে দেবে! তাই ‘ফরেন বার্ডসের’ উপমা? অথবা হিচকক বঞ্চিত-শোষিত-নিপীড়িতের মুখপাত্র? জিমের হাতে বন্দুক থাকলেও, সে পাখিদের সংঘবদ্ধ আক্রমণের মোকাবিলা করতে পারেনি। পাখিরা ঠুকরে তাকে হত্যা করার পর গোরুরাও তাকে পায়ে মাড়িয়ে চলে যায়। বন্দুকটা পাশে পড়ে থাকে। হিচকক কি দেখাতে চাইলেন সংখ্যাগরিষ্ঠতাই শেষ জয়ে জয়ী! মারণাস্ত্রের সেখানে কোনও ভূমিকা নেই। নাকি পাখিরা বিদ্রোহী মহিলাকুলের প্রতীক? সারাজীবন পুরুষ-শাসিত সমাজে যারা শোষিত-নিপীড়িত।
‘সাইকো’
মা নর্মা আর ‘ডিজঅ্যাসোসিয়েটিভ আইডেনটিটি ডিজঅর্ডারের’ শিকার ছেলে নরম্যানের বিকৃত খুনি মানসিকতার কাহিনী ‘সাইকো’। কাহিনীকার রবার্ট ব্লক। সিরিয়াল কিলার ‘এড গিইন’-এর ছায়াবলম্বনে রচিত সাইকো। সাইকো মুক্তি পায় ১৬ই জুন, ১৯৬০। সাইকোতেও বিন্যস্ত মা-ছেলের অদ্ভুত অসূয়া ‘ইদিপো’ সম্পর্ক, হিচককের বহু ছবিতে যা বারেবারে ঘুরেফিরে এসেছে (দি বার্ডস-এ মা লিডিয়ার সঙ্গে মিচের সম্পর্ক)। ছেলেবেলায় মা নর্মার হাতে বেধড়ক ঠেঙানি খেয়েছে নরম্যান (হিচককও নাকি মায়ে হাতে যারপরনাই নিপীড়িত)। বাবার অকালমৃত্যুর পর মা-ছেলে প্রবল নিরাপত্তাহীনতায় এক পরজীবী সম্পর্কে জড়িয়ে পড়তে থাকে। প্রাপ্তবয়স্ক ছেলে নরম্যানকে (অ্যান্থনি পার্কিনস) মা বোঝাতে থাকেন তিনি ছাড়া পৃথিবীর বাকি সব মহিলাই অশুচি, দেহ-পসারিণী। তাদের সঙ্গে কোনওরকম সম্পর্কই পাপের। ইতিমধ্যে মায়ের জীবনে হঠাৎই এক পুরুষসঙ্গীর আবির্ভাব ঘটে। মা হয়তো তার নতুন সঙ্গীর সামীপ্যে নরম্যানকে ফেলে চলে যাবেন। এই ভয়ে মা নর্মা ও তার নতুন সঙ্গীকে খুন করে নরম্যান। মাতৃহন্তা নরম্যান তলিয়ে যেতে থাকে ‘ডিজঅ্যাসোসিয়েটিভ আইডেনটিটি ডিজঅর্ডারে’র চোরাবালিতে। মা ও ছেলের দু’টো পৃথক সত্তা যুগপৎ নরম্যানের শরীরে-মনে একইসঙ্গে খেলা করে চলে। কোনও মহিলার সান্নিধ্যে এলেই নরম্যানের শরীর থেকে অজান্তেই উদ্গত হয় ১০ বছর আগে মৃত অশরীরী ঈর্ষাকাতর মা, নর্মা।
শনিবার, অকালবৃষ্টির ভয়ানক এক দুর্যোগের রাতে ম্যারিয়ন ক্রেন (জ্যানেট লেই) অ্যারিজোনার ফিনিক্সে তার নিয়োগকর্তার চল্লিশ হাজার ডলার চুরি করে ফেয়ারভেলে, প্রেমিক স্যাম লুমিসের (জন গাভিন) বাড়ির উদ্দেশে ভেগে পড়ে। পথ ভুল করে শ্রান্ত ক্লান্ত শরীরে ‘বেটস মোটেলে’ হাজির হয়। বেটস মোটেলের ১নং ঘরে ঠাঁই হয় ম্যারিয়নের। নরম্যান দেওয়ালের লুকোনো ফুটো দিয়ে ম্যারিয়নের পোশাক পাল্টানো দেখতে থাকে। স্যান্ডউইচ খেতে ম্যারিয়নকে আন্তরিক আমন্ত্রণ জানায়। হঠাৎ কোনও মহিলা নরম্যানকে সাবধান করে ম্যারিয়নের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ না হতে। নরম্যান বলে, মহিলা কণ্ঠটি তার মায়ের। মা চায় না কোনও মহিলার সঙ্গে তার ছেলে ঘনিষ্ঠ হোক। ম্যারিয়ন স্নানঘরে ঢোকে সারাদিনের ক্লান্তি দূর করতে। শাওয়ার চালিয়ে বাথটাবে নামার পূর্বমূহূর্তে এক অজ্ঞাত আততায়ীর উপর্যুপরি ছোরার আঘাতে শাওয়ার কার্টেন ছিঁড়ে বাথরুমের মেঝেতেই লুটিয়ে পড়ে ম্যারিয়ন। দর্শকরা দেখতে পান ত্রস্ত নরম্যান বাথরুমে মৃত ম্যারিয়নকে দেখে আঁতকে উঠে ‘মা, রক্ত রক্ত’ চিৎকার করতে করতে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়চ্ছে। শাওয়ারের অবিরাম জলস্রোতে পাক খেয়ে ধুয়ে যাচ্ছে রক্তের সর্পিল ধারা। তরল চকলেট নির্মিত সাদাকালোয় অবিস্মরণীয় শিহরণ জাগানো দৃশ্যপট। বার্নাড হেরম্যান একটি তরমুজকে বারবার ছোরার আঘাতে ছিন্নভিন্ন করার আসুরিক আওয়াজকে ব্যবহার করে সারা পৃথিবীর দর্শককে আতঙ্কিত করে তুলেছিলেন। হলিউডি সিনেমার ছুৎমার্গ ঝেড়ে প্রথম কমোড ও ম্যারিয়নের নগ্ন স্নান-দৃশ্য দেখানো হয় ‘সাইকো’তে। নরম্যান মৃতদেহটি সাবধানে প্লাস্টিকে মুড়ে ট্রাঙ্কে যাবতীয় জিনিসপত্র ভরে ম্যারিয়নের ‘ফোর্ড কাস্টম ৩০০ ফোরডো’র সেডানের ডিকিতে তুলে নেয়। খবরের কাগজ মোড়া চল্লিশ হাজার ডলারও মৃত ম্যারিয়নের সঙ্গী হয় অজান্তেই। কাছেই একটি পানাপুকুরে ম্যারিয়নের দেহসমেত গাড়িটিকে ডুবিয়ে দেয় নরম্যান। ডুবে যায় চল্লিশ হাজার ডলার। মাতৃরূপী নরম্যানের দ্বিতীয় সত্তা খুন করে ম্যারিয়নকে।
সপ্তাহ কেটে গেলেও ম্যারিয়নের খোঁজ না মেলায়, স্যাম আর ম্যারিয়নের বোন লীলা ক্রেন (ভেরা মাইলস) খোঁজ শুরু করে ম্যারিয়নের। গোয়েন্দা আর্বোগাস্টকে (মার্টিন বেলসাম) দায়িত্ব দেওয়া হয়। আর্বোগাস্ট গন্ধ শুঁকে ‘বেটস মোটেলে’ হাজির হলে নরম্যান তাকেও খুন করে দেহ লোপাট করে দেয়। মরিয়া স্যাম আর লীলা স্বামী-স্ত্রী সেজে ‘বেটস মোটেলে’ সশরীরে উপস্থিত হয়। লীলা একটি বদ্ধ ঘরের দরজা খুলে ১০ বছর আগে নরম্যানের হাতে খুন হওয়া তাঁর মৃত মায়ের জামাকাপড় পরিহিত কঙ্কাল আবিষ্কার করে। নর্মার মাথায় পরানো ছিল লম্বা চুলের একটি পরচুলা। নরম্যান লম্বা চুলের পরচুলাটি মাথায় চাপিয়েই খুন করেছিল ম্যারিয়নকে। অর্থাৎ মায়ের খুনি সত্তাটি ঘাড়ে চাপলেই নরম্যান মাথায় পরে নিত পরচুলাটি। রাতারাতি রূপান্তরিত হতো মা নর্মায়। খুন করার পর হয়ে যেত নির্ভার-নিশঙ্ক। কৃতকর্মের জন্য কোনও আফশোস বা অপরাধবোধ থাকত না। কারণ তখন তার মন ও মস্তিষ্ক তাকে বোঝাত খুনটা সে করেনি, করেছে তার মা। পুলিশের হেফাজতে জেলবন্দি নরম্যানকে দর্শক দেখেন মায়ের মেয়েলি কণ্ঠে সওয়াল করতে। ছেলে নরম্যান যে নিরপরাধ। ডুবে যাওয়া গাড়িটিকে পানাপুকুর থেকে টেনে তোলার দৃশ্যের মাধ্যমে ছবিটি সমাপ্ত হয়। নিউইয়র্ক-শিকাগো-বোস্টন-ফিলাডেলফিয়ায় ‘সাইকো’ পর্দায় শুরু হয়ে গেলে কাউকে ঢুকতে দেওয়া হতো না। হিচকক লিখে দিয়েছিলেন, স্বয়ং আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বা ইংল্যান্ডের রানী ছবি শুরু হওয়ার একমিনিট পরে এলে তাঁদেরকেও ঢুকতে দেওয়া হবে না। টানটান উত্তেজনায় সর্বক্ষণ দর্শককে শিহরিত রাখতে হিচকক নাকি ‘সাইকো’ উপন্যাসটির সবকটি কপিও কিনে নিয়েছিলেন।
বাঘা সমালোচকদের মতে, হিচকক ঋণী ফ্রয়েডের কাছে। মানুষের মানসিক অবস্থার মূল্যায়নে ফ্রয়েড ইড-ইগো-সুপারইগোর কথা বলেছিলেন। যাবতীয় ঘৃণ্য অপরাধ নরম্যান করেছিল তার মায়ের সত্তায় বা ইডে। আবার মায়ের সঙ্গে অসূয়া ‘ইদিপো’ সম্পর্কে জাগ্রত তার সুপারইগো। মাকে ছাড়া দৈনন্দিন জীবনে সে অসম্পূর্ণ। ইড-সুপারইগোর টানাপড়েনে নরম্যানের স্ব-সত্তা, ‘ইগো’, তাকে সুস্থ জীবনের পথে চালাতে অপারগ। অর্থাৎ পরাজিত ‘ইগো’।
ভার্টিগো
গাভিন এলস্টার (টম হেলমোর) তাঁর কলেজের বন্ধু অবসরপ্রাপ্ত গোয়েন্দা, জন ‘স্কটি’ ফার্গুসনকে (জেমস স্টুয়ার্ট), তাঁর স্ত্রীর এক অদ্ভুত অস্বাভাবিকতার কথা বলে। স্ত্রী ম্যাডেলিন এলস্টার (কিম নোভাক) সবসময় যেন ঘোরের মধ্যে থাকে। বহুকাল আগে আত্মহত্যা করে মারা যাওয়া ম্যাডেলিনের দিদিমা কার্লোটা সর্বদা যেন ভর করে থাকে ম্যাডেলিনকে। দিদিমার মতো সাজপোশাক, এমনকী দিদিমার গলায় রুবির লকেটটাও সবসময় ম্যাডেলিন পরে থাকে। তন্বী সুন্দরী ম্যাডেলিন দিদিমার ছায়া কেটে কিছুতেই বেরোতে পারে না। ২৬ বছরে দিদিমা কার্লোটা নিজেকে শেষ করেছিলেন। গাভিন হিসেব করে দেখেন, ম্যাডেলিনের বয়সও ২৬। ম্যাডেলিন মাঝেমধ্যেই যেন পূর্বজন্মে ফিরে যায়। দিদিমা কার্লোটা ভ্যালডেসের ফটোর সামনে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটায় বাহ্যজ্ঞান লুপ্ত হয়ে। স্টুয়ার্ট ক্রমশঃ ম্যাডেলিনের সৌন্দর্যে আসক্ত হতে থাকে। সানফ্রান্সিসকোর গোল্ডেন গেট ব্রিজের কাছে ফোর্ট পয়েন্টের সমুদ্রে ম্যাডেলিন আত্মহত্যা করতে ঝাঁপিয়ে পড়ে, স্টুয়ার্ট লাফিয়ে পড়ে বাঁচায় তাকে।
স্টুয়ার্টের এক অদ্ভুত অসুখ ছিল। ভার্টিগো (অ্যাক্রোফোবিয়া)। সিঁড়িতে বা কোনও উঁচু জায়গায় স্টুয়ার্ট উঠতে পারত না। তার এই অসুস্থতার কারণেই তাকে বাধ্যতামূলক অবসর নিতে হয়। একদিন সান জুয়ান বাটিসটা চার্চের বেল টাওয়ারে উঠতে থাকে ম্যাডেলিন। ভার্টিগোর কারণে স্টুয়ার্ট ম্যাডেলিনকে অনুসরণ করতে পারে না। হঠাৎ ম্যাডেলিন বেল টাওয়ারের চূড়া থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করে। ম্যাডেলিনকে বাঁচাতে না পারার অপরাধে গুমরে মরে স্টুয়ার্ট। কিছুদিন বাদে কানসাসের, সালিনার জুডি বার্টনের মধ্যে হুবহু যেন ম্যাডেলিনকেই আবিষ্কার করে স্টুয়ার্ট। নাছোড় স্টুয়ার্ট জুডিকে ম্যাডেলিনের মতো সাজতে বাধ্য করে। মাথার চুল থেকে সবুজ রঙের স্কার্টে জুডি যেন অবিকল ম্যাডেলিন। কিন্তু ম্যাডেলিনের রুবির নেকলেসটা জুডি পেল কোথা থেকে? স্টুয়ার্টের মনে সন্দেহ জাগে। কে এই জুডি?
আসলে বহুকাল আগেই গাভিন তার স্ত্রী ম্যাডেলিনকে খুন করে, পয়সা দিয়ে জুডিকে ম্যাডেলিন সাজায়। আর স্টুয়ার্টকে দায়িত্ব দেয় ম্যাডেলিনের আচরণ শোধরানোর। যাতে পুলিসের চোখে ধুলো দিয়ে শাস্তি এড়ানো যায়। গাভিন জানত স্টুয়ার্টের ‘ভার্টিগোর’ কথা। জানত বেল টাওয়ারের চূড়ায় স্টুয়ার্ট উঠতে পারবে না। তখন পরিকল্পনামাফিক জুডির পরিবর্তে ম্যাডেলিনের একটা ম্যানিকুইন মাটিতে ফেলে দিয়ে গল্প ফাঁদবে আত্মহত্যা করেছে ম্যাডেলিন। সাক্ষী হিসেবে হাজির করবে স্টুয়ার্টকে। গোটা পরিকল্পনাটাই নিখুঁত ভাবে ছকেছিল গাভিন। কিন্তু ম্যাডেলিন ওরফে জুডি সত্যিই ভালোবেসে ফেলে স্টুয়ার্টকে। কারণ জুডিও ছিল নিঃসঙ্গ। স্টুয়ার্টের মনোযোগ, ভালোবাসায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ছিল জুডি। গোয়েন্দা স্টুয়ার্ট যখন গোটা ঘটনাটার পুনর্নির্মাণে জুডিকে নিয়ে বেল টাওয়ারে ওঠে, স্টুয়ার্টকে প্রতারণার আত্মগ্লানিতে সত্যি সত্যিই বেল টাওয়ারের চূড়া থেকে লাফিয়ে আত্মহত্যা করে জুডি। দু’ দুবার প্রিয়তমাসুকে হারিয়ে স্টুয়ার্ট মুক্তি পেল ভার্টিগো থেকে।
এডগার অ্যালান পো-র ‘দি ফল অব দি হাউস অব আসার’-এর কেন্দ্রীয় চরিত্রটির নাম ম্যাডেলিন আসার। ম্যাডেলিন এলস্টার আর ম্যাডেলিন আসার দু’জনেই ‘মরিয়া প্রমাণ করিল যে তারা মরে নাই’। দু’জনেই একটি পুরুষে বেদম মোহগ্রস্ত। পুরুষটির মর্জিমাফিক জুডি, ম্যাডেলিন এলস্টার বা আসাররা তাদের খোলনলচে বদলে ফেলতে বাধ্য হয়, বারেবারে। সাজগোজ, চলনবলনে নিজেদের অজান্তেই পুরুষটির ইচ্ছাপূরণের সঙ্গী হয়ে ওঠে।
গ্রাফিক্স: সোমনাথ পাল
সহযোগিতায়: স্বাগত মুখোপাধ্যায়