পেশাদারি উচ্চশিক্ষায় দ্রুত অগ্রগতি ও সেই সূত্রে কর্মপ্রাপ্তির সুবর্ণ সুযোগ আসতে পারে। মিত্রবেশী শত্রু দ্বারা ... বিশদ
প্রথমে বিগত এক বছর ধরে সভা, সমাবেশ, সরকারি, বেসরকারি অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীসহ
ভারত সরকারের নীতি নির্ধারকরা অত্যন্ত নিয়ম করে উচ্চকিত কণ্ঠে বলছিলেন, ২০১৪ সাল থেকে এ পর্যন্ত গত ১০ বছরে ২৫ কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার উপরে উঠে এসেছে। অর্থাৎ ২৫ কোটি মানুষকে
তুলে আনা সম্ভব হয়েছে গরিবি থেকে। এটা সুশাসনের প্রমাণ। কিন্তু একটানা এই প্রচার করার পরও
যদি দেশবাসীর বিশ্বাস না হয়? কারণ হাজার হোক সরকার এবং সরকারের মন্ত্রীরা তো নিজেদের সাফল্য প্রমাণ করতে এরকম দাবি করতেই পারেন! মানুষ তো ভাবতেই পারে এসব দাবির প্রমাণ কী? মিথ্যাও তো হতে পারে!
তাই এরপর এসেছে পরবর্তী ধাপ। হঠাৎ গত বছরের শেষভাগে প্রধানমন্ত্রীর একটি সরকারি অনুষ্ঠানের প্রাক্কালে স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার রিসার্চ সমীক্ষার একটি রিপোর্ট প্রকাশ করা হল। দেশের আর্থ সামাজিক কিংবা শিল্প অথবা শিক্ষা সহ নানাবিধ বিষয়ে এই এসবিআই রিসার্চ মাঝেমধ্যেই রিপোর্ট প্রকাশ করে। ওই রিসার্চে হঠাৎ এসবিআই কী বলল? বলল, ২০২৩ সালের তুলনায় ২০২৪ সালে গ্রামীণ ভারতের দারিদ্র্য ৪.৮৬ শতাংশ কমে গিয়েছে। আর শহরে গরিব মানুষের সংখ্যা কমেছে ৪ শতাংশ।
ঠিক তারপরই প্রধানমন্ত্রী সেই এসবিআই রিসার্চকে উদ্ধৃত করে বললেন, এই তো আমরা একাই বলছি না, এসবিআই রিপোর্ট পর্যন্ত বলেছে যে, ভারতে কীভাবে দ্রুত কমে চলেছে গরিব মানুষের সংখ্যা। তারপর থেকে ভারত সরকার বারংবার ওই রিপোর্টই প্রচার করে চলেছে। এসবিআই রিপোর্ট যে এই দাবি করল, তার ভিত্তি কী? কীভাবে বোঝা গেল যে এই চরম মূল্যবৃদ্ধি আর বেকারত্বের যুগে গরিব মানুষের সংখ্যা হু হু করে কমে যাচ্ছে? দেখা যাক এসবিআই রিসার্চের প্রক্রিয়াটি কী!
এসবিআই রিসার্চ মানদণ্ড স্থির করে জানিয়েছে, যে পরিবার মাসে ১৬৩২ টাকার কম খরচ করে তারা গরিব। এটা গ্রামীণ ভারতের হিসেব। আর শহুরে ভারতে যে পরিবারের ব্যয়ক্ষমতা ১৯৪৪ টাকার বেশি নয়, তারাই গরিব। এই নীতির নাম অ্যানুয়াল হাউসহোল্ড কনজামশান। অর্থাৎ বছরে একটি পরিবার যা খরচ করে। তার মানে হল, একদিনে গ্রামীণ ভারতের যে পরিবার ৫৫ টাকা খরচ করে তারা গরিব। শহরে যারা ৬৫ টাকার মধ্যে খরচ করবে তারাও গরিব। তাহলে কি এই অঙ্কের বেশি যারা খরচ করতে পারে তারা গরিব নয়? হাউসহোল্ড কনজামশন এক্সপেন্ডিচার সার্ভের এই রীতি নিয়ে তাবৎ অর্থনীতিক মহল প্রশ্ন তুলছে। তাদের বক্তব্য, মূল্যবৃদ্ধি, টেন্ডুলকর কমিটির দারিদ্র্যসীমা সংক্রান্ত রিপোর্ট ইত্যাদিকে ভিত্তি করে এই যে গরিবের মাপকাঠি তৈরি হয়েছে এটা ত্রুটিপূর্ণ। এভাবে ২০২৪ সালের গরিব নির্ধারণ করা যায় না।
কিন্তু এসব যুক্তি ভারত সরকার মানতে নারাজ। তারা খুশি এবং এই রিপোর্ট গ্রহণ করেছে অত্যন্ত আনন্দ সহকারে। আর তাই প্রচারও চলছে জোরকদমে। সুতরাং নিত্যদিনের খাবার কেনার জন্য ৬৫ টাকার বেশি যাঁরা ব্যয় করতে সক্ষম তাঁরা আর গরিব নয়। এটাই রাষ্ট্র এখন মনে করছে।
খুব ভালো কথা। রাষ্ট্র এই মনোভাব নিয়ে সন্তুষ্ট হতেই পারে। কিন্তু সেক্ষেত্রে আর একটি সমীক্ষা ভুলে গেলে চলবে না। ভারতে ২০২৪ সালে ২১ কোটি মানুষ দিনে আয় করেন ১০০ টাকার কম। তাঁদের মাসিক আয় তাহলে কত? তাঁরা কত টাকা চাল, ডাল, তেল, সব্জি ও আমিষ কিনতে ব্যয় করতে পারবেন? এই হিসেবের সমাধান কী? তাঁদের জীবন কীভাবে চলে? তাঁদের মধ্যে গরিব কারা? কারা গরিব নয়? কঠিন অঙ্ক।
মোটামুটি প্লট নির্মাণ করা হয়েছে। এবার চিত্রনাট্যের পরবর্তী ধাপ কী? সেটা দেখা গেল ১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ সালের বাজেটে। কী দেখা গেল? দেখা গেল, বহু বছর পর হঠাৎ মধ্যবিত্তের জন্য ভারত সরকার উদারহস্ত। কল্পতরুর মতো একঝাঁক আয়করে ছাড় দিয়ে দিয়েছে। এই নিয়ে প্রবল প্রচার আর চর্চার আড়ালে সরকারের বাজেট বরাদ্দের কাগজপত্র পর্যালোচনা করে দেখা গেল, বাজেটে অর্থমন্ত্রী তিনটি তাৎপর্যপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
১) কৃষিকার্যে ব্যবহৃত সারের উপর সরকার যে ভর্তুকি দেয়, সেই সারে ভর্তুকি কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। ১ লক্ষ ৭১ হাজার কোটি টাকা দেওয়া হয়েছিল ২০২৪ সালে। সেটা ২০২৫ সালে দেওয়া হবে ১ লক্ষ ৬৭ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ কৃষকদের চড়া মূল্যের সার কিনতে নিজেকে বেশি খরচ করতে হবে।
২) খাদ্যে বরাদ্দ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। খাদ্যে সবথেকে বেশি বরাদ্দ কী কারণে করতে হয়? গরিব কল্যাণ যোজনায় গরিবকে রেশনে বিনামূল্যে চাল-গম দিতে। সেই বরাদ্দ কমিয়ে দেওয়া হল কেন? কারণ ওই যে এতদিন ধরে আমাদের বলা হয়েছে যে, গরিব কমে গিয়েছে! গরিব যদি কমেই যায়, তাহলে বিনামূল্যে চাল গম কম দিতে হবে!
৩) ১০০ দিনের কাজে বরাদ্দ ৮৬ হাজার কোটি টাকা। যা ২০২৪ সালেও ছিল। অর্থাৎ বরাদ্দ এক টাকাও বাড়ল না। জনসংখ্যা বাড়ছে। মূল্যবৃদ্ধি বাড়ছে। বেকারত্ব বাড়ছে। স্বাভাবিকভাবেই ১০০ দিনের কাজের চাহিদা বাড়ছে। তাহলে বরাদ্দ বাড়ানো হল না কেন? কারণ পৃথকভাবে আর একটি উপকাহিনি রচিত হয়ে চলেছিল বিগত তিন বছর ধরে। সেটি হল, হঠাৎ দেখা যাচ্ছে ১০০ দিনের কাজের প্রকল্পে জব কার্ড বাতিল করে দেওয়া হচ্ছে হু হু করে। নানাবিধ করণে। আধার লিংক করা হয়নি কেন? অথবা টেকনিকক্যাল কোনও কারণে ওই জব কার্ড আর বৈধ নয়। কিংবা জাল জব কার্ড ধরা পড়ছে। কত করে জব কর্ড বাতিল হচ্ছে। ২০২৪ সালের এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর, মাত্র ৬ মাসে ৮৪ লক্ষ জব কার্ড বাতিল। তাহলে তিন বছরে কত বাতিল হয়েছে? কয়েক কোটি। কিন্তু নতুন করে জব কার্ড তো ইস্যুও করা হয়? হ্যাঁ হয়। কিন্তু দেখা যায়, যতগুলি নতুন নাম নথিভুক্ত হয়, ততগুলি বা তার থেকে বেশি নাম বাদ চলে যাচ্ছে। তাহলে কী হয়? তাহলে আর ১০ দিনের কাজের চাহিদার সংখ্যা বাড়ছে না। যত যুক্ত হচ্ছে, ততই বাতিল হচ্ছে অন্যদিক থেকে। সংখ্যা হয় কমছে, অথবা একই থাকবে। তাহলে? তাহলে আর বেশি টাকা বাজেটে বরাদ্দ করতে হবে কেন? আবেদনকারীর সংখ্যা তো বাড়বে না নিশ্চিত!
তাহলে মোটামুটি কী দাঁড়ালো? এক বছরে ধরে প্রথমে প্রচার করা হল, গরিবের সংখ্যা কমেছে। তারপর সেটা প্রমাণ করার জন্য এসবিআই রিসার্চ রিপোর্ট দিল। তারপর গরিবকে বিনামূল্যে চাল-গম দেওয়ার বাজেট বরাদ্দ কমিয়ে দেওয়া হল। কারণ কাগজে কলমে গরিব কমে গিয়েছে। কৃষকদের বছরে তিনবার ২ হাজার টাকা করে ভাতা দেওয়া হচ্ছে। সেটা জোরদার প্রচার পাচ্ছে। কিন্তু সারে ভর্তুকি কমে গেল! সেই প্রচার ধামাচাপা থাকছে। ১০০ দিনের কাজের বরাদ্দ বাড়ছে না। কারণ আবেদনকারীর সংখ্যা বাড়তে দেওয়া হচ্ছে না।
এই নিখুঁত প্ল্যানে লাভ কার? রাজকোষ থেকে জনকল্যাণমুখী প্রকল্পে সরকারের খরচ কমে যাওয়া। আর তাহলেই বাজেট ঘাটতি কমে যাবে! রাজকোষে টাকা রয়ে যাবে। সেই টাকায় কী করা যাবে? কর্পোরেটের ট্যাক্স মকুব করা যাবে! বাজেট পেপারের একটি অংশে একটি বিভাগ থাকে। তাকে বলা হয় রেভিনিউ ফোরগন। মানে কর্পোরেটকে কর মকুব করতে সরকারের কত টাকা লোকসান হয়েছে? পাঁচ বছরে কত সেই অঙ্ক? ৪ লক্ষ ৬৯ হাজার কোটি টাকা!
গরিবের সংখ্যা কমলে কম খরচ করা যাবে। কম খরচ করলে রেভিনিউ ফোরগনের টাকা জোগাড় করা যাবে। সুতরাং নিপুণ চিত্রনাট্য! নিখুঁত ক্ষতিপূরণ!