প্রায় সম্পূর্ণ কাজে শেষ মুহূর্তে বাধা পড়ায় বিচলিত হয়ে পড়তে পারেন। সন্তানের বিদ্যা শিক্ষার বিষয়ে ... বিশদ
আগামী ১০ ফেব্রুয়ারি সুপ্রিম কোর্টে ২০১৬ সালে নেওয়া শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষার প্যানেল বাতিলের শুনানি হবে। ওই দিনই শুনানি প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। এর আগে নিয়োগ দুর্নীতি ইস্যুতে হাইকোর্ট ‘ঢাকি সহ বিসর্জন’ দিয়েছিল। বাতিল করে দিয়েছিল প্যানেলটাই। একলপ্তে ২৬ হাজার শিক্ষকের চাকরি গিয়েছিল। বিকাশবাবু সেই বাতিলের পক্ষেই জোরদার সওয়াল করে যাচ্ছেন। আদালতে তিনি দাবি করেছেন, ‘পুরো নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়েই প্রশ্ন রয়েছে। গোটা প্রক্রিয়াটা বিতর্কিত। অনেকে আবেদন না করেই চাকরি পেয়ে গিয়েছেন। তাই গোটা প্যানেল বাতিল করা উচিত।’
সুপ্রিম কোর্টে বিকাশবাবুর এই সওয়াল এখন রাজ্য রাজনীতির অন্যতম চর্চার বিষয়। অনেকে বলছেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারকে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্যই সিপিএম শিক্ষক, শিক্ষিকাদের চাকরি খেতে চাইছে। সেই কাজে বিকাশবাবুই তাদের প্রধান হাতিয়ার। তিনি শুধু প্রতিষ্ঠিত আইনজীবীই নন, সিপিএমের রাজ্যসভার সাংসদও। খোলসা করে বলতে গেলে, বামপন্থী বুদ্ধিজীবীদের একেবারে প্রথম সারিতে বিকাশবাবুর অধিষ্ঠান। অনেকে বিশ্বাস করেন, তাঁর জন্যই নিয়োগ দুর্নীতি মামলা এই জায়গায় পৌঁছেছে। সিপিএম নেতৃত্বও বিকাশবাবুর সরকার বিরোধী আইনি লড়াইকে তাদের ‘সাফল্য’ বলে দাবি করে এসেছে।
একথা ঠিক, একেবারে গোড়ার দিকে এই মামলা রাজ্যের চাকরি প্রার্থী বেকার যুবক যুবতীদের মধ্যে যথেষ্ট প্রভাব ফেলেছিল। তাঁরা আশার আলো দেখেছিলেন। ভেবেছিলেন, এই মামলার ফলে তাঁরা চাকরি পেয়ে যাবেন। কিন্তু দিন যত যাচ্ছে, তাঁদের মধ্যে হতাশা ততই বাড়ছে। কারণ নিয়োগ নিয়ে শুধু কাদা ছোড়াছুড়িই হচ্ছে। চাকরি হচ্ছে না। তাতে অনেকেরই ধারণা হয়েছে, মুখে বেকারদের জন্য লড়াইয়ের কথা বলা হলেও সবটাই রাজনীতি। বেকাররা রাজনীতির কারবারিদের দাবার বোড়ে হয়ে গিয়েছেন। জট কাটিয়ে নিয়োগ শুরুর রাস্তা কেউ খুলতে আগ্রহী নয়। বরং জট আরও পাকিয়ে দিচ্ছে। তাতে কোনও কোনও আইনজীবীর ব্যক্তিগত ক্যারিশ্মা উজ্জ্বল হচ্ছে বটে, কিন্তু লক্ষ লক্ষ মেধাবী ছেলেমেয়ের ভবিষ্যৎ অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছে। আইনি লড়াইয়ের জেরে বহু যুবক-যুবতীর চাকরির বয়স পেরিয়ে যাচ্ছে। তাঁদের প্রশ্ন, মানুষের জন্য আইন, নাকি আইনের জন্য মানুষ?
রাজ্যের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসও মনে করে, বিকাশবাবুদের জন্যই এ রাজ্যে শিক্ষক নিয়োগের জট কাটছে না। খোদ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একাধিকবার এই অভিমত ব্যক্ত করেছেন। তিনি বারবার বলেছেন, সরকার চাকরি দেওয়ার জন্য তৈরি। কিন্তু আদালতে মামলা চলায় নিয়োগ করা যাচ্ছে না।
শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী নিয়োগ নিয়ে যে দুর্নীতি হয়েছে, সেটা স্কুল সার্ভিস কমিশনও স্বীকার করেছে। প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী দুর্নীতিতে অভিযুক্ত হয়ে জেলে আছেন। সিবিআই তদন্ত চলছে। এসবই ঠিক। কিন্তু দুর্নীতি হয়েছে বলে নিয়োগ বন্ধ রাখাটা সমাধানের রাস্তা হতে পারে না। আন্দোলনকারী চাকরি প্রার্থী থেকে সাধারণ ছাত্রছাত্রী সকলেই চাইছেন, এবার একটা হেস্তনেস্ত হোক। বিশেষ করে যাঁরা প্রচুর নম্বর নিয়ে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি অতিক্রম করেছেন, তাঁরা। কারণ পাশ করার পর শিক্ষক নিয়োগের কোনও পরীক্ষায় বসার সুযোগই পাননি। তারজন্য এই আইনি জটিলতাকেই তাঁরা দায়ী করছেন।
ফলে শুধু সরকার নয়, যাঁরা নানা কৌশলে নিয়োগের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছেন, তাঁদের উপরেও ব্যাপক ক্ষোভ তৈরি হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে ২৬ হাজার শিক্ষক শিক্ষিকার চাকরি বাতিল হলে সিপিএমের লাভের চেয়ে ক্ষতিই বেশি হবে। আর জি কর কাণ্ডের অপপ্রচারের দায় যেভাবে তাদের ঘাড়ে চাপতে শুরু করেছে, নিয়োগ জটিলতার বোঝাও একদিন তাদেরই বইতে হবে। সম্ভবত আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের ম্যানেজাররাও সেটা বুঝতে পারছেন।
এতদিন বিকাশবাবুর লড়াইয়ের ক্ষীর সিপিএমই খাওয়ার চেষ্টা করেছে। শিক্ষক নিয়োগ থেকে আর জি কর কাণ্ড, প্রতিটি ঘটনাকেই ‘প্রাতিষ্ঠানিক অপরাধ’ প্রমাণে সিপিএম মরিয়া। ত্রিপুরায় সিপিএমের রাজত্বে দুর্নীতির কারণে ১০ হাজার শিক্ষক-শিক্ষিকার চাকরি আদালত খারিজ করে দিয়েছিল। তারজন্য স্বচ্ছতার ধ্বজাধারী সিপিএমকে এখনও কটাক্ষ শুনতে হয়। বাংলায় ২৬ হাজার চাকরি বাতিল হলে সেই ক্ষতে কিছুটা হলেও প্রলেপ পড়বে। সেই আশাতেই সুপ্রিম কোর্টে বিকাশবাবুর প্যানেল বাতিলের পক্ষে সওয়ালের খবরটি সিপিএমের মুখপত্র ‘গণশক্তি’ পত্রিকার প্রথম পাতায় যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে ছাপা হয়েছে। তবে, তা নিয়ে রাজ্যজুড়ে সমালোচনা শুরু হতেই সিপিএম ব্যকফুটে।
বছরের পর বছর চাকরি আটকে রাখার বিষয়টি শুধু সাধারণ মানুষই নয়, সিপিএমের কর্মী সমর্থকরাও ভালোভাবে নিচ্ছেন না। কট্টর পার্টি মেম্বার ছাড়া সাধারণ কর্মী, সমর্থকদের কাছে রাজনীতির চেয়েও জীবনে প্রতিষ্ঠা লাভই বড়। তাঁরাও চাইছেন, যেকোনও শর্তে নিয়োগ প্রক্রিয়া চালু হোক। কারণ রাজ্যে প্রায় ৬০০০ স্কুল চলছে যেখানে শিক্ষকের সংখ্যা মাত্র এক। বহু শূন্যপদ খালি থাকায় ঠিকমতো পড়াশোনা হচ্ছে না। বহু স্কুলে প্যারাটিচার এবং অতিথি শিক্ষকই ভরসা। স্থায়ী শিক্ষক নিয়োগ হলে সরকারের আর্থিক দায় অনেকটাই বেড়ে যেত। সেক্ষেত্রে সরকারের ভিত মজবুতকারী সামাজিক প্রকল্পগুলি চালাতে সমস্যা হতো বলে সিপিএমের অনেকেই করছেন। তাই চাকরি আটকে রেখে সরকারকে টাইট দেওয়ার নীতি তাঁরা ভুল বলে মনে করছেন।
সিপিএমের শীর্ষ নেতৃত্ব মনে করেছিল, বছরের বছর নিয়োগ না হলে, ডিএ না বাড়লে সরকারি কর্মী ও সাধারণ মানুষের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হবে। ক্ষোভের ধাক্কায় মমতা সরকারের পতন হবে। কিন্তু, ভাবনাটা একেবারেই ভুল। যখন ব্যালট পেপারে নির্বাচন হতো তখন গণনার সময় শিক্ষক, সরকারি কর্মীদের বিশেষ ভূমিকা ছিল। কাউন্টিংয়ে দেদার জল মেশানো যেত। তাই মাসপয়লা বেতন দিতে না পারলেও বামফ্রন্ট সরকার একপ্রকার রুটিন করে বেতন বাড়িয়ে গিয়েছিল। সিপিএম বুঝেছিল, সাধারণ মানুষ বিরূপ হলেও ক্ষতি নেই। সমস্ত ঘাটতি কাউন্টিংয়ের সময় পূরণ হয়ে যাবে। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজত্বে তাঁরা কেবলই ভোটার, ভোটের নিয়ন্ত্রক নন। এখন ভোটের প্রকৃত নিয়ন্ত্রক গরিব মানুষ। সামাজিক প্রকল্পের জোরে তাঁরাই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ভোটব্যাঙ্ক’। তার প্রমাণ প্রতিটি নির্বাচনে তৃণমূলের বিপুল জয়।
আলিমুদ্দিনের কর্তারাও টের পাচ্ছেন হাইকোর্টের রায় দেশের সর্বোচ্চ আদালত বহাল রাখলে
ক্ষোভের উত্তাপ তাঁদের সহ্য করতেই হবে। তাই বিকাশবাবুর চাকরি বাতিলের সওয়াল নিয়ে চর্চা
শুরু হতেই সিপিএম নেতৃত্ব তাদের ছাত্র ও শিক্ষক সংগঠনকে ময়দানে নামিয়ে দিয়েছে। এসএফআই নেতারা দাবি করছেন, বিকাশবাবু আদালতে যা বলেছেন সেটা একজন আইনজীবীর কথা। তাঁরা গোটা প্যানেল বাতিলের পক্ষে নন। যোগ্য ও অযোগ্য বাছাই করা হোক।
তবে, এসএফ আইয়ের এই খবরটি ‘গণশক্তি’ পত্রিকায় তেমন গুরুত্ব পায়নি। খবরটির জায়গা হয়েছে তিনের পাতায়। এসএফআই ও এবিটিএকে দিয়ে প্রতিবাদ করিয়ে সিপিএম আগাম একটা বাঁধন দিয়ে রাখল। তাতে চাকরিহারাদের ক্ষোভের বিষ মাথায় ওঠার উপক্রম হলেই বিকাশবাবুকে ‘আইনজীবী’ হিসেবে পাশে সরিয়ে রেখে, ‘এটা পার্টির স্ট্যান্ড ছিল না’ বলে চালিয়ে দেবে।
নিয়োগ দুর্নীতি ইস্যুতে সিপিএম দু’মুখো নীতি নিয়েছে। একদিকে বিকাশবাবুকে সামনে রেখে ‘প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি’ প্রমাণ করে ২৬ হাজার শিক্ষক-শিক্ষিকার চাকরি খেতে চাইছে। অন্যদিকে ছাত্র ও শিক্ষক সংগঠনকে দিয়ে তার বিরোধিতা করাচ্ছে। এটাই সিপিএমের ‘সাপ হয়ে কামড়াব, ওঝা হয়ে ঝাড়ব’ পলিসি। এই সুবিধাবাদী নীতির জন্যই সিপিএম দিনদিন অতলে তলিয়ে যাচ্ছে। এদের উদ্ধারের ক্ষমতা স্বয়ং ঈশ্বরেরও নেই।