অংশীদারি কারবারে মন্দার সম্ভাবনা। যে কোনও কাজকর্মে বাধার মধ্যে উন্নতি। বৃত্তিগত শিক্ষা লাভে বিশেষ সাফল্য। ... বিশদ
কয়েকটা মাত্র ঋণের টাকার জন্য কৃষকের সম্মান ধুলোয় মিশিয়ে দিচ্ছে রিকভারি এজেন্ট। হাতজোড় করছে সে। একটু সময় চাইছে। কিন্তু সময়ই যে নেই ওই গরিব মানুষটার জন্য! শোধ করতে না পেরে আত্মহত্যা করেছে সেই কৃষক। ছবিটা ফুটে উঠছে মাল্টিপ্লেক্সের বড় স্ক্রিনে। রান্না সেরে, ভেজা জামাকাপড় তুলে, শাশুড়িকে ওষুধ খাইয়ে পড়িমড়ি সিনেমা হলে এসে বসা গৃহবধূর চোখে জল। পাশে কাঁদছে তাঁর বছর দশেকের ছেলেও। রাগে। ‘মা, মানুষ এত্ত খারাপ হয়?’ সমাজের বাস্তব ফুটিয়ে তুলছে সিনেমা। বার্তা দিচ্ছে, শেখাচ্ছে, সারাদিনের স্ট্রেস থেকে মুক্তি দিচ্ছে, ভুলিয়ে রাখছে নিত্যদিনের ওঠাপড়া। এই দেশকে বাঁধছে এক সুতোয়। ভারতের ধর্ম তাই সিনেমাও।
কিন্তু সংবিধানের ৭৫ বছর পূর্তিতে উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ একটি নতুন শব্দবন্ধ ব্যবহার করেছেন—জাতীয় ধর্ম। ‘কৌতূহল উদ্রেক করিবার’ মতো ব্যাপার বটে। এতকাল আমরা শুনে এসেছি জাতীয় সঙ্গীত, জাতীয় পশু, জাতীয় পাখি। কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষ ভারতে জাতীয় ধর্ম? হজম না হওয়ারই কথা। এই দেশে খানিক পড়তে-লিখতে শিখলেই সবার আগে শেখানো হয় ‘বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যে’র কথা। অর্থাৎ, নানা ভাষা, নানা আচার, নানা পরিধান... এবং অবশ্যই নানা ধর্ম। এই সব বৈচিত্র্য মিলেই ভারত। আমরা সবাই সবার ধর্মকে, ধর্মীয় আচরণকে সম্মান করব। এই সুতোতেই গড়ে উঠবে ঐক্য। ১৪০ কোটির দেশে একটি ধর্মকে বাড়তি গুরুত্ব দেওয়া মানে তাকে বুঝিয়ে দেওয়া, ‘ওহে তুমি প্রিভিলেজড ক্লাস।’ আর বাকিদের মনে করিয়ে দেওয়া, ‘তোমরা ভাই আশ্রিত। আমাদের দয়ায় বেঁচে আছ।’ ভারতের সংবিধান কি আমাদের সেই অধিকার দেয়? না, দেয় না। তাহলে যোগী হঠাৎ এমন একটা মন্তব্য করলেন কেন?
স্কুল-কলেজের স্তর পেরিয়ে এলে প্রতিযোগিতা আর শুধু খাতার উপর লাল কালির নম্বরে আটকে থাকে না। কঠোর বাস্তবের প্রতিযোগিতায় দু’রকমের পথ থাকে। প্রথম, আগে যে আছে তাকে টপকে চলে যাওয়া। আর দ্বিতীয়, সমান্তরালে এগিয়ে যাওয়া। তাতে এগিয়ে থাকা প্রতিযোগীকে সরাসরি আঘাত করা হল না, অথচ তাকে ছাপিয়েও যাওয়া গেল। যোগী আদিত্যনাথ এই দ্বিতীয় পন্থা নিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর রেস যত ঘনিয়ে আসছে, তিনি ততই নিজের জমি শক্ত করার লক্ষ্যে মন দিচ্ছেন। কুম্ভমেলা আয়োজনে যত না জাঁক তিনি করেছেন, তার থেকে বেশি প্রচার হয়েছে। নরেন্দ্র মোদির পোস্টার ঢাকা পড়ে গিয়েছে তাঁর ছবিতে। নরেন্দ্র মোদিকে ছাপিয়ে ঘরে ঘরে হানা দিচ্ছে যোগীর মেরুকরণ রাজনীতির উগ্রতা। দিল্লিতে দাঁড়িয়ে অমিত শাহের আইন-শৃঙ্খলাকে ব্যর্থ বলে দেগে দিচ্ছেন। আর হিন্দুত্বকে নিয়ে আসছেন ‘জাতীয়’ ক্যাটিগরিতে। বলতেই হবে, প্রত্যেকটা ভাবনা তাঁর ‘ইউনিক’। যোগী জানেন, কী করলে শিরোনামে আসা যাবে। কী করলে প্রশাসক হিসেবে মানুষ তাঁকে সমীহ করবে। আর কী করলে সঙ্ঘের কাছে তিনি একমাত্র ‘চয়েজ’ হিসেবে জায়গা করে নিতে পারবেন। তাই যোগী ছুটছেন সামনের দিকে। আর ভারত? পিছনে। চোখের সামনে ভাগ হয়ে যাচ্ছে সমাজ। কথা বলার আগে নাম খুঁজছি আমরা। পরিধান দেখছি। আর তারপরই হয় সিঁটিয়ে যাচ্ছি, না হলে নাক কুঁচকে ফিরিয়ে নিচ্ছি মুখ। নরেন্দ্র মোদি তৃতীয়বার সরকারে আসার পর, গত আট মাসে দেশজুড়ে ৫৯টি গোষ্ঠী সংঘর্ষ রেকর্ড হয়েছে। রেকর্ড কেন বলা হচ্ছে? কারণ, ছোটখাটো এমন বেশ কিছু ঘটনা প্রশাসন দেখেও দেখে না। তাই সেইসব সরকারি খাতায় নথিভুক্তও হয় না। লক্ষ করার মতো বিষয় হল, এই ৫৯টির মধ্যে ৪৯টিই ডাবল ইঞ্জিন রাজ্যে। অর্থাৎ, সেই রাজ্যে হয় বিজেপি ক্ষমতায় আছে, আর তা না হলে এনডিএ’র অন্য কোনও শরিক। বিজেপিও সেখানে লেজুড় হয়েই রয়েছে। এই তালিকায় সবার আগে মহারাষ্ট্র। এই রাজ্যে ১২টি গোষ্ঠী সংঘর্ষের ঘটনা দেখা গিয়েছে গত কয়েক মাসে। তারপরই রয়েছে উত্তরপ্রদেশ। যোগীরাজ্যের স্কোর ৭। বিহার, গুজরাত, মধ্যপ্রদেশ... কে নেই তালিকায়! অথচ, ২০২৩ সালেই গোটা দেশে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের সংখ্যাটা ছিল ৩২। এর থেকে কী বোঝা যায়? বিজেপি তৃতীয়বার ক্ষমতায় আসার জন্য মেরুকরণের যে তাস খেলেছিল, তার আফটার শক নজরে আসছে দেশজুড়ে। এই ৫৯টি ঘটনায় ১৩ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গিয়েছে। তাদের মধ্যে ১০ জন মুসলিম এবং ৩ জন হিন্দু। সোজা কথায়, বিভাজনের এই খেলা শূন্য করে দিয়েছে ১৩টি মায়ের কোল। কেউ অকালে স্বামীহারা হয়েছেন, কেউ হারিয়েছে তার বাবাকে। শুধুমাত্র ধর্মীয় বিভাজনের নামে। এর দায় কে নেবে? ভূমিষ্ঠ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কেউ ধর্মের নামে বিভাজন করতে শেখে না। পরিবেশ তাকে শেখায়। সমাজ শেখায়। রাজনীতির কারবারিরা শেখায়। কারণ, এতেই তাদের অস্তিত্ব টিকে থাকবে। তাই ধর্মনিরপেক্ষ দেশের মাটিতে দাঁড়িয়েও যোগী আদিত্যনাথ ‘জাতীয় ধর্মে’র প্রোপাগান্ডা করতে পারেন। যে সনাতন ধর্ম মানুষের সঙ্গে মানুষের ভেদ করতে শেখায় না, তাকে হাতিয়ার করেই মেরুকরণের পথ খুলে দেন তিনি। এরপর যদি গোষ্ঠী সংঘর্ষে পরিসংখ্যানে বদল আসে? যদি আরও প্রাণ যায়? কে কাঠগড়ায় তুলবে এই মেরুকরণের রাজনীতিকে? আমি? আপনি? আমরাও কিন্তু তখন চোখ বন্ধ করেই থাকব। অপেক্ষা করব। ভেবে নেব, অন্য কেউ নিশ্চয়ই এগিয়ে আসবে। রুখে দাঁড়াবে অনাচারের রাজনীতিকে। কিন্তু তেমন কিছু হবে না। আওয়াজ উঠতে হবে প্রত্যেক ঘর থেকে। তবেই তা ঝড় হয়ে আছড়ে পড়বে স্বার্থান্বেষী রাজনীতির অলিন্দে। আমরা প্রত্যেকেই যদি ভেবে নিই, দুধপুকুরে সবাই দুধ ঢালবে, আমি এক ঘটি জল ঢেলে দিলে কিছু হবে না। তাহলে সেই পুকুর দুধশূন্যই থাকবে। আর সেই সুযোগে ‘পূজাগৃহে’ উঠবে ‘রক্তমাখানো ধ্বজা’। যুগ যুগ ধরে এটাই হয়ে আসছে... ‘বিধর্ম বলি মারে পরধর্মেরে/ নিজ ধর্মের অপমান করি ফেরে’। বিভাজনের কারবারিরা এটাই বুঝতে পারছে না যে, এই কুড়ুলে একদিন তারই পা কাটা পড়বে। তারা ভুলে যাচ্ছে, যদি এদেশে জাতীয় ধর্ম বলে কিছু থাকত, তাহলে কি ঐক্য গড়ে উঠত? বাবাসাহেব ভীমরাও আম্বেদকর কি তেমন কিছু ভেবেছিলেন? তাহলে কিন্তু এমন একটা সংবিধান লেখা হতো না। ভারত ধর্মনিরপেক্ষ হতো না। গণতন্ত্রের ভরসায় মৌলানা আবুল কালাম আজাদ এবং জওহরলাল নেহরু একসঙ্গে নতুন ভারত গড়ার ডাক দিতেন না। তাঁরা জানতেন, ভারতকে ধর্ম বাঁধবে না। ভারতকে এক সূত্রে বেঁধে ফেলতে পারে শুধুমাত্র মানবিকতা। দ্বিজাতি তত্ত্বে ভারতের বুকের উপর দিয়ে কাঁটাতার গিয়েছে। একটি দেশ ইসলামকে জাতীয় ধর্ম হিসেবে মেনে নিয়েছে। ভারত কিন্তু হিন্দুরাষ্ট্র হয়নি। আমরা হয়েছি ধর্মনিরপেক্ষ। কারণ আমরা বুঝেছি, ধর্ম এদেশে শুধু বিভাজন আনবে। তাই জাতীয় ধর্ম আমাদের হিন্দু নয়, ইসলাম নয়, বৌদ্ধ, খ্রিস্ট... কিছুই নয়। তাহলে আজ সাধারণতন্ত্রকে অসাধারণ হিসেবে প্রতিপন্ন করার চেষ্টা কেন? আজ ধর্মনিরপেক্ষ দেশকে জাতীয় ধর্মের পরিচয়ে মুড়ে ফেলার জিগির উঠছে কেন?
জানকী পূজারির বয়স ৯০ পেরিয়েছিল। শরীরটাও ভালো যাচ্ছিল না। গত ১০ বছর ধরে তিনি রফিক আব্দুল কাদেরের পরিবারে। তাদের আশ্রয়েই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন জানকীদেবী। কাদের সাহেব কিন্তু একবারও জানকীদেবীর ছেলেকে বলেননি, এসে তোমার মাকে নিয়ে যাও। মৃত্যুর পরও তাঁর পারলৌকিক ক্রিয়ায় হাত লাগিয়েছে কাদের সাহেবেরই পরিবার। জানকীদেবীকে দাহ করা, অস্থি বিসর্জন... সবটাই হিন্দুমতে। ১৩ দিনের কাজে জানকীদেবীর ছেলে এসে যোগ দিয়েছিলেন কাদের সাহেবের সঙ্গে। ৯০ বছরের বৃদ্ধা একবারের জন্যও কিন্তু ধর্মের খোঁজ করেননি। আর যাঁরা তাঁর পারলৌকিক ক্রিয়া করলেন, তাঁরাও না। দু’জনেই দেখেছিলেন মানুষকে। মানুষের মনকে। ধর্মের আধার তো মনই হয়। ‘ধর্মকারার প্রাচীরে বজ্র’ দিয়ে আঘাত করলেই যে জ্ঞানের আলো জ্বলে ওঠে। এই আলো কোনও পুঁথিগত বিদ্যায় পাওয়া যায় না। তার জন্য দরকার নিঃস্বার্থ আবেগ। ভারতের জাতীয় ধর্ম যদি কিছু থেকে থাকে, তাহলে তার নাম একটাই—মনুষ্যত্ব।