সন্তানের স্বাস্থ্যহানির কারণে মানসিক অস্থিরতা ও উদ্বেগ। পরীক্ষায় মনোমতো ফললাভ ও নামী প্রতিষ্ঠানে ভর্তির সুযোগ। ... বিশদ
সম্ভবত গত বছরগুলির ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিয়েই নির্মলা সীতারামন এ বছর বেকারত্ব ঘোচানোর ব্যাপারে যাই বলেছেন, সব ভাসা ভাসা। শ্রমনিবিড় ক্ষেত্রগুলিতে চাকরি বাড়ানোর জন্য বা ভারতীয় তরুণ-তরুণীদের স্বাবলম্বী করে তোলার জন্য সরকারের পরিকল্পনা আছে—কিন্তু সে পরিকল্পনা ঠিক কী? তা নিয়ে উচ্চবাচ্যই নেই অর্থমন্ত্রীর। বিজেপি সরকার বহু বছর ধরে ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ প্রকল্পে বাজার গরম করে রেখেছে। অথচ ভারত এখনও চলছে সার্ভিস সেক্টরকে আঁকড়ে ধরেই। ম্যানুফাকচারিং-এ সাফল্য ধরাছোঁয়ার বাইরে। আদৌ সে সাফল্য আসবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহের প্রভূত অবকাশ রয়েছে। এহেন পরিস্থিতিতে নির্মলা সীতারামন জানিয়েছেন, ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ প্রকল্পকে সাফল্যমণ্ডিত করার জন্য আধুনিক প্রযুক্তি নিয়ে আসা হবে। ব্যবসার পথ সুগম করে তোলা হবে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পকে গতিশীল করে তোলা হবে। এইটুকুই। কোনও তথ্য নেই, কোনও নির্দিষ্ট পরিকল্পনা নেই। এই হাওয়ায় ভাসিয়ে দেওয়া কথার বাইরে নির্দিষ্ট কিছু জানতে চাইলে আজকের কেন্দ্রীয় বাজেট অন্তত কিছুই জানাতে পারবে না।
আমার ব্যক্তিগত মত এই যে, নির্মলার মতো অপদার্থ অর্থমন্ত্রী ভারত এর আগে দেখেনি। সমস্যা এই যে, নির্মলার বৌদ্ধিক গভীরতা বা দক্ষতা কত, সে নিয়ে আমাদের সম্যক ধারণাই নেই। কারণ, বাজেট থেকে শুরু করে ভারতীয় অর্থনীতির প্রতিটি খুঁটিনাটির দায়িত্বে আসলে রয়েছেন স্বয়ং নরেন্দ্র মোদি। নির্মলা প্রধানমন্ত্রীর হাতের পুতুল মাত্র। ফলে প্রতি বছর নরেন্দ্র মোদি যেভাবে অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি তৈরি করে দিচ্ছেন, নির্মলা তোতাপাখির মতো সেগুলোই আউড়ে যাচ্ছেন। এবং নরেন্দ্র মোদির জমানায় প্রায় প্রত্যেক বছরেই মার্কেটিং গিমিক-এ পর্যবসিত হচ্ছে কেন্দ্রীয় বাজেট। এই বছর যেমন বিশাল হইচই শুরু হয়েছে আয়কর লাঘব নিয়ে। বাজেট ঘোষণা শেষ হওয়া মাত্র সরকারের পেটোয়া মিডিয়ারা বলতে শুরু করেছে, এরকম জনদরদী বাজেট বহু বছরে দেখা যায়নি, বিজেপি ছাড়া ভারতের মানুষের কথা অন্য কোনও রাজনৈতিক দল ভাবে না ইত্যাদি। অথচ আয়কর লাঘব করে ভারতীয় উপভোক্তাদের সাহায্য করার দরকার ছিল কোভিডের সময় থেকেই। তখন কিন্তু বারবার বিজেপি সরকার কর ছাড় দিয়ে এসেছে শিল্পপতিদের। কোভিডের অব্যবহিত পরেই অলিগার্কি বজায় রাখার জন্য এমন বাজেট নরেন্দ্র এবং নির্মলা বানিয়েছিলেন যে, বহু শিল্পপতিকেও বাধ্য হয়ে বলতে হয়েছিল, সরকারের উচিত সাধারণ মানুষের হাতে টাকা তুলে দেওয়া। তাঁদের হাতে নয়। মূল্যবৃদ্ধির পৃথিবীতে এই কর ছাড় এখন অর্থনীতি টিকিয়ে রাখার শেষ প্রচেষ্টা মাত্র। জনসাধারণকে সত্যিই সাহায্য করার ইচ্ছা থাকলে এই বাজেট অন্তত বছর চারেক আগে পেশ করা উচিত ছিল। যাই হোক, আয়কর লাঘবের ফলে কি ভারতীয় অর্থনীতি সত্যিই চাঙ্গা হবে? মূল্যবৃদ্ধি ঠেকাতে না পারলে শুধু কর লাঘব করে ভারতীয় ক্রেতাদের উজ্জীবিত করা যাবে না। তাঁরা এই টাকাটা সঞ্চয় বা বিনিয়োগ করতেই বেশি উৎসাহী হবেন। কেনাকাটির পরিমাণ তখনই বাড়বে, যখন ভারতীয় মধ্যবিত্তদের আয় বাড়বে চাকরির মাধ্যমে। কিন্তু অর্থনীতির সামগ্রিক বৃদ্ধি না ঘটলে, বা আরও চাকরির সুযোগ না এলে, তাঁদের আয় স্থবির হয়েই থাকবে। এবং সেরকম পরিস্থিতিতে শুধুমাত্র আয়কর লাঘব করে অর্থনীতিকে চাঙ্গা করা যাবে না।
উপভোক্তারা খুশি নয় বলে দেশি এবং বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও হতাশ হয়ে পড়ছেন। তাঁরা তাঁদের বিনিয়োগ অন্যত্র সরিয়ে নিচ্ছেন। এই সপ্তাহেই সিএনবিসি জানিয়েছে, ২০২৪-এ বিদেশি বিনিয়োগ কমেছে প্রায় ৯৯ শতাংশ (২০২৩-এর বিনিয়োগের তুলনায়)। বিনিয়োগ আসছে না বলে দেশের আর্থিক বৃদ্ধিও ঘটছে না। এই যে ‘দুষ্ট আবর্ত’, এর থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য দরকার দীর্ঘমেয়াদি সংস্কার। ন্যূনতম বেতন বৃদ্ধি এবং সরকারি বিনিয়োগ—এই দু’টিই অত্যন্ত দরকার ছিল প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে। কিন্তু এ বছরের বাজেটে দেখা যাচ্ছে, এই দু’টি বিষয় নিয়েই সরকারের কোনও পদক্ষেপ নেই। বরং, গত দু’-তিন বছরে যে পরিকাঠামো বিনিয়োগের কথা সরকার বলেছিল, সে নিয়েও নির্মলা আর কথা বাড়াননি। সম্ভবত যা পরিকল্পনা ছিল, তার অধিকাংশই বাস্তবায়িত হয়নি বলে! অথচ পরিকাঠামোয় যথাযথ বিনিয়োগ হচ্ছে না বলে আমাদের ক্ষুদ্র এবং মাঝারি শিল্প ধুঁকছে। হয়তো দেশজ চাহিদা তারা পূরণ করতে পারছে, কিন্তু বিদেশি ডিমান্ডের ক্ষেত্রে ব্যর্থ। যেমন চীন। তাদের ক্ষুদ্র এবং মাঝারি শিল্পক্ষেত্র প্রযুক্তিগতভাবে অনেক আধুনিক। তাদের সঙ্গে পাল্লা দেওয়া দুরূহ হয়ে পড়ছে ভারতের জন্য। ফলে বৈদেশিক মুদ্রাও আসছে না। সেই কারণে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা আরও মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছেন।
এবছরের বাজেটে আইনি এবং পুঁজি-বাজারে সংস্কারের কথা ঘোষণা হয়েছে, যা সদর্থক প্রচেষ্টা বলেই মনে করি। কিন্তু এগুলি বাস্তবায়িত হতে হতেই এই সরকারের মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে। অর্থনীতির চাকা ঘোরানোর জন্য যে দিশা বা স্পষ্ট করে বললে, সাধারণ মানুষের হাতে টাকার জোগান বাড়ানোর যে স্থায়ী সমাধানসূত্র দরকার ছিল, তার স্পষ্ট হদিশ কিন্তু পাওয়া গেল না। মনে রাখতে হবে, আয়করে ছাড় নেহাতই মামুলি টোটকা। দেশকে সাময়িকভাবে শান্ত করার খানিক অক্ষম প্রচেষ্টা।