ধর্মকর্মে সঞ্চীয় অংশগ্রহণে মানসিক তৃপ্তি ও সামাজিক সুনাম। পেশাদার শিল্পীদের শুভ সময়। ... বিশদ
জুমলা থ্রি সরকারকে সংসদে প্রথম অধিবেশনেই বড় ধাক্কা দিলেন সেই রাহুল এবং মহুয়া। রাহুলের দীর্ঘ বক্তৃতায় বেসামাল মোদি। এই প্রথমবার এক পরমাত্মার দিশাহারা অবস্থা দেখলেন দেশের মানুষ। বিষয়টা ছিল ‘অগ্নিবীর’। ‘অগ্নিবীর’ নিয়ে সরকারি তামাশা হয়েছে। দেশের যুব সম্প্রদায়ের সেনা হওয়ার আবেগকে রসদ করে মোদি যে ছেলেখেলা করেছেন, তা তো আজ পরিষ্কার। যেসব অগ্নিবীর শহিদ হয়েছেন, তাঁদের সঙ্গে সরকার কীভাবে বঞ্চনা করেছে, রাহুল সেটা দেখিয়ে দিয়েছেন। মোদি বুক বাজিয়ে বলেছিলেন, চার বছরের জন্য যাঁরা অগ্নিবীর হবেন, তাঁরা সেনার মর্যাদা পাবেন। কিন্তু সত্যিই কি তাঁরা তা পাচ্ছেন? পাঞ্জাবের লুধিয়ানার রামগড় সর্দারন গ্রামের বাসিন্দা অজয় সিং ‘অগ্নিবীর’ পদে যোগ দিয়েছিলেন। গত জানুয়ারি মাসে কাশ্মীরের রাজৌরিতে ল্যান্ডমাইন বিস্ফোরণে তিনি শহিদ হন। শহিদ হওয়ার পর পাঞ্জাব সরকার তাঁর পরিবারকে এক কোটি টাকা সাহায্য দেয়। কিন্তু কেন্দ্র সরকার কিছুই দেয়নি। যদিও সংসদে দাঁড়িয়ে রাজনাথ সিং দাবি করেন, কেন্দ্র ওই পরিবারকে এক কোটি টাকা সাহায্য দিয়েছে। কিন্তু পরিবারের সদস্যরা সেই দাবি নস্যাৎ করে দিয়েছেন। মোদি সরকার যে একজন শহিদের পরিবারের সঙ্গেও জুমলাবৃত্তি করতে ছাড়ছে না, সেটাই রাহুল সংসদে ফাঁস করে দিয়েছেন। রাহুল সংসদে অজয় সিংয়ের কথা না বললে, আমরা জানতেও পারতাম না প্রকৃত এক দেশভক্তের শহিদ হওয়ার ছ’মাস পরেও কীভাবে ‘দেশভক্ত’ সরকার অন্যায় করে চলেছে।
প্রথম ম্যাচের প্রথম ধাক্কাতেই এখন বেসামাল সরকার। এই সংসদ বুঝিয়ে দিয়েছে, সম্মিলিতভাবে যদি বিরোধী শক্তি মোদিবাহিনীকে আক্রমণ করতে থাকে, তবে প্রধানমন্ত্রী কোণঠাসা হয়ে তাঁর নার্ভ হারাতে বাধ্য। সেনাপতির টালমাটাল অবস্থায় সিঁদুরে মেঘ দেখছে বিজেপি। আগের দু’টি টার্মে রাহুল
গান্ধী এই দায়িত্বটা পালন করতে পারেননি। চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন করলে মোদির মতো স্বঘোষিত শক্তিশালী ব্যক্তিত্ব যে কুঁকড়ে যেতে পারেন, সেটাই দেখল এবারের সংসদ। এতদিন যেভাবে তারা রাহুলকে ‘পাপ্পু’ বানিয়ে বিরোধী শক্তিকে দুর্বল বলে ব্যঙ্গ করত, তার অবসান হয়েছে বলা যায়। বিজেপি পক্ষ বুঝতে পারছে, এই বিরোধী শক্তির সঙ্গে
সমানে সমানে লড়াই করা প্রায় অসম্ভব। বারবার যে এই সরকারের ফেস অফ হবে, সেটা প্রথম অধিবেশনেই পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে। প্রথম অধিবেশনের সারমর্ম যদি একটু ব্যাখ্যা করা যায়,
তবে দেখব রাহুল গান্ধী এবং বিরোধী সাংসদদের বক্তৃতার কাছে মোদি-শাহরা গোহারান হেরেছেন।
কেন মোদি এভাবে দাঁড়িয়ে হারলেন? তাঁর এমন ‘অপরাজেয়’ ব্যক্তিত্ব, পরমাত্মা সুলভ ভাবভঙ্গি! প্রথমত, যতক্ষণ সংসদে রাহুল গান্ধী বক্তৃতা করেছেন, ততক্ষণই আমরা দেখেছি নরেন্দ্র মোদির মুখে চিন্তা ও বিরক্তির ভাব। তিনি যে এভাবে আক্রমণ পছন্দ করছেন না, সেটা বোঝা যাচ্ছিল। সংসদীয় গণতন্ত্র যে স্বৈরাচারীরা পছন্দ করেন না, সেটা তো ইতিহাস স্বীকৃত। তাই আমরা দেখেছি, রাহুলের এবং নিজের বক্তৃতার সময় তিনি বেশ কয়েকবার জল খেয়েছেন। আরটিআই করলে সম্ভবত জানা যাবে, এবার তিনি ঘনঘন জল খাওয়ার রেকর্ড করেছেন।
মোদি যে এতদিন ধরে নিজেকে হিন্দু সমাজের প্রধান ঠিকাদার হিসাবে তুলে ধরতে চাইছিলেন, সেই বেলুনও রাহুল ফুটো করে দিয়েছেন। দেশের হিন্দু সমাজের গরিষ্ঠ সংখ্যক মানুষের কণ্ঠস্বরই যেন ধ্বনিত হয়েছিল রাহুলের কণ্ঠে। তিনি বলেছিলেন, নরেন্দ্র মোদি মানেই পুরো হিন্দু সমাজ নয়, বিজেপি মানেই পুরো হিন্দু সমাজ নয়, আরএসএস মানে পুরো হিন্দু সমাজ নয়। কেন? কেননা এই যে হিন্দুত্ব, তার মধ্য দিয়ে হিংসার প্রকাশ আছে। আগ্রাসনের উগ্র লক্ষ্য আছে। একেবারে যথার্থ কথা। আমরা জানি, প্রকৃত হিন্দুত্ব মোটেই বিজেপির হিন্দুত্ব নয়। বিজেপি আপন স্বার্থে সমগ্র হিন্দু সমাজকে বিপথগামী করতে চাইছে। আমাদের কাছে হিন্দুত্বের দৃষ্টান্ত শঙ্করাচার্য, আমাদের কাছে হিন্দুত্বের দৃষ্টান্ত শ্রীচৈতন্য। আদ্বিজ চণ্ডালকে তিনি নিজের বুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, হিন্দুধর্ম কোনও বিভেদ বা হিংসাকে স্বীকার করে না। আমাদের কাছে হিন্দুত্ব মানে শ্রীরামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দ। তাই বাঙালি বিজেপির হিন্দুত্বকে পছন্দ করে না। বিজেপির হিন্দুত্ব এক বিচ্যুত হিন্দুত্ব। এই জায়গাতেই রাহুল আঘাতটা করেছেন। এই যে সংসদে মোদির দিকে আঙুল তুলে চোখে চোখ রেখে রাহুল প্রথম ওভারেই ছ’টা ছয় মারলেন, তাতেই কিছুটা ব্যাকফুটে চলে গেলেন মোদি। তিনি তাঁর দীর্ঘ ভাষণে বিরোধীদের কোনও প্রশ্নেরই যথাযথ উত্তর দিতে পারলেন না। সারাক্ষণই কংগ্রেসকে, গান্ধী পরিবারকে এবং বিরোধীদের আক্রমণ করে গেলেন। এই খেলাতেই তিনি অভ্যস্ত। চিরদিন অন্যের নিন্দামন্দ করাই মোদির প্রকৃত পলিটিক্স। অবশ্য রাহুলকে ‘হিন্দু বিরোধী’ হিসাবে দাগিয়ে দিয়ে বিজেপি উল্টো চাল দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু দেশের মানুষ
জানেন, বিজেপির ইউটোপিয়ান হিন্দুত্ব
কখনওই ভারতাত্মার শক্তি হতে পারে না।
লোকসভা নির্বাচনে দেশের সনাতন হিন্দুধর্মের শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ বিজেপির পাশে দাঁড়াননি। তাঁরা বিজেপির হিন্দুত্বকে নস্যাৎ করে দিতে অযোধ্যার মতো কেন্দ্রে হারিয়ে দিয়েছে। বারাণসীতে মোদির ভোটের মার্জিন যেভাবে কমেছে, তা নৈতিক পরাজয়েরই শামিল। এই দু’টি কেন্দ্রের ভোটই সারা দেশকে বুঝিয়ে দিয়েছে, নরেন্দ্র মোদি এদেশের প্রকৃত হিন্দুত্বের ঠিকাদার নন।
রাহুলের বক্তব্যেরই অনুরণন শোনা গিয়েছে শঙ্করাচার্যের কথায়। উত্তরাখণ্ডের জ্যোতির্মঠের শঙ্করাচার্য স্বামী অবিমুক্তেশ্বরানন্দ বলেছেন, রাহুল গান্ধী কখনও পুরো হিন্দু সমাজকে হিংসাশ্রিত বলেননি। তিনি একটি পার্টিকেই বলেছেন। সুতরাং রাহুল গান্ধীর নামে যাঁরা অপপ্রচার করছেন, তাঁদের শাস্তি হওয়া উচিত।
মহুয়া মৈত্র তাঁর বক্তৃতায় বুঝিয়ে দিলেন, কেমন করে মোদি অ্যান্ড কোম্পানি ‘মণিপুর’ শব্দটি শুনলেই আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। তিনি বুঝিয়ে দিলেন মোদিবাহিনী নারীশক্তিকে ভয় পান। তাঁদের ২৪০ সাংসদের মধ্যে মাত্র সাড়ে বারো শতাংশ মহিলা। অবশ্যই এসবের জবাব মোদির কাছে ছিল না। তাই তাঁর বক্তৃতা ব্যক্তি আক্রমণ এবং পুরনো কিছু তথ্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকল।
বিরোধী শক্তির সামগ্রিক উত্থান একদিকে যেমন বিজেপিকে সামগ্রিকভাবে সঙ্কুচিত করেছে, তেমনই ইন্ডিয়া জোটকে অনেক বেশি সঙ্ঘবদ্ধ করেছে। তারই প্রকাশ দেখা যাচ্ছে গুজরাতে। সংসদে এবং গুজরাতের মাটিতে দাঁড়িয়ে মোদিকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছেন রাহুল। গোধরা হিংসার আতঙ্ককে অস্ত্র করে এতদিন বিজেপি সেখানে লাগাতার জিতে এসেছে, সেই জয়কে হারানোর চ্যালেঞ্জ নিয়েছে কংগ্রেস।
মোদিবাহিনীকে এমন চাপের মুখে পড়তে দেখে মাঠে নেমে পড়েছেন নাইডু এবং নীতীশকুমার। তাঁরাও জানেন লোহা গরম থাকতে থাকতে তাকে পিটিয়ে নিজের মনোমত আকার দিতে হয়। নাইডু তাঁর রাজ্যের জন্য স্পেশাল প্যাকেজের দাবি করেছেন। সেটার আর্থিক মূল্য এক লক্ষ কোটি টাকা। দাবি করেছেন, কেন্দ্র যাতে অন্ধ্রপ্রদেশে বিদেশি বিনিয়োগের ব্যাপারে তৎপর হয়। নীতীশকুমারের দাবিও স্পেশাল স্ট্যাটাসের। অন্য রাজ্যকে বঞ্চিত করে এই দাবির কতটুকু মোদি মেটাতে পারেন, সেটাই দেখার। তার ওপরই নির্ভর করছে, মোদির তারের ওপর দিয়ে হাঁটার ভবিষ্যৎ। শেষ পর্যন্ত সরকার বাঁচাতে হয়তো তাঁকে বিপুল অঙ্কের টাকা ঋণ করতে হবে।
সকালই বলে দেয় দিন কেমন কাটবে। এই প্রবাদের আলোকে কি প্রশ্ন উঠতে পারে যে, এবারের সংসদের প্রথম অধিবেশনে বিজেপি যেভাবে নাস্তানাবুদ হয়েছে, তাতে তারা সংসদে কতটুকু প্রতিরোধ গড়তে পারবে! সাম্প্রতিক সময়ে দেশে যতবার রেল দুর্ঘটনা ঘটেছে, প্রায় প্রতিবারই রেলমন্ত্রক থেকে জানানো হয়েছে, ‘কবচ’ কাজ না করায় এই দুর্ঘটনা। এত টাকা খরচ করে রেলের ‘কবচ’ প্রকল্প করা সত্ত্বেও তা কাজ করছে না। এবার সম্ভবত বিরোধী হাত থেকে বাঁচতে মোদিকেই অনেকগুলি নয়া ‘কবচ’ ধারণ করতে হবে। ‘বিরোধী শক্তি প্রতিহত কবচ!’