উকিল ও ডাক্তারদের কর্মব্যস্ততা বাড়বে। পত্নী/পতির স্বাস্থ্য আকস্মিক ভোগাতে পারে। মানসিক অস্থিরভাব। ... বিশদ
আর জি করে বাংলার চিকিৎসক কন্যার মৃত্যুতে সুপ্রিম কোর্টে এখনও পর্যন্ত তিনটি শুনানি হয়েছে। ২২ আগস্ট, ৯ সেপ্টেম্বর এবং ১৭ সেপ্টেম্বর। প্রতিটি শুনানিতেই উঠেছে চিকিৎসকদের কর্মবিরতির বিষয়টি। প্রতিবার প্রধান বিচারপতি জুনিয়র ডাক্তারদের কাজে ফেরার বার্তা দিয়েছেন। কিন্তু চিকিৎসকরা সেই নির্দেশ মানেননি। জানিয়ে দিয়েছিলেন, পাঁচদফা দাবি মানলেই তাঁরা কাজে ফিরবেন। সরকার তিন দফা দাবি মানায় ৪২দিন পর তাঁরা কাজে যোগ দিয়েছিলেন। ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হচ্ছিল চিকিৎসা পরিষেবা। শুধু রাজ্যের সাধারণ মানুষই নয়, সিনিয়র চিকিৎসকরাও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিলেন। কারণ জুনিয়রদের কর্মবিরতিতে
তাঁদের চিকিৎসা শাস্ত্রের ‘জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ’ সবই করতে হচ্ছিল। অমানুষিক পরিশ্রম হচ্ছিল। কিন্তু ১০দিন যেতে না যেতেই ফের পূর্ণ কর্মবিরতির ডাক।
সাগর দত্ত মেডিক্যালে রোগী মৃত্যুর ঘটনায় উত্তপ্ত হয় পরিস্থিতি। মৃতার আত্মীয়রা চিকিৎসক ও নার্সদের উপর চড়াও হয়। মারধর করে। কারও সন্তান বা নিকট আত্মীয় মারা গেলে তিনি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। বহু ক্ষেত্রেই হিতাহিত জ্ঞান লোপ পায়। কিন্তু তারজন্য চিকিৎসকের গায়ে হাত তোলা কিছুতেই মানা যায় না। রোগীর পরিবারের বিচার চাওয়ার অধিকার আছে। কিন্তু গায়ে হাত দেবে? এটা কোনও সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ সমর্থন করতে পারে না। একইভাবে লাঞ্ছিত হলে অভিযুক্তদের শাস্তির দাবিতে চিকিৎসকরা আন্দোলন করতেই পারেন। কিন্তু রোগী দেখা বন্ধ করাটা মেনে নেওয়া যায় না।
‘প্রফেশনাল হ্যাজার্ডস’ বলে একটা কথা আছে। সমস্ত পেশার মানুষকেই তার সম্মুখীন হতে হয়। সেনাবাহিনীতে যোগ দিলে সিয়াচেনে ডিউটি করতে হতে পারে। প্রতিপক্ষের হামলায় জওয়ানের মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। কিন্তু তারজন্য কোনও জওয়ান সিয়াচেনে যাবেন না, এটা বলতে পারেন না। আবার পুলিসের কাজে যোগ দেওয়া ব্যক্তিটি জানেন, তিনি যে কোনও সময় হেনস্তার শিকার হতে পারেন। শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হতে পারেন। এমনকী, দুষ্কৃতী হামলায় মারা যেতেও পারেন। সাংবাদিকতার পেশাতেও আছে ঝুঁকি। খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে মার খাওয়ার ঘটনা প্রায়ই ঘটে। কিন্তু তারজন্য কোনও সাংবাদিক কি বলতে পারেন, নিরাপত্তা না দিলে তিনি খবর করতে যাবেন না। কেস জেতাতে না পারলে আইনজীবীও মক্কেলের রোষের শিকার হন। এমনকী, ম্যাচ জেতাতে না পারলে ফুটবলার ও ক্রিকেটারদের বাড়িতে হামলার ঘটনাও ঘটে।
মোদ্দা কথা, সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ও আবেগের সঙ্গে জড়িত যে কোনও পেশাতেই ঝুঁকি থাকে। সেইসব পেশায় যুক্তদের ১০০ শতাংশ নিরাপত্তা দেওয়া কোনও দেশ বা সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়। পেশাগত দক্ষতা এবং পরিস্থিতি
সামাল দেওয়ার অভিজ্ঞতা এই সমস্ত অনভিপ্রেত ঘটনাকে বড়জোর কিছুটা কমাতে পারে। কিন্তু, বন্ধ করা অসম্ভব।
ধর্মতলার আন্দোলন মঞ্চ থেকে জুনিয়র ডাক্তাররা জানিয়েছিলেন, ‘কর্মবিরতি যদি প্রত্যাহার করতেই হয় তাহলে সাধারণ মানুষের কথা ভেবেই তা করবেন। কারও নৈতিকতার জ্ঞান শুনে নয়।’ প্রশ্নটা হচ্ছে, হঠাৎ করে আন্দোলনকারী চিকিৎসকদের ‘সাধারণ মানুষে’র কথা মনে পড়ল কেন? এতদিন ধরে সরকার, সুপ্রিম কোর্ট, বহু বিশিষ্টজন বারবার বলেছেন, জাস্টিসের দাবিতে আন্দোলন চলুক। কিন্তু চিকিৎসকরা কাজে যোগ দিন। কর্মবিরতিতে গরিব মানুষের দুর্ভোগ বাড়ছে। তখনও তাঁরা সেই ডাকে সাড়া দেননি। উল্টে চিকিৎসা না পেয়ে মারা যাওয়া মানুষগুলোর মৃত্যুই যে ভবিতব্য ছিল, সেটা নানাভাবে বোঝানোর চেষ্টা হয়েছে। মৃত্যুর সংখ্যা যত বেড়েছে ততই উচ্চস্বরে উচ্চারিত হয়েছে ‘কোমর্বিডিটি’র তত্ত্ব। সেই চিকিৎসকদের মুখেই ‘সাধারণ মানুষে’র কথা!
আসলে আন্দোলনকারী চিকিৎসকরাও বুঝতে পারছেন, অভয়ার নৃশংস এবং মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে বাংলায় যে স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ ও গণআন্দোলন তৈরি হয়েছিল, তা থেকে মানুষ সরে যাচ্ছে। ১৪ আগস্টের ‘রাত দখল’ কর্মসূচিতে সাধারণ মানুষের যে আবেগ, যে উপস্থিতি ছিল, মহালয়ার ‘ভোর দখলে’ তার ছিটেফোঁটাও দেখা যায়নি। কারণ মানুষ বুঝে গিয়েছে, অভয়ার জাস্টিসের দাবিতে যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল তা আর এখন ‘অরাজনৈতিক’ নেই। কর্মবিরতি প্রত্যাহারের শর্ত বৃদ্ধিতেই পর্দার আড়াল থেকে বামেদের ও অতিবামেদের কলকাঠি নাড়ার অভিযোগ উঠছিল। যাদবপুরের মিছিল থেকে ‘কাশ্মীর মাঙ্গে আজাদি’ স্লোগান ওঠার পর সেই পর্দাটা এক ঝটকায় সরে গিয়েছে। সামনের সারিতে কিছু জুনিয়র ডাক্তার থাকলেও এই আন্দোলনের চালিকাশক্তি কারা, সেটা বুঝতে কারও বাকি ছিল না।
৪২দিন কর্মবিরতির পর ১০দিন আংশিক কাজ। তারপর ফের দ্বিতীয় দফার পূর্ণাঙ্গ কর্মবিরতি। দ্বিতীয় দফার কর্মবিরতির সঙ্গে অভয়ার জাস্টিসের কোনও সম্পর্ক নেই। অভয়ার জাস্টিসই তাঁদের প্রধান দাবি হলে চিকিৎসকরা কিছুতেই কাজে ফিরতেন না। তাঁরাও জানেন, সেই দাবি মেটাতে পারে সিবিআই। সেখানে রাজ্য সরকারের আর কিছু করার নেই।
তবে কাজে যোগ দেওয়ার সময়েই ফের যে আন্দোলনে ফিরবেন, সেই হুঁশিয়ারি তাঁরা আগাম দিয়ে রেখেছিলেন। কারণ আন্দোলনকারীদের একাংশ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হস্তক্ষেপে বিষয়টা মিটে গেল, এটা হজম করতে পারছিল না। খুঁজছিল আন্দোলনে ফেরার একটা অজুহাত। সাগর দত্ত মেডিক্যালের ঘটনাকে সামনে রেখে ফের ডাক দিয়েছিলেন কর্মবিরতির। তাঁরা ভেবেছিলেন, একইভাবে তাঁরা সাড়া পাবেন। কিন্তু সেটা হয়নি।
জুনিয়র ডাক্তারদের এই আন্দোলন বাংলাকে একটা নতুন শব্দবন্ধ উপহার দিয়েছে, ‘থ্রেট সিন্ডিকেট’। সেই সিন্ডিকেটে যুক্তদের তদন্ত কমিটির সামনে হাজির করিয়ে বিচার চাওয়া হয়েছে। রাজ্যের বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজে তৈরি হচ্ছে ‘থ্রেট সিন্ডিকেটে’র সদস্যদের তালিকা। তাতে শুধু জুনিয়র ডাক্তার বা পড়ুয়াদেরই নয়, ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে অপছন্দের শিক্ষকদেরও নাম। তাই শুধু জুনিয়রদেরই নয়, অনেক সিনিয়রেরও থরহরিকম্প অবস্থা। একবার তালিকায় নাম উঠলেই আপাতত কলেজে ঢোকা বন্ধ, হতে হবে সাসপেন্ড, এমনকী রেজিস্ট্রেশন বাতিল। অনেকেই বলছেন, থ্রেট সিন্ডিকেট ছিল, আছে এবং থাকবে। কেবল বদলে যাবে শুধু মুখগুলো।
তাই আপাতত কর্মবিরতি উঠলেও সিন্ডিকেটের মুখবদল না হওয়া পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাওয়ার মরিয়া চেষ্টা চলবে।
সূচনা হয়েছে দেবীপক্ষের। অভয়ার ইচ্ছাতেই তাঁর বাড়িতে দেবীর আরাধনা শুরু হলেও তিনি ছিলেন মানবপুজোয় বিশ্বাসী। অভয়ার মা জানিয়েছেন, ‘পুজোর অঞ্জলি দিতে বসেও রোগীর ডাক এলে উঠে যেত মেয়ে। বলত, মানুষের উপর তো পুজো হয় না।’ অভয়ার কাছে দেবীর অঞ্জলির চেয়েও বড় ছিল আর্তের সেবা। সেই অভয়ারই জাস্টিসের দাবিতে তাঁর সহপাঠীরা লাগাতার কর্মবিরতি চালিয়ে গেলেন। রোগীদের বিপদের মুখে ঠেলে দিয়ে ‘জাস্টিস’ ছিনিয়ে আনলে জুনিয়র ডাক্তাররা আত্মশ্লাঘা অনুভব করতেই পারেন, কিন্তু তাতে রোগী অন্ত প্রাণ অভয়ার আত্মা শান্তি পাবে না।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, জুনিয়র ডাক্তাররা যে দাবিতে দ্বিতীয় দফার কর্মবিরতি শুরু করেছিলেন তার তো সমাধান হয়নি। তাহলে কেন কর্মবিরতি তুলে নিলেন? তার কারণ, এতদিন যাঁরা আন্দোলনকে নানাভাবে সাহায্য করেছেন তাঁরাও ফের কর্মবিরতিকে সমর্থন করেননি। বিশেষ করে সিনিয়র ডাক্তারবাবুরা।
কারণ তাঁরা জানেন, কর্মবিরতি সাময়িক প্রতিবাদের হাতিয়ার হলেও সমস্যা সমাধানের পথ নয়। ফলে ঘরে বাইরে চাপে পড়ে জুনিয়র ডাক্তারদের পিছিয়ে আসা ছাড়া উপায় ছিল না। তবে দীর্ঘ গণআন্দোলনের পথ বেয়ে যে ফসল তাঁরা ঘরে তুলেছিলেন, কর্মবিরতির হঠকারী সিদ্ধান্তে তার অনেকটাই খুইয়ে বসলেন।