আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব সমাগমে আনন্দ বৃদ্ধি। চারুকলা শিল্পে উপার্জনের শুভ সূচনা। উচ্চশিক্ষায় সুযোগ। কর্মক্ষেত্রে অযথা হয়রানি। ... বিশদ
পকেটে কমিশনকে পুরে, রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে মোদিবাবুরা বুঝতেই পারেননি, বাংলায় তাঁদের এমন লজ্জাজনকভাবে হারতে হবে। তাই নির্বাচনের ফল ঘোষণার আগের দিন মোদি-অমিত বাংলার মন্ত্রিসভার গঠন নিয়ে আলোচনায় বসেছিলেন। এমনকী কম মার্জিনে হারলে বিজেপির চিরাচরিত পরিকল্পনা অনুযায়ী তৃণমূল বিধায়ক কেনার ছক তৈরিও হয়েছিল। সেইসঙ্গে উত্তরপ্রদেশে রিসর্ট বুক করার পরিকল্পনাও করে ফেলেছিলেন মোদি-শাহ। আত্ম-অহংকারে উন্মত্ত হয়ে ভেবেছিলেন রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ বা কর্ণাটকের রিসর্ট পলিটিক্স বোধহয় বাংলাতেও সম্ভব। কিন্তু মোদি এবার বুঝে গেলেন, বাংলার মাটি কতটা দুর্জয় ঘাঁটি।
যেভাবে মমতাকে অসম্মান করে একদল ক্ষমতালোভী মানুষ তাঁকে আক্রমণে নেমেছিলেন, তার বিরুদ্ধে জমা হয়ে ওঠা সব অসম্মানকেই চোখে চোখ রেখে ইভিএমের একটা বোতাম টিপে ফিরিয়ে দিয়েছেন মানুষ। তাঁরা বুঝিয়ে দিয়েছেন, বাংলা গড়ার ‘সোনার কাঠি রুপোর কাঠি’ মমতার হাতেই থাকবে। গদ্দাররা চেয়েছিলেন, সেই ‘কাঠি’ চুরি করে মোদির হাতে তুলে দিতে। কিন্তু বাংলার জাগ্রত জনতা সেই দুরভিসন্ধি বানচাল করে দিয়ে তাঁদের ঘাড়ধাক্কা দিয়েছেন। বিভীষণ সফল হয়েছিলেন। ব্রুটাস সফল হয়েছিলেন। মীরজাফরও সফল হয়েছিলেন। কিন্তু রাজ্যের মানুষ ব্যর্থ করে দিয়েছেন এযুগের মীরজাফরদের চক্রান্ত।
বাংলায় খেলতে এসে গোহারা মোদি। এখানে জিততে চার হাজার কোটি টাকা ঢেলেও লাভ হয়নি। বামজোটদের নিজের হাতের পুতুল করে, তাদের ভিতরে আইএসএফকে ঢুকিয়ে দিয়েও লাভ হয়নি। এবারে বামেরা নতুন মুখ এনেছিল। কিন্তু এই তরুণ প্রজন্মের নেতারা জানেন না, উপরমহলের বৃদ্ধতন্ত্র কী খেলা খেলেছে? কেন বিজয়ন, মানিক সরকার, দীপঙ্কর ভট্টাচার্যরা বিজেপিকে প্রথম শত্রু হিসাবে চিহ্নিত করলেও সে কথায় কান দেননি সেলিম, বিকাশ, সুজনরা। তাঁরা বারবার মমতাকে আক্রমণ করে বিজেপি শিবিরকে এখানে জায়গা করে দিতে চেয়েছিলেন। মানুষ সেই উদ্দেশ্য ধরে ফেলেছিলেন। তাই তাঁদের শূন্য করে দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন, এটাই তোমাদের প্রাপ্য। ইতিহাস বলছে, এবার নতুন প্রজন্ম তাঁদের থেকে ক্ষমতা কেড়ে নেবে। একটা প্রবাদ আছে, ধাক্কা মেরে না সরালে কমিউনিস্টরা নাকি সরেন না। এই দুঃসময়ে অনেকেই প্রস্তাব দিয়েছেন, শূন্য হয়ে যাওয়া একটা পার্টির জেলায়, ব্লকে অত বড় বড় অফিস রাখার বিলাসিতা কেন? ওইসব অফিসগুলিকে সেফ হোম, কোভিড হাসপাতাল হিসেবে গড়ে তোলা হোক। তাতে অন্তত বাম-পাপ কিছুটা লাঘব হলেও হতে পারে।
কংগ্রেসও মমতাকে শিক্ষা দিতে গিয়ে মুখতোড় জবাব পেয়েছে। কংগ্রেসের এই মমতা-বিরোধিতা অবশ্য সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে পার্টির লাইন নয়। বাংলায় কংগ্রেস চলছে অধীরের লাইনে। তাঁর কাছে পার্টি যে কখনওই বড় নয়, তা বারবার প্রমাণিত। তিনি ব্যক্তিগতভাবে মমতাকে পছন্দ করেন না। তাই বাংলায় কংগ্রেস মমতার বিরোধী। যে সিপিএমের হাতে কংগ্রেসের শতশত কর্মী একদিন খুন হয়েছেন। তাঁদের সঙ্গে হাত মেলাতে একটুও শর্মিন্দা হন না অধীর। আর নখদন্তহীন কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের তা বসে বসে দেখা ছাড়া কোনও উপায় থাকে না। তার যোগ্য জবাব কংগ্রেসও পেয়েছে। মোর্চার ইস্তাহারের প্রথম অলিখিত শর্তই ছিল মমতাকে এমন টাইট দেব যে, আঁস্তাকুড়ে পড়ে ত্রাহি ত্রাহি ডাক ছাড়বে। আজ রাজ্যের মানুষ তাঁদেরই আঁস্তাকুড়ে বসিয়ে দিয়েছেন। অধীরের নিজের গড়ের মানুষই তাঁকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। অধীর মিথ খানখান।
এরাজ্যে ক্ষমতা দখলের নেশায় হিতাহিত ভুলে যেভাবে মোদি ঝাঁপিয়েছিলেন, তা নিয়ে আজ সারা বিশ্বের সংবাদপত্রে তিনি ধিক্কৃত হচ্ছেন। বিশ্বের প্রত্যেকে তাঁর দিকে আঙুল তুলে বলছেন, ভারতের আজ এই দুর্দশা আপনার জন্য। ভারতভূমিকে করোনা-ভূমিতে পরিণত করার রূপকার আপনিই। রক্ষকই এখন ভক্ষকের ভূমিকায়! সেই সঙ্গে মানুষের ধিক্কার আর আদালতের তিরস্কারে জর্জরিত মোদি সরকার। কাজের মার্কশিট হিসেবে এটাই তো তাঁর প্রাপ্য। শতাব্দীর অন্যতম ভয়াবহ দুঃসময়ে তাঁর প্রথম লক্ষ্য অক্সিজেন, ভ্যাকসিন বা মানুষকে রক্ষা করা নয়, তাঁর প্রথম লক্ষ্য ছিল বাংলা দখল। সেখানে হেরে গিয়ে এখন তাঁর প্রধান লক্ষ্য নতুন সংসদ ভবন নির্মাণ। জনগণের টাকায় ভূতের বাপের শ্রাদ্ধ হচ্ছে। ক্ষমতা লোলুপতা কোন পর্যায়ে গেলে দেশের একজন শীর্ষ শাসক এমন আচরণ করতে পারেন, তা অবশ্যই মনোবিদদের গবেষণার বিষয়। সারা দেশের মানুষের নিন্দা, সমালোচনা, পদত্যাগের দাবির সামনেও তিনি অবিচল। এখনই তাঁর পদত্যাগের যথার্থ সময়। সারা দেশ এখন এক যোগ্য নেতৃত্বকে চায়। বাংলার লড়াই চিনিয়ে দিয়েছে, কে সেই জনগণমন অধিনায়ক!
এর মধ্যে রাজ্যের নতুন সরকারের গায়ে কাদা ছিটিয়ে নয়া ফন্দি আঁটছে বিজেপি। রাজ্যজুড়ে হিংসা ছড়ানোর গোপন ছক চলছে। রাজ্যকে অশান্ত করার গোপন খেলায় সক্রিয় বিজেপির আইটি সেলও। বিজেপি সব সময় সোজা খেলায় হেরে গেলে বাঁকা পথে জেতার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। রাজ্যে সেই উস্কানিই চলছে। হিংসার ভুল ছবি ও তথ্য সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দিয়ে ফায়দা তোলার চেষ্টা করা হচ্ছে। অবশ্য একেবারেই যে কোথাও কিছু হয়নি, তা বলা যাবে না। প্রত্যেক ক্রিয়ারই সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া থাকে। এটা বিজ্ঞানের তত্ত্ব। ভোটের আগে থেকে পদ্ম-বাহিনীর হার্মাদ নেতাদের হিংসাত্মক হুঙ্কারের কথা কি এখন তাঁদের মনে পড়ে? মানুষ বুঝেছিলেন, একবার গেরুয়া বাহিনীকে ক্ষমতায় বসালে রাজ্যকে তাঁরা গোধরা করে ছেড়ে দেবেন। যেভাবে নির্বাচনী মঞ্চে দাঁড়িয়ে নেতারা রাজ্যকে হিংসার নরকে পৌঁছে দেওয়ার বার্তা দিচ্ছিলেন, মনে হচ্ছিল না কোন সভ্য সমাজে বাস করি। ভোট পরবর্তী সময়ে সেই হুঙ্কারের এক শতাংশও পাল্টা হবে না? এটা নিয়ে এখন নাকে কান্না করলে মানায় না। আর মিথ্যা তত্ত্ব প্রচার করতে গিয়ে বারবার ধরা পড়ে গিয়েছে বিজেপির আইটি বাহিনী।
দিনকয়েক আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইংল্যান্ড থেকে দু’একজন পরিচিত জানালেন, সেখানে ভারতীয়দের মধ্যে বাংলার নির্বাচন নিয়ে বিজেপি নানা অপপ্রচার চালাচ্ছে। বলছে, বাংলা নাকি পাকিস্তান হয়ে গেল। বাংলায় যাঁরা জিতেছেন, তাঁরা বেশিরভাগই মুসলিম। এখানে ভোটের পর থেকে হিন্দুদের উপর অত্যাচার শুরু হয়েছে। বিজেপি মানেই যেন মিথ্যার এক শপিং মল। মনে রাখা দরকার, পৃথিবীটা এখন একটা দেশ। প্রতি মুহূর্তে সব খবর সবাই পান। তাই এসব জুমলাবাজি করে লাভ নেই। অথচ যোগীরাজ্যে একের পর এক হেরে গিয়ে সেখানে সন্ত্রাস শুরু করেছে বিজেপি। বিজেপির সন্ত্রাসে মৃত্যু হচ্ছে মানুষের। করোনা রোগীরা চিকিৎসা পাচ্ছেন না। মৃত্যুর পর তাঁদের ভাসিয়ে দেওয়া হচ্ছে গঙ্গায়। গুজরাতে করোনার চিকিৎসা চলছে গোয়ালঘরে। শাস্ত্রে বলে, ধর্মের নামে অধর্মাচরণ এক ধরনের তস্করবৃত্তি।
গোমূত্র পানের অশিক্ষার প্রসার, গোরুর দুধে সোনা সন্ধানের অজ্ঞতা, রগড়ে দেওয়ার মস্তানি, মেরে অনাথ করে দেওয়ার হুঙ্কার, মমতাকে বারমুডা পরিয়ে বাংলার মা বোনদের খুল্লামখুল্লা অপমানের ধৃষ্টতা বাঙালি মেনে নেয়নি। তাই বাঙালি সুযোগ পেয়েই একটা ধর্মান্ধ দলকে পাল্টা রগড়ে দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে, এটা যোগীরাজ্য নয়।
মনে পড়ছে মহামায়ার গল্প। কংস যাঁকে মারার জন্য উদ্যত হয়েছিলেন। সেই মহামায়া দৈববাণী করেছিলেন, ‘তোমারে বধিবে যে গোকুলে বাড়িছে সে’। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে, মোদিকে যিনি সিংহাসন থেকে অপসারিত করতে সক্ষম, তিনি হলেন একমাত্র মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। পুরাণ বা ইতিহাস কখনও নারীত্বের অপমানকে ক্ষমা করেনি। আর মাত্র কয়েকটা বছর! না সরলে, মানুষই সরিয়ে দেবেন!