আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব সমাগমে আনন্দ বৃদ্ধি। চারুকলা শিল্পে উপার্জনের শুভ সূচনা। উচ্চশিক্ষায় সুযোগ। কর্মক্ষেত্রে অযথা হয়রানি। ... বিশদ
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আসলে সেই প্রজন্মের রাজনীতিক, যিনি কর্পোরেট ঘরানার রাজনীতি করতে একদম স্বচ্ছন্দ নন। বরং অনেক বেশি ভালো পারেন রাস্তায় নেমে লড়াই করতে। স্ট্রিট ফাইটিং। চার্টার্ড ফ্লাইটে উড়ে এসে অথবা পাঁচতারা হোটেলে থেকে নির্বাচন পরিচালনা করলে স্ট্রিট ফাইটারদের চরিত্র বোঝা কঠিন। অমিত শাহ বা জে পি নাড্ডারা হয়তো সেই কারণেই তৃণমূল সুপ্রিমোর ‘খেলা হবে’ স্লোগানের মর্মার্থ বুঝতে বুঝতে নিজেদের জালে অনেকগুলো গোল ঢুকিয়ে ফেলেছেন। দেশের সবচেয়ে শক্তিশালী, রাজনৈতিক আইটি সেলের মাতব্বর অমিত মালব্যরা বুঝতেই পারেননি কেন কোটি কোটি বাঙালি মহিলা এবং ভদ্রলোকের ভোট মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দিকে ঝড়ের গতিতে ধেয়ে চলে যাচ্ছে।
একমাস কুড়ি দিন। তার মধ্যে ৪৩ দিন হুইলচেয়ারে। ধৈর্য, সাহস, পরিশ্রম, বুদ্ধি, জেদ। এককথায়, এক অবিশ্বাস্য সফর। একটা অতীব শক্ত ম্যাচকে এভাবে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে ‘সহজ’ করে দিলেন—সেটা ২ মে বোঝা গিয়েছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আবারও দেখিয়ে দিলেন, বুকের পাটা থাকলে যত প্রতিবন্ধকতাই থাকুক, একাই একশো হওয়া যায়। গণদেবতার আশীর্বাদ তাঁর সঙ্গেই থাকে, যিনি সাহসী হন। তাঁর বিরুদ্ধে কার্যত চক্রব্যূহ তৈরি হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, বিজেপি সভাপতি-সহ গেরুয়া বাহিনীর সবাই তাঁকে নিশানা করেছেন। কী না করেছেন মোদি বাংলা দখল করার ব্রত নিয়ে! নেহরু থেকে মনমোহন সিং—সবাই মিলে বাংলায় লোকসভা ও বিধানসভায় যতগুলি ভোট-সভা করেছেন, মোদি একাই সেই সম্মিলিত রেকর্ড প্রায় ভেঙে দিয়েছেন! সঙ্গে প্রায় একই সংখ্যক সভা করেছেন দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। এছাড়াও ছিলেন নানা মাপের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি, বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলির ‘হেভিওয়েট’ নেতৃবর্গ। সর্বোপরি, নির্বাচন কমিশন। নন্দীগ্রাম থেকেই মমতা বলেছিলেন, আমরা বিচার পাচ্ছি না। কমিশন চালাচ্ছেন অমিত শাহ। সেই সংঘাত শেষ পর্যন্ত এমন পর্যায়ে গেল যে, তাঁকে ২৪ ঘণ্টা প্রচার থেকে দূরে থাকতে হয়েছিল। কিন্তু তবুও এই বিরাট সাফল্য, কীভাবে?
রাজ্যের ভোট বিশ্লেষকদের একথা মাথায় রাখা দরকার ছিল, বাঙালি ভোটাররা স্বভাব-সহনশীল, খুব খেপিয়ে না দিলে কিন্তু বাঙালি ভোটাররা পরিবর্তন চান না। বস্তুত, বামফ্রন্ট তার ভাবাদর্শের বিরুদ্ধে গিয়ে কৃষকদের জমি কেড়ে শিল্প-স্থাপনের চেষ্টা করল, ঠিক তখনই পতন ঘটল তাদের। যদি সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের জমি আন্দোলন না-হতো, তাহলে ২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গে রাষ্ট্রক্ষমতার পরিবর্তন ঘটত না। প্রশ্ন একটাই, ২০২১-এর আগে বড় ঘটনা কী এমন ঘটেছে যাতে বিজেপি মনে করেছিল যে, এবার ‘আসল পরিবর্তন’ আসবে? শুধু তাই-ই নয়, শাসকদলের অনেক কর্মী-সমর্থকদেরও দিনের পর দিন পা কাঁপতে দেখা গিয়েছে। পাড়ায়-পাড়ায় সেই চিত্র ছিল আরও ভয়াবহ। নিজেদের কাজের প্রতি যতটা আত্মবিশ্বাস ছিল, তার চেয়ে বেশি কম্পন অনুভূত হয়েছে, বিজেপির একের পর এক দলভাঙার খেলায়।
যদিও দল ভাঙানোর সেই রণকৌশলও মমতার পক্ষে গিয়েছে। সেই দলবদলু প্রার্থীরা কিন্তু কেউ জিততে পারেননি। যাঁরা বিশেষ বিমানে অমিত শাহের বাড়িতে গিয়ে পৌঁছেছিল, বাঙালি এইভাবে দলবদলের নোংরামি ভালো চোখে দেখেনি। তাঁদের বিশ্বাসঘাতক মনে করেছিল। তৃণমূল ভেঙেও বিজেপি খুব একটা লাভ পেল না। বিজেপি যত বেশি করে বলেছে, আমরা দু’শো পার করব, মাইন্ড গেম খেলার চেষ্টা করেছে, হাওয়া তত তাদের বিরুদ্ধেই গিয়েছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমাণ করে দিয়েছেন, এই চমকপ্রদ জয়ের নেপথ্যে যদি মুসলিম ভোট অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হয়, তাহলে মাথায় রাখতে হবে, বাঙালি মহিলারাও মন উজাড় করে ঘাসফুল চিহ্নে ছাপ দিয়েছেন। তা না-হলে উত্তরবঙ্গে কিংবা জঙ্গলমহলে তৃণমূল নিজেদের হারানো জমি পুনরুদ্ধার করতে পারত না। যে তিনটে ভোটব্যাঙ্ক মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাশে দাঁড়িয়ে গিয়ে বিজেপিকে ত্রিশূলের ফলায় বিদ্ধ করেছে, তার মধ্যে মহিলা এবং মুসলিম ভোটের পাশাপাশি আত্মাভিমানী বাঙালির ভোটও রয়েছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বারবার বলে গেলেন, শুধু বাঙালি-অবাঙালি নয়, বঙ্গসংস্কৃতির নিজস্বতা আক্রমণ করে মোদি-অমিত শাহরা বঙ্গসংস্কৃতিকে তছনছ করে দিতে চাইছে।
এবার প্রতি দফার ইস্যু ছিল আলাদা। মমতাও ধাপে ধাপে তাঁর অস্ত্রগুলো সামনে এনেছেন। শুরুতে ‘বাংলা ও বাঙালি’, ‘বহিরাগত’ ইস্যুর প্রচার ছিল তুঙ্গে। তারপর তিনি বোঝাতে শুরু করেন, প্রার্থীকে ভোট মানে তাঁকেই ভোট। স্থানীয় জোড়াফুল প্রার্থীকে না-জেতালে তিনি মুখ্যমন্ত্রী হতে পারবেন না। আর তিনি মুখ্যমন্ত্রী না-হলে বন্ধ হয়ে যাবে রেশন, সাইকেল, ট্যাব, ‘কন্যাশ্রী’, ‘রূপশ্রী’র টাকা, নানারকম ভাতা, মৃতদেহ সৎকারের অর্থ। পাঁচ লক্ষ টাকার ‘স্বাস্থ্যসাথী’ কার্ডটাও হয়ে যাবে বেকার। মজা হল, এই উপভোক্তা শ্রেণির প্রকল্পগুলো একান্ত মমতার। বিজেপি বলতেই পারেনি, তারা ক্ষমতায় এলে এই প্রকল্পগুলো বন্ধ করবে না। ফলে উন্নয়নের ইস্যু ছিল মমতার তুরুপের তাস।
গোটা নির্বাচনে, বিজেপির ইস্যু ছিল দু’টি। এক, দুর্নীতি। এবং দুই, বড় মাপের শিল্পায়নে বর্তমান সরকারের ব্যর্থতা। এর কোনওটাই কিন্তু কারণ হিসেবে যথেষ্ট নয়। দুর্নীতি যদি সরকার পরিবর্তনের কারণ হতে পারত, তা হলে ২০১৬ সালেই যখন সারদা-নারদা নিয়ে চর্চা চরমে—সরকার বদলে যেত। তারপরে তৃণমূলের নেতাদের জড়িয়ে নতুন কোনও তথ্য জনসাধারণের সামনে আসেনি। শুধু দিল্লির শাসক দল ভোটের ঠিক আগে ইডি ও সিবিআইয়ের সাহায্যে পুরনো প্রসঙ্গ উত্থাপন করে জনমানসে সেই পুরনো দুর্নীতির স্মৃতি উস্কে দিতে চেয়েছে। এতে চিঁড়ে ভেজেনি। দ্বিতীয়ত, মেনে নেওয়া ভালো যে, পশ্চিমবঙ্গের বেশিরভাগ ভোটারের কাছে বড় মাপের শিল্পায়ন বা তার অভাব খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। যদি তা হত তাহলে বামফ্রন্ট এত বছর রাজত্ব করতে পারত না।
আসলে, গত লোকসভার নির্বাচনে বিজেপি তৃণমূলের থেকে মাত্র চারটি সিট কম পেয়েছিল। তাদের ভোট শতাংশেরও উন্নতি ঘটেছিল উল্লেখযোগ্যভাবে। তাই বিজেপি নেতারা ভেবে ফেলেছিলেন, এই বিধানসভা নির্বাচনে একটু উঠে পড়ে লাগলেই পশ্চিমবঙ্গটা তাঁদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে। গোটা বিজেপি কেন্দ্রীয় বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়েছিল বাংলার মাটিতে। বিজেপির আসল জোর অবশ্য টাকার। অভিযোগ, টাকার জোরেই তারা তৃণমূলের কিছু নেতাকে হাত করে ফেলেছিল। টাকার জোরে তারা যে পরিমাণে বিজ্ঞাপন দিয়েছে, তা এক কথায় অভূতপূর্ব। কিন্তু শুধু বিজ্ঞাপন দিয়ে বাঙালি ভোটারদের মন পাওয়া কি সম্ভব? সিংহভাগ বাঙালি ভোটারের একটা ভাবাদর্শ আছে। এই ভাবাদর্শ ধর্মনিরপেক্ষতার। এই ভাবাদর্শের সঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতাদর্শের কোনও বিরোধ নেই। কে না জানে, বিজেপি পাইকারি হারে বেসরকারিকরণের পক্ষে। আর তারা যে ধর্মনিরপেক্ষ নয়, সেটা তো সর্বজনবিদিত। এসবই কিন্তু সনাতন বাঙালি বিশ্বাসের পরিপন্থী। এবারের বিধানসভা ভোট ছিল ধর্মীয় মেরুকরণ বনাম উন্নয়নের লড়াই। ‘দিদি’র প্রতি বাঙালির আবেগ!
জনাদেশ বুঝিয়ে দিয়েছে, মানুষ শুধু প্রত্যাখ্যানের জন্য ভোট দেন না, যোগ্য বিকল্প বিবেচনা করেই ভোট দেন। বিজেপি কিংবা বিরোধী জোট যোগ্য বিকল্প হিসেবে গড়ে ওঠার কোনও বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরি করতে পারেনি। জোটের অন্তঃসারহীন বার্তার চেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্য হয়েছে সাফসুতরো-আলোকিত রাস্তাঘাট, সস্তার চাল, অনুদান কিংবা অন্যান্য নাগরিক সুযোগসুবিধা। কাজ করেছে আরও একটি বিষয়। সমস্ত আসনে তিনিই প্রার্থী—মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাবমূর্তির দ্যোতক এই বার্তাটিকে মেনে নিয়েছেন মানুষ। দলের বাকি কুশীলবের অকাজ ফ্যাক্টর হয়ে ওঠেনি। বিজেপি চেয়েছিল পশ্চিমবঙ্গের এবারের ভোটকে ধর্মীয় মেরুকরণে মুড়ে দিতে। শুরু থেকেই তারা সেই লক্ষ্য হাসিলে সচেষ্ট থেকেছে। স্বাধীনতার পর থেকে এই সীমান্তবর্তী রাজ্যের ভোট কখনও এইভাবে ধর্মীয় আধারে করার চেষ্টা হয়নি। সেদিক থেকে দেখতে গেলে রাজ্য নির্বাচনে এইভাবে আইডেনটিটি পলিটিকস আমদানির মধ্য দিয়ে বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব অত্যন্ত সচেতনভাবে বঙ্গীয় সমাজ ও রাজনীতিতে এক নতুন আঙিনা খুলে দিতে চেয়েছিল।
সেই আঙিনা, গোবলয়ের রাজনীতিতে তাদের চেনা ছক, যে-ছক তাদের বারবার লভ্যাংশ দিয়ে আসছে। সুখের কথা, পশ্চিমবঙ্গের বাঙালির শিক্ষা, রুচি, মনন ও বীক্ষা বিজেপির সেই ধর্মীয় মেরুকরণের রাজনীতিকে প্রত্যাখ্যান করেছে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ সত্ত্বেও শেষবিচারে বঙ্গসমাজ বিজেপির আইডেনটিটি পলিটিকস তত্ত্বকে আমল দেয়নি। বাঙালিয়ানা বিসর্জন দিয়ে বিজেপির হিন্দু-হিন্দি-হিন্দুস্তান মার্কা ভারতীয়ত্বকে আপন করে নিতে চায়নি। বহুত্ববাদ, বৈচিত্র্য ও বিবিধকে আঁকড়ে ধরে একদর্শী মতবাদকে তফাতে ঠেলেছে। দিনের শেষে এই রাজনৈতিক সংঘাত তাই রূপ নিয়েছে এক সামাজিক ও সাংস্কৃতিক লড়াইয়ে। এবং অবশেষে মোক্ষম হোঁচট খেয়েছে বিজেপি।
আর সবকিছুর মধ্যে একটা বিষয় স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে, বিজেপির মতো একটি রেজিমেন্টেড দলের ভিতরের কাঠামো আসলে কত নড়বড়ে। বোঝা যাচ্ছে, ক্ষমতা দখলের লক্ষ্যে আঠারো আনা ঝাঁপিয়ে পড়া দলটি এখনও নিজের পায়ে দাঁড়ানোর অবস্থাতেই পৌঁছয়নি। তাই দল ভাঙিয়ে লোক জোগাড় তাদের কাছে অন্যতম বিকল্প। আর তাতেই তাদের সাংগঠনিক শৃঙ্খলা শিকেয়। চাওয়া-পাওয়ার দলীয় দ্বন্দ্ব নেমে এসেছে রাস্তায়। এবার ভোটে এও এক নয়া উপাদান। সঙ্ঘের অনুশাসনে ঋদ্ধ বিজেপির কাছে সাংগঠনিক শৃঙ্খলা তো বুনিয়াদি শিক্ষা। অথচ প্রার্থী তালিকা ঘিরে তার যে মুখচ্ছবি ফুটে উঠেছে, সেটা অন্য যে-কোনও প্ল্যাটফর্ম মার্কা আবেগতাড়িত দলের থেকে আলাদা কিছু নয়। কলকাতায় বিজেপির দপ্তরে প্রায় নিত্য অশান্তি, জেলায় জেলায় মারামারি, পার্টি অফিসে ভাঙচুর, আগুন, পথ অবরোধ সব মিলিয়ে যেন ফুল প্যাকেজ! গড়ার আগেই ছিল ভাঙার খেলা। গোটা ভোটপর্বে যাঁরা সারাক্ষণ গেরুয়া কম্পন অনুভব করে গেলেন, তাঁরা বুঝতেই পারলেন না বিজেপিতে মুষল পর্ব শুরু হয়ে গিয়েছে! আর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপর তখন অঝরে ঝরে পড়েছে গণদেবতার আশীর্বাদ।