আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব সমাগমে আনন্দ বৃদ্ধি। চারুকলা শিল্পে উপার্জনের শুভ সূচনা। উচ্চশিক্ষায় সুযোগ। কর্মক্ষেত্রে অযথা হয়রানি। ... বিশদ
ঘোষিত ফলাফলে যেটা হল তার একটা ভালো দিক এই যে, চার রাজ্যেই নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতাসহ মজবুত সরকার বসতে চলেছে। অন্যদিকে, পরাজিত পক্ষরাও ভালো সংখ্যায় আসন পেয়েছে। ফলে রাজ্য বিধানসভা কক্ষগুলিও পাচ্ছে সমীহ করার মতো বিরোধী পক্ষ। এতে জয় হল মানুষের। জনগণ ছাড়া আর যেসব পার্টি ও ফ্রন্টের প্রশ্নাতীত জয় হল, তাদের মধ্যে রয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস, বাম গণতান্ত্রিক জোট (এলডিএফ) এবং দ্রাবিড় মুন্নেত্রা কাঝাগম (ডিএমকে)। বিজেপি অসমে জিতেছে, কিন্তু বিচ্ছিরিভাবে পরাজিত হয়েছে কেরল ও তামিলনাড়ুতে। কংগ্রেস কেরল এবং অসমে প্রধান বিরোধী দলের মর্যাদা অর্জন করে নিয়েছে। অন্যদিকে, ধুয়েমুছে সাফ হয়ে গিয়েছে বাংলা থেকে।
সবক’টা লড়াইয়ের ভিতরে সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক হয়ে উঠেছিল—মোদি বনাম দিদি। মোদির ভাবমূর্তি আটকে গিয়েছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে লক্ষ্য করে তাঁর ছুড়ে দেওয়া বিদ্রূপাত্মক সম্বোধনের ভিতর—‘‘দিদি, … ওওওওওওওওহ্, দিদি’’। এই জিনিস একজন প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে যার পর নাই বেমানান। মোদি অবশ্য ব্যাখ্যা করেছেন, তিনি ‘দিদি’ শব্দটিকে সহজভাবে দু’বার উচ্চারণ করেছেন মাত্র। কিন্তু ব্যাখ্যা দিতে পারেননি কোন জায়গায় বলেছেন এবং ‘... ওওওওওওওওহ্’ কথাটির মানে কী। অন্যদিকে, হুইল চেয়ারে বসে প্রচারটা হয়ে উঠেছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ডিফাইনিং ইমেজ’। মোদির সস্তার ‘ক্যাট-কল’ মমতার হুইল চেয়ারের কাছে হেরে ভূত হয়ে গিয়েছে। কেরলের যুদ্ধটাও কিন্তু কম চিত্তাকর্ষক হয়নি। দক্ষিণের ওই রাজ্যে এলডিএফের কাছে পরাজিত হয়েছে ইউডিএফ।
বড় দল ও পুনরাবিষ্কার
আঞ্চলিক দলগুলি মানুষের বেশি কাছাকাছি। আমার এই হাইপোথিসিসটা ফের প্রমাণিত হল। আঞ্চলিক দলগুলি রাজ্যের মানুষের ভাষাটা অনেক সহজ সুন্দর করে বলতে পারে, স্থানীয় সংস্কৃতিটাকে অনেক ভালো বোঝে, জনসংখ্যার পরিবর্তনের সঙ্গে নিজেকে দ্রুত মানিয়ে নিতে পারে, সমাজের ভিতরে পরিবর্তিত আদর্শ ও মানকে খুব তাড়াতাড়ি স্বীকৃতি দেয় এবং পরিবর্তনগুলির সঙ্গে একাত্ম হয়ে যেতে পারে বেশ দক্ষতার সঙ্গে। বড় দলগুলিকে বৃহৎ স্তন্যপায়ী প্রাণীদের সঙ্গে তুলনা করা দেখা যেতে পারে। তারা সবচেয়ে বুদ্ধিমান বটে, কিন্তু তাদের পরিবর্তনটা হয় হিমবাহ গতিতে।
কংগ্রেস নিজেকে পরিবর্তন করার একটি চেষ্টা করেছিল, কিন্তু এক বা একাধিক কারণে নিজেকে পুনরাবিষ্কার করতে পারল না। সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার একমাত্র উপায় হল ‘পুনরাবিষ্কার’। পুনরাবিষ্কৃত ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের উপাদানগুলি বিচক্ষণ পর্যবেক্ষকদের চোখে ধরা পড়ছে।
তড়িঘড়ি বিরাট বড় হয়ে ওঠার দাম মেটাচ্ছে বিজেপি এবং একজন একনায়ককে স্বীকৃতি দিচ্ছে। নরেন্দ্র মোদি সবচেয়ে তৃপ্ত হবেন—বিজেপি দলটাকে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির মতো এবং নিজেকে আর একজন জি জিনপিং করে তুলতে পারলে। এই পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে সংবিধান এবং বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রাজ্যের নির্বাচন অনুষ্ঠান। তবে তাঁরা উৎসাহ বোধ করছে এটা দেখে যে, বহু মানুষ ‘ওয়ান নেশন, ওয়ান ইলেকশন’ স্লোগানে মোহিত হয়েছে। মোদির লক্ষ্য হল, যৌথ (সংসদ এবং রাজ্য বিধানসভাগুলির) নির্বাচনটাকে তাঁর পক্ষে রেফারেন্ডাম বা গণভোটে রূপান্তরিত করা। সাংবিধানিক বাধাটুকু কাটিয়ে উঠতে তিনি দু’টি জিনিসের জন্য ধৈর্যসহকারে অপেক্ষা করবেন। একটি প্রতীক্ষা থাকবে রাজ্যসভায় দুই তৃতীয়াংশ গরিষ্ঠতা লাভের জন্য। অন্যটা হল, দেশের অর্ধেক রাজ্যেক বিজেপির শাসনে নিয়ে আসা। তবে বেশিরভাগ ভোটদাতা মোদিকে তাঁর ছকের মাধ্যমে চিনে নিয়েছেন এবং তাঁরা কখনওই তাঁর স্বপ্নপূরণের সাথী হবেন না। তাঁর সামনে আর একটি সমস্যা হল, দেশে একটি অত্যন্ত ক্ষমতাশালী একটি সুপ্রিম কোর্ট রয়েছে। আগামী তিনটি বছর ২০২১-এর থেকে খুব বেশি অন্যরকম হবে না। ২০২২ সালে রয়েছে উত্তরপ্রদেশ, গোয়া, মণিপুর, পাঞ্জাব, উত্তরাখণ্ড, হিমাচলপ্রদেশ ও গুজরাত রাজ্য বিধানসভার ভোট। মেঘালয়, নাগাল্যান্ড, ত্রিপুরা, কর্ণাটক, চত্তিশগড়, মধ্যপ্রদেশ, মিজোরাম, রাজস্থান ও তেলেঙ্গানায় বিধানসভার নির্বাচন নির্দিষ্ট রয়েছে ২০২৩ সালে। তার পরের বছর, অর্থাৎ ২০২৪-এ হবে লোকসভার ভোট। আমরা মোদিকে আগামী দিনে একজন প্রধানমন্ত্রীর থেকে এক ক্যাম্পেনার হিসেবে বেশি করে দেখতে পাব।
দুর্ভাগ্য ও মৃত্যু
ইতিমধ্যেই মহামারীর দু’-দু’টি ঢেউয়ের বিরাট ধাক্কা লেগেছে অর্থনীতিতে। তৃতীয় এবং/অথবা চতুর্থ ঢেউও যে আছড়ে পড়বে না, এমন নিশ্চয়তা নেই। মন্থর অর্থনীতি মানুষকে মেরে ফেলছে। ব্যবসা গুটিয়ে ফেলতে বলা হচ্ছে। চাকরি চলে গিয়েছে। বেকারত্বের হার ৮ শতাংশ। অর্থনীতির পরিভাষায়, কনজিউমার প্রাইস ইনফ্লেশন বাড়ছে। সোজা কথায়, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম ঊর্ধ্বমুখী। পুঁজি ভারত থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। খরচ চালিয়ে যাওয়ার জন্য ঋণ নেওয়া ছাড়া সরকারের সামনে উপায় নেই। কিন্তু তাতেও অর্থনীতির স্রোত বিপরীত খাতে বইয়ে দিতে পারবে না সরকার।
সবচয়ে বড় শিক্ষাটা পেয়ে গিয়েছে মধ্যবিত্ত শ্রেণি। ‘মোদি হ্যায় তো মুমকিন হ্যায়’ স্লোগানটা তাঁরা বিশ্বাস করেছিলেন। তাঁদের সমাজ/কলোনির দরজাটা তাঁরা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। ঢং ঢং করে বাজিয়েছিলেন থালা। জ্বালিয়েছিলেন প্রদীপ। ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’ করেছিলেন। গরিব মানুষের না-বলা যন্ত্রণার সামনে বন্ধ রেখেছিলেন তাঁদের চোখ। বিশেষ করে দিনমজুর এবং পরিযায়ী শ্রমিকদের দিকে তাকাননি। সরকারের অপদার্থতার জন্য আজ তাঁরাই নিজেদের খুঁজে পাচ্ছেন হাসপাতালে হাসপাতালে। করিডরে দাঁড়িয়ে কেউ কাতর আবেদন জানাচ্ছেন অক্সিজেন সিলিন্ডারের জন্য তো হন্যে হয়ে খুঁজছেন একটা বেড। প্রতিটা দিন বয়ে আনছে নিত্যনতুন মৃত্যুর খবর। মৃতের তালিকায় পরিবারের কেউ, অথবা কোনও আত্মীয়, অথবা বন্ধু, অথবা চেনা-পরিচিত একজন। অথবা, এমন একজন মারা গিয়েছেন যিনি ওই শোকসন্তপ্ত মানুষটির সাফল্যের জন্য ভীষণ খুশি ছিলেন। মৃত্যু অতীতে কখনও এত কাছে আসেনি, আমাদের কারওরই।
ভয়ানক ভবিষ্যৎ
মহামারী এবং অর্থনীতি—দু’টির উপরেই নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে সরকার। জীবন এবং জীবিকা দু’টোই বাঁচাতে হবে। দু’টোর জন্যই দরকার বিপুল পরিমাণ অর্থ। অথচ, অর্থের জোগানটাই কমে এসেছে। ফিসকাল ডেফিসিট বৃদ্ধি বা রাজকোষ ঘাটতির পরিমাণ বৃদ্ধি ছাড়া সরকারের সামনে অন্য উপায় নেই। নরেন্দ্র মোদির আবার সেটা করার সাহসটাও নেই। তাঁকে সৎপরামর্শ দেওয়ার পক্ষে তাঁর অর্থমন্ত্রী অত্যন্ত ভিতু। অন্যদিকে, তাঁর পরামর্শদাতারা হলেন একদল ব্যর্থ মানুষ। এর পরিণাম—এমন এক বিপর্যয়, যাতে লাখো লাখো পরিবার ধ্বংস হয়ে গিয়েছে, যার কোনও নজির নেই।
সম্রাট এবং তাঁর পার্ষদদের অঙ্গে কোনও বস্ত্র নেই। বিশ্বের সংবাদ মাধ্যম তাঁদের বাঁচিয়ে দিয়েছে। ভারতীয় মিডিয়া সবে জাগতে শুরু করেছে। মানুষ তার ক্রোধের বহিঃপ্রকাশের জন্য প্রতিটা নির্বাচনকে হাতিয়ার করছে। দৃষ্টান্ত, উত্তরপ্রদেশের পঞ্চায়েত ভোট। ২০২১ সাল—আরও একটি নষ্ট বছরের জন্য মনোবল ফেরানোর জন্য যখন চেষ্টা করছি, ঠিক তখনই আশঙ্কায় কেঁপে উঠছি আগামী দু’টি বছরের কথা ভেবে—২০২২, ২০২৩ সালও নষ্ট হবে না তো!