আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব সমাগমে আনন্দ বৃদ্ধি। চারুকলা শিল্পে উপার্জনের শুভ সূচনা। উচ্চশিক্ষায় সুযোগ। কর্মক্ষেত্রে অযথা হয়রানি। ... বিশদ
তারপর আসে ১৯ মে, ২০১৬। ফের বিপুল ভোটে বিজয়ী হয় মমতার দল। আর কোনও জোট নয়। লড়লেন মমতা একাই। ২৭ মে, ২০১৬। মন্ত্রিসভার শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান হয়েছিল রেড রোডে। শপথবাক্য পাঠ করান রাজ্যপাল কেশরীনাথ ত্রিপাঠী। সাক্ষী ছিলেন দেশের বিজেপি-বিরোধী তাবড় নেতারা। লালুপ্রসাদ যাদব, ফারুক আবদুল্লা, কেজরিওয়াল, নীতীশ কুমার, অখিলেশ যাদব প্রমুখ। বিজেপির তরফে ছিলেন মোদির অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি এবং প্রতিমন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয়। উজ্জ্বল উপস্থিতি ছিল ক্রিকেট তারকা সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় ও ভুটানের প্রধানমন্ত্রী শেরিং তোবগের। আক্ষরিক অর্থেই তারকা সমাবেশ!
সেদিন দিল্লিতে মিডিয়ার সামনে অমিত শাহের প্রতিক্রিয়া ছিল এইরকম: আমাদের দু’জন মন্ত্রী গিয়েছেন মানে এই নয় যে তৃণমূলের বিরুদ্ধে লড়াইটা আমরা ছেড়ে দিলাম। বাংলায় আমাদের সরকার না-হওয়া পর্যন্ত লড়াইটা জারিই থাকবে।
অমিত শাহের সেই তীব্র হুংকার বাতাসেই মিলিয়ে গিয়েছে। বাস্তবটা হল, তৃতীয়বারের জন্য রাজ্যপাটের দায়িত্বে বাংলার সেই বাঘিনীই। মঙ্গলে উষা বুধে পা, আজ বুধবার, ৫ মে, ২০২১ মমতার আনুষ্ঠানিক শপথগ্রহণ। প্রথমবারের মতোই রাজভবনে। কিন্তু অনুষ্ঠান হতে চলেছে একেবারেই অনাড়ম্বরভাবে। এবার বিশিষ্ট কেউই আমন্ত্রিত নন।
আজ মনে পড়ছে দুটি ঘটনার কথা। প্রথমটা জেনেছি অশোক মিত্রের স্মৃতিচারণা থেকে। ২১ জুন, ১৯৭৭। জ্যোতি বসুর প্রথম বামফ্রন্ট সরকার শপথ নিয়েছিল রাজভবন প্রাঙ্গণে। মস্ত শামিয়ানা খাটানো হলেও তার নীচে ক’জনের আর জায়গা হয়, অপেক্ষায় তো জনতার বাঁধভাঙা জোয়ার! রাজ্যপাল অ্যান্টনি ডায়াসের কাছে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে শপথ নিলেন আরও চার মন্ত্রী: সিপিএমের অশোক মিত্র ও কৃষ্ণপদ ঘোষ, ফরওয়ার্ড ব্লকের কানাইলাল ভট্টাচার্য এবং আরএসপির যতীন চক্রবর্তী। অনুষ্ঠানের গাম্ভীর্য ভেঙে দিয়েছিলেন মঞ্চে সমাসীন বিশিষ্টজনেরাই, হাসি-মশকরা বিনিময়ে। অজয় মুখোপাধ্যায় বসেছিলেন অত্যন্ত নিরীহ ভঙ্গিতে। হঠাৎ নাটকীয়তার সঙ্গে প্রবেশ ঘটে অন্যএক প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর (লেখক তাঁর নামটি না নিলেও তিনি কংগ্রেসিদের মানুদা, অর্থাৎ বাহাত্তর-সাতাত্তর-খ্যাত সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়)। তিনি বিলিতি স্যুট-টাই ভূষিত, হাতে ওয়াকিং স্টিক। অশোক মিত্রের বিস্ময়, ‘যেন তিনিই (সিদ্ধার্থবাবু) নির্বাচনে জিতেছেন!’ শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান শেষে কাতারে কাতারে মানুষ জ্যোতিবাবুর গাড়ি ছেঁকে ধরে। প্রায় শোভাযাত্রা করে মানুষ তাঁকে রাইটার্সে পৌঁছে দিয়েছিল। দোতলার অলিন্দ থেকে ভাষণে জনতার উদ্দেশে জ্যোতিবাবু বলেছিলেন, আমরা জনতার নির্বাচিত সরকার। জনতার অনুশাসন অনুসারে এই সরকার চলবে। রাইটার্স বিল্ডিংসে বসে নয়, জনতার সঙ্গে মিশে গিয়ে, জনতার নির্দেশে, জনতার প্রেরণায় এই সরকারের প্রতিটি সিদ্ধান্ত নিরূপিত হবে।
তারপর টানা ৩৪ বছর পেয়েছিল সিপিএমের নেতৃত্বে বামেরা। জ্যোতি বসু এবং বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য মিলে সাত-সাতবার শপথ নিয়েছিলেন। কথা রাখেননি জ্যোতিবাবু। কথার খেলাপ হয়েছিল বুদ্ধদেববাবুর আমলেও। শেষমেশ হার্মাদের শাসনকালের রূপ নিয়েছিল বামরাজত্ব। ২০১১ সালে মানুষকে মুক্তির স্বাদ এনে দিয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মানুষ সেদিন যে আনন্দ স্বস্তি সুখ অনুভব করেছিল, বাংলার ইতিহাসে তার তুলনা কই! সিদ্ধার্থ-জমানার বিনাশ করে জ্যোতি বসু নায়ক হয়ে উঠেছিলেন নিঃসন্দেহে। কিন্তু জ্যোতিবাবুর প্রতিষ্ঠা করা জগদ্দল সরাবার তৃপ্তি ছিল তার বহুগুণ। প্রথমবার শপথ নিয়ে মমতা রাজভবন থেকে হেঁটে রাইটার্সে গিয়েছিলেন। থুড়ি, রাজভবন থেকে রাইটার্স অবধি ছুটেছিল জনজোয়ার, খুশির জোয়ার। কে সেই দশপ্রহরণধারিণী, যিনি হার্মাদ-রাজত্বের অবসান ঘটাবার মতো অসাধ্যসাধনটি করলেন? তাঁকে একবার চর্মচক্ষে দেখার জন্য মানুষ দিনের পর দিন রাইটার্সের সামনে ভিড় করেছে। ভিড় থাকত অনেক রাত পর্যন্ত। অগণিত মানুষের সেই ‘ভালোবাসার অত্যাচার’ একসময় মহাকরণের নিরাপত্তার সামনে প্রশ্নচিহ্ন হয়ে ওঠে। প্রশাসন বাধ্য হয়েছিল সেই জমায়েত নিষিদ্ধ করতে।
তারপর কেটে গিয়েছে দশবছর। মুখ্যমন্ত্রীর দপ্তর এখন নবান্ন। সেখান থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে উৎখাত করার শপথ নিয়ে মোদি-শাহ-নাড্ডারা যে কীর্তি স্থাপন করলেন সম্প্রতি, ভারতের ইতিহাসে তার তুলনা নেই। তারপরও ২ মে আমরা দেখলাম: তৃণমূল কংগ্রেস ২১৩। বিজেপি ৭৭। এটাই শেষ রেজাল্ট নয়। এখনও বাকি দু’টো আসনের উপনির্বাচন। ১ প্লাস ১ যদি এখনও ২ হয়, তবে ২১৫ হবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল। মমতাই ফের ক্ষমতার কেন্দ্র। ক্ষমতার কাছে থাকাটাকেই অগ্রাধিকার দেয় রাজনীতির কারবার। অতএব কিছু মাননীয় সদস্যের দলবদল শুধু সময়ের অপেক্ষা। তাঁদের দেখাদেখি সরু চ্যানেল খুঁজবেন আরও অনেকে। অর্থাৎ রিভার্স ফ্লো আসন্ন। বিজেপির সাইজ আরও ছোট হবে বলেই আশঙ্কা হচ্ছে। বাহুল্য বোধে বাকি দলগুলোর কথা উল্লেখ করছি না। কারণ, একুশের চমৎকারীতে বাংলায় দুই দলের গণতন্ত্র মাথাচাড়া দিয়েছে!
গত লোকসভার রেজাল্টকে বিজেপি নেতৃত্ব বড্ড বড় করে দেখেছিল। ওই ভোটের নিরিখে বাংলার ১২১টি আসনে এক নম্বরে ছিলেন মোদিরা। ২০১৪। লোকসভায় বাংলা থেকে তাঁদের এমপি দু’জন। ২০১৬। পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় তাঁদের এমএলএ তিনজন। ২০১৯। লোকসভার ভোটের আগে-পরে শুরু হল দল ভাঙানোর মাদারি কা খেল! নিজেদের একগাদা এমপি এবং এমএলএ-র মালিক ভাবতে শুরু করলেন মোদি-শাহ-নাড্ডা। ‘ত্রিরত্ন’ ধরেই নিলেন, মমতাকে ফুৎকারে উড়িয়ে দেবে গেরুয়া শিবির। বাংলা দখল করবে ২০০+ ম্যাজিকে। আর এই অহংকৃতকল্পনায় ভর করে তাঁরা যে হিতাহিত জ্ঞানশূন্যতা দেখালেন তার তুলনা কই! ভগবান রামচন্দ্র এবং বাংলার অবিসংবাদিত নেত্রীকে দিনের পর দিন অপমান করে গেলেন তাঁরা নিয়ম করে।
গত নিবন্ধে লিখেছিলাম, ‘রামনামের এত বদনাম আগে হয়নি’ এবং ‘বাঙালির রামভক্তি যদি কিছুমাত্র খাঁটি হয়ে থাকে ... মোদির পার্টিকে রামধাক্কা একদিন দেবেই মানুষ।’ ভোটের রেজাল্ট বলছে, বাংলার মানুষ দেরি করেনি। যা দেওয়ার দিয়েছে হাতে গরম।
নরেন্দ্র মোদির যদি আত্মসম্মানবোধ বলে কিছুমাত্র থাকে তবে তাঁর উচিত হবে এই মুখ নিয়ে বাংলামুখো না-হওয়া। বাংলায় সবাই স্বাগত। রবিঠাকুরের বাংলা কাউকেই ‘বহিরাগত’ মনে করে না। তবে, বাঙালি একটা কথাই বোঝাবার চেষ্টা করেছে, বাংলাকে যারা ছোট ক্ষুদ্র হ্রস্ব ন্যূন ভাবার দুঃসাহস দেখাবার মতো আহাম্মক, শুধু তারাই বহিরাগত। নিজের ভালো বাংলার মানুষের থেকে বেশি কেউ বোঝে না। সোনার বাংলা গড়ার জন্য বাংলার মানুষই যথেষ্ট। তার জন্য ভাড়াটে বাহিনীর আহ্বান অবান্তর, অনৈতিক। নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য বাংলার মাটিতেই অনেক নেতা আছেন। কোনও স্বঘোষিত ‘বেনিয়া’কে প্রয়োজন নেই। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় থাকতে বাংলারও অন্য কারও উশখুশ করার দরকার নেই। তাতে পণ্ডশ্রমই হবে তাঁর। আরও একটা জিনিস পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে, গেরুয়া বাহিনী দ্রুত না শোধরালে, মোদির হাত থেকে ব্যাটন খসে পড়েতে দেরি হবে না। সেটা কোনও শাহের হাতে যাবে না। মমতার মজবুত মানবিক হাতেই সেটা হস্তান্তর করার প্রহর দেশবাসী গুনছেন কি না, সেই জল্পনা গবেষণা শুরু হয়ে গিয়েছে ইতিমধ্যেই।
কোভিড পরিস্থিতি আপনারা দায়িত্ব নিয়ে যদি এতটা খারাপ না করে ফেলতেন, তাহলে অবশ্যই বলতাম, মোদি-শাহ-নাড্ডা বাংলায় আসুন। আজই সুযোগ। মুখ্যমন্ত্রী পদে মমতার শপথের হ্যাটট্রিক। দেখে যান রাজধর্ম পালনের শপথ কীভাবে নিতে হয়। অতিথি হিসেবে আসুন। শ্রীধনকরকে পাশে নিয়ে মঞ্চ আলো করে বসুন। তবে মুখে চওড়া মাস্ক পরুন অবশ্যই। করোনা একমাত্র সমস্যা নয়। লজ্জা নিবারণেরও অস্ত্র হয়ে উঠুক আপনাদের জন্য। অতিথি দেবতাদের প্রকাশ্য বিড়ম্বনা অতিথিপরায়ণ বাংলার মানুষ মোটে সইতে পারবেন না।