আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব সমাগমে আনন্দ বৃদ্ধি। চারুকলা শিল্পে উপার্জনের শুভ সূচনা। উচ্চশিক্ষায় সুযোগ। কর্মক্ষেত্রে অযথা হয়রানি। ... বিশদ
আমাদের প্রধানমন্ত্রী স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসেন। এবং সেই স্বপ্ন ধরে রাখতে পারেন। গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রীর কুর্সিতে আচমকা তাঁর জাঁকিয়ে বসাটা মানতে পারেনি বিজেপিরই একটা বড় অংশ। তাও তিনি সেই চেয়ার ধরে রাখতে পেরেছিলেন। কারণ, রাজনীতিটা তিনি বোঝেন। কাকে তুলতে হবে, আর কাকে সরিয়ে দিতে হবে, সেই অঙ্কটা নরেন্দ্র মোদির জানা। তাই গোধরা পরবর্তী সংঘর্ষের পরও তাঁর ক্ষমতার ক্যানভাসে আঁচড় পড়েনি। অটলবিহারী বাজপেয়ি সাংবাদিক সম্মেলনে তাঁকে পাশে বসিয়ে বলেছিলেন, ‘রাজার জন্য... শাসকের জন্য প্রজায় ভেদ হতে পারে না। জন্মের আধারে নয়, ধর্মের আধারে নয়, সম্প্রদায়ের আধারেও নয়। আমার বিশ্বাস, নরেন্দ্রভাই এটাই করছেন।’ নরেন্দ্র মোদিকে রাজধর্মের পাঠ দিচ্ছিলেন তিনি। আর তখন পাশে বসা ‘নরেন্দ্রভাই’য়ের মুখে ছিল স্মিত হাসি। সবরমতী এক্সপ্রেস... গোধরা পরবর্তী সংঘর্ষ... দায় কার, তা নিয়ে বহু বিতর্ক রয়েছে। ম্যারাথন তদন্তে নরেন্দ্র মোদি বেকসুর ঘোষিতও হয়েছিলেন। সে অন্য পর্ব। কিন্তু ২০০২ সালের ওই অভিশপ্ত কয়েকটা দিন যে ঘটনাক্রম দেখেছিল, তাতে কোনও সরকার টিকে থাকতে পারে না। কিন্তু বিজেপি সরকার ছিল। নরেন্দ্র মোদি ছিলেন। হাজারো নির্দোষ প্রাণের বলিদান... তার দায় কাঁধে নিয়ে মোদিজি পদত্যাগ করেননি। কারণ, তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন। যা সফল হয়েছিল আরও ১২ বছর পর...।
স্বপ্নের বুনিয়াদের উপর দাঁড়িয়ে সরকার চলে না। বলা হয়, সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে ভারতের প্রধানমন্ত্রীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মিসঅ্যাডভেঞ্চার ছিল রাজীব গান্ধীর। রাজীব গান্ধী বেঁচে নেই। থাকলে বহু লোকের নামে তিনি মানহানির মামলা করতেন। নরেন্দ্র মোদি থাকতে কি না তাঁকে এই তকমা! রাজীব গান্ধীর এটা বলা সাজে। কারণ, তিনি সরকার চালানোর চেষ্টা করেছেন। আজ তো আর সরকার চলছে না! দিল্লির মসনদ এখন স্বপ্নপূরণের আখড়া। এখানে প্রতিনিয়ত কুস্তি চলছে বিরোধীদের সঙ্গে। বিরোধী মানে শুধু কয়েকটা দল নয়... এ দেশের প্রত্যেক নাগরিক, প্রতিটা সংগঠন... সমালোচনা করা মাত্রই তাঁর গায়ে স্ট্যাম্প পড়ে যাচ্ছে—এ রাষ্ট্রের শত্রু। সরকার চলছে ট্যুইটারে... রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর দেওয়া সরকারি চিঠির জবাব মন্ত্রী সেখানেই দিচ্ছেন। ভোট প্রচারে বাংলায় তাঁরা আসছেন দফায় দফায়। কিন্তু উম-পুনে বেসামাল হলে? চরণধূলি মাত্র একবার। প্রতিশ্রুতির বন্যা... কিন্তু বাস্তবে ফাটা কলসি। আওয়াজই সার, প্রাপ্তির ঝুলি শূন্য। নোটিস ছাড়াই নোট বাতিল, কিংবা হুড়োহুড়ি করে চালু হওয়া জিএসটি যদি প্রাপ্তি হিসেবে গণ্য হয়, তাহলে ব্যাপারটা মজাদার। আর তা না হলে? হিসেব কষে দেখুন, গত সাত বছরে কী পেলেন।
পেয়েছি আমরা... নরেন্দ্র মোদিকে। সেটাই ভাগ্যের ব্যাপার। বাঙালিরা বড্ড দুষ্টু, এ রাজ্যে তাঁকে ক্ষমতার বেলুন ফোলাতে দেয়নি। চেষ্টা কম করেননি তিনি! কংগ্রেস, সিপিএম সাফ। বিধানসভায় আসন সংখ্যা ৩ থেকে ৭৭। তারপরও সংখ্যাগরিষ্ঠতা থেকে বহু যোজন দূরে তিনি। অর্থাৎ, স্বপ্ন পূরণ হয়নি নরেন্দ্র মোদির। বাংলা ছিল তাঁর অধরা স্বপ্ন। যে কোনও মূল্যে তার নাগাল পেতে চেয়েছিলেন তিনি। দান, দণ্ড, ভেদ... যার জন্য যে ওষুধ, তাকে সেটাই দিতে জানেন গেরুয়া পার্টির দণ্ডমুণ্ডের কর্তারা। তাঁদের বিভেদমূলক রাজনীতিতে তৈরি হয় নির্দিষ্ট ভোটব্যাঙ্ক... সমাজে ছড়িয়ে যাওয়া ঘৃণাকে তাঁরা এনক্যাশ করেন। শীতলকুচিতে প্রয়োগ হয় দণ্ড... রাষ্ট্রের গুলিতে মৃত্যু বরণ করতে হয় চার নাগরিককে। তাঁরা এই দেশের নাগরিক। ভোটার। কোনও বহিরাগত নন। ঘুসপেটিয়াও নন। আর দান? বাজারে কানাঘুষো তো অনেক রয়েছে। সেটা অবশ্য নীচতলার জন্য। উপরতলায় পৌঁছলে হয়তো অন্য অঙ্ক। কোনও সমীকরণই মেলেনি। মেলার কথাও ছিল না। যে ঝড় তাঁরা বাংলার সমাজে তোলার চেষ্টা করেছিলেন, তা মুখ থুবড়ে পড়েছে। কিন্তু স্বপ্ন যে ভাঙতে দেওয়া যাবে না! তাই এখন লক্ষ্য একটাই—মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকারকে দুনিয়ার সামনে নাস্তানাবুদ করো। অস্ত্র?... ভেদ।
মুখ্যমন্ত্রী পদে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তখনও শপথ নেননি, তার মাঝেই কলকাঠি নাড়া শুরু হয়েছে দিল্লি থেকে। ভোট পরবর্তী সন্ত্রাসের অভিযোগে আকাশ পাতাল এক করে দিচ্ছে মোদি সরকার। কড়া চিঠি পাঠাচ্ছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। আসছেন প্রতিনিধিরা। তাঁরা শুধু ঘুরছেন বিজেপি নেতাদের নিয়ে। দেখছেন, কোথায় কোথায় ‘তৃণমূল হামলা করেছে’। তারপর ফিরে যাচ্ছেন। ফিরেও তাকাচ্ছেন না সেই তৃণমূল কর্মীর ফাঁকা দালানটার দিকে। যেখানে মানুষটা আর নেই... রয়েছে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়া স্ত্রী, মা, সন্তান। আটজন তৃণমূল কর্মী এই পর্বে খুন হয়েছেন। অভিযুক্ত সেই বিজেপি। তাও তা নজরে আসছে না কেন্দ্রীয় প্রতিনিধিদের। শুভেন্দু অধিকারী প্রকাশ্যে বলছেন, ‘তৃণমূলকে ভোট দিয়েছেন, এমন হিন্দুরাও এখানে আসুন। পশ্চিমবাংলায় হিন্দুরা আক্রান্ত। আমরা ছেচল্লিশের ক্যালকাটা কিলিং পড়েছি, দেখিনি। আমরা নোয়াখালির ঘটনা দেখেছি, পরবর্তীকালে চুরাশির শিখ দাঙ্গা দেখেছি। ’৯৬ সালের ভাগলপুর দেখেছি। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে আজ যেটা হচ্ছে সেটা রাজনৈতিক সংঘর্ষ নয়...। গ্রাম ধরে ধরে বেছে বেছে হিন্দুদের উপর অত্যাচার হচ্ছে।’ এমন বিস্ফোরক এবং উস্কানিমূলক মন্তব্যের কারণ একটাই, যেভাবে হোক বাংলায় রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করা। ৪৮ শতাংশের উপর ভোট পেয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আর এ রাজ্যে সংখ্যালঘু ভোট কত? ৩০ শতাংশ পেরবে না। ধরে নেওয়া যাক, সংখ্যালঘু ভোটের সবটাই তৃণমূল কংগ্রেস পেয়েছে (যা সম্ভব নয়)। তারপরও ১৮ শতাংশ ভোট পেতে হয়েছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। তারপর তিনি ২১৩টি আসনে জয় হাসিল করতে পেরেছেন। তাহলে একটা বিষয় আজ নিশ্চিত, ডাহা মিথ্যা বলছে বিজেপি! শুভেন্দু অধিকারী যখন এই মিথ্যার ঝুড়ি উপড়ে অবস্থান-বিক্ষোভের মঞ্চে হাঁকডাক করছিলেন, তখন তো পাশেই ছিলেন দলের রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ। প্রতিবাদ কোনও তরফ থেকে আসেনি। অর্থাৎ, এই ‘কৌশল’ সম্পর্কে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ওয়াকিবহাল। বরং তাঁদেরই অঙ্গুলিহেলনে চলছে ধর্মীয় বিভাজনের এই ধ্যাষ্টামো। আর আমরা যাঁরা ভক্ত, তাঁরা অন্ধের মতো সেই সব কথা গিলছি। ক্যালকাটা কিলিংয়ের সঙ্গে এখনকার পরিস্থিতির তুলনা করছেন বিজেপির তাবড় নেতারা! সেই স্পর্ধা হয় কী করে? মহম্মদ আলি জিন্নার স্লোগান ছিল, ‘হয় দ্বিখণ্ডিত ভারত, না হয় ভারতের ধ্বংস’। ১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্ট... ‘ডিরেক্ট অ্যাকশন ডে’র ডাক দিলেন জিন্না। ৭২ ঘণ্টায় ৪ হাজারের বেশি মানুষ কলকাতা শহরে প্রাণ দিয়েছিলেন, ঘরছাড়া লক্ষাধিক। শুধুমাত্র ক্ষমতালোভী কয়েকটা মানুষের নির্লজ্জ আত্মমুগ্ধতাকে বাস্তব রূপ দিতে খুন করা হয়েছিল বাংলাকে। একই পরিণতি হয়েছিল পশ্চিমেও! সেই দগদগে ঘা আমরা আজও বহন করছি। সেই ক্ষত আবার আপনারা খুঁচিয়ে তুলছেন। বিশ্বজুড়ে প্রচার চালাচ্ছেন, পশ্চিমবঙ্গে বাঙালি হিন্দুরা বিপন্ন। কিন্তু মনে রাখবেন, ফিরে আসছে সেই শব্দগুলো... ‘আত্মমুগ্ধ প্রধানমন্ত্রী’, ‘রাজনীতির নির্লজ্জ কারবারি’। ভিনদেশ থেকে উড়ে আসছে এই বিশেষণ। আপনি না স্বামী বিবেকানন্দের আদর্শে দীক্ষিত! আর আপনার মন্ত্রে মুগ্ধ শুভেন্দুবাবুও তো বুকপকেটে সব সময় স্বামীজির ছবি নিয়ে ঘুরতেন! যা দেখা যেত স্বচ্ছ পকেট ভেদ করে। তা আজ আর নজরে আসে না। কারণ, আপনারা প্রত্যেকে জানেন, স্বামীজি বিভেদ নয়, ভ্রাতৃত্বের আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন। বরং বাংলার ঘরে ঘরে খুঁজলে এখনও সেই পথের পথিক অনেককেই পাওয়া যায়। এখানে দেবাশিসের মতো মানুষরা করোনায় আক্রান্ত মুমূর্ষু রোগীকে টোটো চালিয়ে নিয়ে যান হাসপাতালে। ২৪ ঘণ্টা। তাঁরা ধর্ম দেখেন না, সম্প্রদায় দেখেন না। রাজ্যের আনাচে কানাচে দেবাশিসরা ছড়িয়ে রয়েছেন। কেউ রিকশ চালককের বেশে, কেউ ডাক্তার, কেউ সামান্য শ্রমজীবী। তাই আপনাদের উস্কানির রাজনীতি কিন্তু বাংলার মানুষ ভালোভাবে নেবে না। বাংলা এখনও বিকিয়ে যায়নি। যাবে না। কোটি কোটি করদাতার রক্ত জল করা টাকায় হয়তো মোদিজির সেন্ট্রাল ভিস্তা প্রকল্প সফল হবে। কিন্তু সাম্প্রদায়িক উস্কানির অন্ধকারে বাংলাকে ডুবিয়ে দেওয়ার স্বপ্ন? হবে না। মোদিজি বরং মানসিকভাবে প্রস্তুত হতে থাকুন। পরের লোকসভা ভোট আর মাত্র তিন বছর...। ধর্মের নামে আগুন জ্বালিয়ে প্রধানমন্ত্রী পদে হ্যাটট্রিক চান তিনি।
কিন্তু অপমৃত্যু হবে এই স্বপ্নেরও... যার সূচনা হয়েছে বাংলা থেকে।