আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব সমাগমে আনন্দ বৃদ্ধি। চারুকলা শিল্পে উপার্জনের শুভ সূচনা। উচ্চশিক্ষায় সুযোগ। কর্মক্ষেত্রে অযথা হয়রানি। ... বিশদ
সেদিন বাংলায় দৈনিক সংক্রমণ ছিল মাত্র সাড়ে আটশো, আর যেদিন ভোট শেষ হল সেদিন সংক্রমণ ছড়িয়েছে সাড়ে ১২ হাজার।
ভোটের সময় সংক্রমণ যে ছড়াবে সে আশঙ্কা ছিলই। নেতা-নেত্রীদের লাগাতার রোড শো, জনসমাবেশ কোনওদিনই নির্বাচন কমিশনের কোভিড নিয়ন্ত্রণ বিধি মানেনি। রাজ্যে পাঁচদফা ভোট পর্যন্ত নির্বাচন কমিশন কোভিড বিধিনিষেধ পালনের জন্য শুধু নির্দেশ জারি করেই দায়িত্ব সেরেছে। তা পালন হচ্ছে না দেখেও কার্যত চোখ বুজে ছিল। আদালতের ভর্ৎসনার পর নড়েচড়ে বসে! যদিও বিশেষভাবে এবারের ভোটের আগে এবিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছিল কমিশন। ভোট শুরু হওয়ার আগে নির্বাচন কমিশন বলেছিল, যদি কেউ নির্বাচনের সময় কোভিড নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত বিধিগুলি না-মানে তাকে নির্বাচন থেকে বাতিল করা হবে। কিন্তু একটিবারের জন্য নিজেদের ঘোষিত নীতি কার্যকর করেনি নির্বাচন কমিশন। অন্যদিকে বিজেপি? মানুষের মধ্যে
করোনা সংক্রমণ আটকাতে বাকি সব দল যখন জনসমাবেশ প্রায় বন্ধ করে দিয়েছে তখনও ভিড় বাড়িয়ে ভোট চেয়ে গেছে বিজেপি। তাদের প্রচারে লাগাম টানেনি। কারণ তারা বাংলার ক্ষমতা চেয়েছিল, কিন্তু বাঙালি ভালো থাকুক তা চায়নি। তাদের এই চাওয়ার ফল হল উল্টো। ভরাডুবি হল বিজেপির। হ্যাটট্রিক করে তৃতীয়বারের জন্য ক্ষমতায় এলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
তবে সবচাইতে বড় ভয়ানক আঘাত বিজেপি এবার এনেছিল বাংলার গণতান্ত্রিক পরিবেশে। ভোট এলে নির্বাচনের নামে বাংলা উত্তপ্ত রণক্ষেত্র হয়ে ওঠে, এটা নতুন কিছু নয়। সেক্ষেত্রে মানুষের কাছে ভরসা থাকে কেন্দ্রীয় বাহিনী। কিন্তু এবার প্রথম থেকেই দেখা গেছে কেন্দ্রীয় বাহিনীকে ব্যবহার করা হয়েছে একটি রাজনৈতিক দলের সুবিধার্থে। ফলে যে প্রশাসন রাজ্যে সুস্থ গণতান্ত্রিক পরিবেশ রক্ষা করবে তারাই কখনওবা মানুষের মধ্যে সন্ত্রাস সৃষ্টির অঙ্গ হয়ে গেছে। স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী নিরাপত্তা অফিসার হারাতে বাধ্য হয়েছেন এই নির্বাচন কমিশনের নির্দেশে। মুখ্যমন্ত্রী শেষে বলতে বাধ্য হন, আপনারা কি আমাকেও খুন করবেন ভাবছেন? নইলে আমার নিরাপত্তার অফিসার যিনি তাঁকে সরিয়ে দেওয়ার কারণ কী? এবারের নির্বাচনে আদর্শ আচরণবিধি লাগু হওয়ার পর থেকে কমিশনের নেওয়া বহু সিদ্ধান্তের আসল কারণ রহস্যই থেকে গেছে। পুলিস আমলাদের ক্ষেত্রেও হয়েছিল যথেচ্ছ বদলি।
আর তাই নির্বাচন কমিশন যে কেন্দ্রীয় বাহিনী দিয়ে জনগণের মধ্যে সন্ত্রাস সৃষ্টি করে ভোট করতে চেয়েছে কোনও বিশেষ একটি রাজনৈতিক দলের প্ররোচনায় এমন অভিযোগ বারবার তৃণমূল কংগ্রেস করেছিল। তাদের বক্তব্য, সেটি হাতেনাতে প্রমাণিত হয়েছে শীতলকুচিতে। ময়না তদন্তে জানা গেল, কেন্দ্রীয় বাহিনীর গুলিতে মৃত্যু বলে যারা সেদিন শনাক্ত হয়েছিল তাদের মধ্যে একজনকে ভারী কোনও কিছু দিয়ে আঘাত করে মারা হয়। গুলিতে সে মারা যায়নি। অর্থাৎ নির্বাচন কমিশনের দেওয়া তথ্য এবং বিবৃতি অনুযায়ী আক্রান্ত বাহিনী নিজেকে প্রতিরোধ করতে সেদিন যে গুলি চালিয়েছিল— সেই বক্তব্যের
সত্যতা প্রমাণ হয়নি। বরং অভিযোগ, সেদিন সেখানকার মানুষ আক্রান্ত হয়েছে বিনা প্ররোচনায়। তাই ভারী জিনিস দিয়ে আঘাত করে মারার মতন পরিবেশ তৈরি হয়েছে। সেটা কে মেরেছে? কেন্দ্রীয় বাহিনীর মধ্যে লুকিয়ে থাকা কোনও বিরোধী দলের সমর্থক কর্মীরা কি? প্রশ্ন উঠেছে। আরও প্রশ্ন, নির্বাচন কমিশন কেন আজ পর্যন্ত কোনও ভিডিও ফুটেজ সামনে আনতে পারল না! তাই শীতলকুচির ঘটনা বাংলার নির্বাচনের ইতিহাসে চিরস্থায়ী একটি কলঙ্কচিহ্ন হিসেবে থেকে গেল!
শুধু শীতলকুচি নয়, একেবারে প্রথম পর্ব থেকে অভিযোগ উঠছিল নির্বাচন কমিশনের সক্রিয় ঘেরাটোপে কেন্দ্রীয় বাহিনীকে দিয়ে গ্রামে গ্রামে রুটমার্চের নামে হুমকি জারি করার কথা। নন্দীগ্রামে ভোটের সময় ভোট কেন্দ্রে অবস্থান ধর্মঘটের মতো করে ঘণ্টা দেড়েক থেকে চোখে আঙুল দিয়ে সেটা দেখিয়ে দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। তারপর শুরু হয় প্রতিরোধের আহ্বান। আর সেই প্রতিরোধের বিরুদ্ধে বাংলার সাধারণ মানুষকে হিম সন্ত্রাসে ঠান্ডা করে রাখতে বিজেপির নেতারা বলতে থাকেন দিকে দিকে শীতলকুচি বানানো হবে। গুলি করা হবে একদম বুক লক্ষ্য করে। কী বীভৎস হিংসার রাজনীতি একটি দলের শীর্ষ নেতারা দিনের পর দিন মানুষের মধ্যে প্রচার করলেন! এই বাংলা এবারের নির্বাচনে সেটাও দেখল। আর তাই এই হিংসার রাজনীতিকে প্রত্যাখ্যান করল বঙ্গবাসী। বেছে নিল বাংলার ঘরের মেয়েকেই।
বস্তুত স্বাধীনতার পর থেকে অনেকবার ভারতে নির্বাচন হয়েছে, বাংলাতেও হয়েছে। কিন্তু এই প্রথম কেন্দ্রীয় সরকারে অধিষ্ঠিত থেকে শাসক দলের প্রথম সারির নেতারা বারংবার রাজ্যে এসেছেন এবং সমাবেশের পর সমাবেশ থেকে ভোট প্রচারের নামে সরাসরি রক্তচক্ষু দেখিয়ে গেলেন! প্রধানমন্ত্রী মুখ্যমন্ত্রীকে টক্কর দিতে চাইছেন, ভারতীয় গণতন্ত্রে এমন নজির অতীতে ছিল না। এবার তাও হল। বিরোধী দলনেতা হিসেবে জনসমাবেশ থেকে তিনি ভাষণ দেবেন, তাঁর দলের জয় পরাজয়ের ঊর্ধ্বে থেকেই প্রধানমন্ত্রী রাজ্যবাসীর জন্য কিছু সুখবর শোনাবেন এটাই অভিপ্রেত ছিল। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী মোদি নিজের সেই গরিমা ত্যাগ করে একটি অঙ্গ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে রীতিমতো মল্লযুদ্ধে নামলেন, দলীয় রাজনীতির আঁধারে সংসদীয় গণতন্ত্রের এমন অবক্ষয় এই প্রথম দেখল বাংলার মাটি।
নির্বাচনকে সামনে রেখে বিজেপি যেভাবে প্রচার চালিয়েছিল তাতে এটা পরিষ্কার হয়েছিল যে তারা বাংলায় ক্ষমতায় এলে হয়তো বাংলার সংস্কৃতিতে আঘাত নেমে আসত। তাদের মেরুকরণের রাজনীতি মানুষে মানুষে বিভেদ বাড়াত। দেখা গেল নাগরিকত্ব প্রশ্নে অমিত শাহ দক্ষিণবঙ্গে একরকম বলেছেন, দার্জিলিঙে অন্যরকম বলেছেন। এই ধোঁয়াশায় বাংলার মানুষের মধ্যে জেগেছে নানা প্রশ্ন। বাংলা কি আবার অসমের মতোই জ্বলবে? বাংলার মানুষ চায়নি নাগরিকত্বের প্রশ্নে তাদের উপর খাঁড়া নেমে আসুক।
বিজেপি এমনই একটি দল যারা কেবলমাত্র ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি দেওয়া ছাড়া উন্নয়নের কোনও ভাবনা স্পষ্ট করে জনসাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পারেনি। তাই ভোটের আগে সঙ্কল্পপত্র তারা প্রকাশ করলেও বিভিন্ন জনসমাবেশে তাদের নেতা-মন্ত্রীদের মুখে সঙ্কল্পপত্র নিয়ে বিশেষ কিছু কথা বলতে শোনা যায়নি। বরং সঙ্কল্পপত্রে তারা যা বলে থাকে সেটা না-করার মতো ভূরি ভূরি উদাহরণ আছে। তারপর? নির্বাচনকে ঘিরে অশান্তি, হানাহানি। এবার কলঙ্কিত হয়ে থাকল বাঙালির প্রতি বিজেপি নেতাদের কুৎসিত ভাষণ। চলল বঙ্গবাসীকে অসম্মান করার পালা। দল হিসেবে বিজেপি বুঝিয়ে দিল বাঙালিকে তারা কোন চোখে দেখে? এটা তাদের বিরুদ্ধে কোনও রাজনৈতিক বিরোধী দলের নিছক অভিযোগ নয়। সেটা জানা যায়, বাঙালির বিরুদ্ধে তাদের পদক্ষেপে। আন্দামানে সেলুলার জেলে বহু বাঙালি দেশপ্রেমিক বিপ্লবী বন্দি ছিলেন ব্রিটিশের অকথ্য অত্যাচার সহ্য করে। সকলেই প্রাণ দেন সেখানে, তাঁদের নাম লেখা ছিল সেখানকার শহিদ ফলকে। সাড়ে তিনশোর বেশি বাঙালি শহিদের সেই নামগুলো পর্যন্ত মুছে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে! বাঙালির প্রতি এত বড় হিংসা, এরকম মনোবৃত্তি কোনও দল কোনও সরকার আগে দেখায়নি। আর তাদেরই লেজুড় হিসেবে কাজ করেছে এবারের নির্বাচন কমিশন। পক্ষপাতদুষ্ট বলে অভিযোগ তাদের বিরুদ্ধে। ভোটগ্রহণ পর্ব থেকে ফল প্রকাশ— প্রতিটি পর্যায়ে তারা নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি দেখাতে পারল কি? কারণ এবারের ভোটযুদ্ধে ফলাফল ঘোষণার সময় গোটা দেশবাসীর বাড়তি নজর ছিল একটি কেন্দ্রের দিকে। নন্দীগ্রাম। যেখানে প্রার্থী ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। জয় নিয়ে তিনি নিশ্চিতও ছিলেন। প্রথমে জয়ের খবর প্রকাশ্যে আসার কিছুক্ষণের মধ্যেই আশ্চর্যজনকভাবে ফল উল্টে গেল! লোডশেডিং। নির্বাচন কমিশনের সার্ভার ডাউন।
গোটা ব্যাপারটাই কি কাকতালীয়? প্রশ্ন উঠল। ‘কারচুপির’ অভিযোগ তোলা হল তৃণমূলের তরফে। পুনর্গণনার দাবি করলেন তৃণমূল সুপ্রিমো। দেওয়া হল না পুনর্গণনার সম্মতি। ফের প্রশ্নের মুখে পড়ল নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা। কমিশনের স্বচ্ছ ইমেজ রক্ষার স্বার্থেই এধরনের যাবতীয় ধোঁয়াশা কাটানো দরকার ছিল। যা হল না। থেকে গেল এমন আরও অনেক প্রশ্ন।
লেখক অর্থনীতির বিশ্লেষক। মতামত ব্যক্তিগত