আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব সমাগমে আনন্দ বৃদ্ধি। চারুকলা শিল্পে উপার্জনের শুভ সূচনা। উচ্চশিক্ষায় সুযোগ। কর্মক্ষেত্রে অযথা হয়রানি। ... বিশদ
নির্বাচনের ফল প্রকাশের দিন দুয়েক আগের ঘটনা। জমির মাপজোক চলছিল। ঘটনাস্থল, উত্তর ২৪ পরগনার একটি এলাকা। পাঁচ-ছ’জন ছেলে এল এবং সরাসরি দাবি করল, ‘কাজ বন্ধ কর। ২ তারিখ রেজাল্টের পর আমরা ক্ষমতায় আসব। তারপর বলে দেব, কীভাবে কী করতে হবে। আর কোথায় কত দিতে হবে।...’ নিচুতলার দাদাগিরি বাম জমানায় ছিল, তৃণমূল জমানাতেও আছে। কিন্তু সেটা এমন ত্রাসের পর্যায়ে পৌঁছয়নি। যা বিজেপি এই কয়েকদিনে সমাজের নিচুতলায় ছড়িয়ে দিয়েছে। কারণ? বাংলা দখলের দিবাস্বপ্ন।
‘দিবাস্বপ্ন’ শব্দটা এখানে বুঝেশুনেই ব্যবহৃত। বাংলায় প্রতিষ্ঠানবিরোধী হাওয়া এমনও ছিল না যে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে উপড়ে ফেলতে হবে। সাধারণ মানুষ সেটা বোঝে, আর এত বড় জাতীয় পার্টি হয়েও বিজেপি বোঝে না? হতে পারে না। তাই তাদের লক্ষ্য ছিল একটাই—হাওয়া আরও জোরদার করতে হবে। কারা সেই কাজ করবে? সেই ‘না পাওয়া’রা। সম্পূর্ণ একটা অপপ্রচারকে বাস্তবের রূপ দিতে এই অংশটিকে ব্যবহার করেছে গেরুয়াতন্ত্র। ভেসে যাওয়া সেই মানুষগুলো দাদাগিরি করেছে, গলা ফাটিয়েছে দলের নামে... মনে হয়েছে, সত্যিই তাহলে আছে ‘বিজেপি হাওয়া’। আসলে, রাজনীতির মহাযুদ্ধে প্রত্যেকটা দলেরই কোনও না কোনও স্ট্র্যাটেজি থাকে। প্রতিশ্রুতি বা নির্বাচনী ইস্তাহার তার প্রাথমিক পদক্ষেপ মাত্র। তারপর এলাকার চরিত্র, সেখানকার মানুষ, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, সম্প্রদায়... এই সবই গোটা স্ট্র্যাটেজির অন্তর্ভুক্ত। ভোটের আগে টাকা দেওয়া বা মাংস খাওয়ানোটাও এই ‘কর্মসূচি’র মধ্যে পড়ে। কংগ্রেস, বাম বা তৃণমূল... কৌশল ঘোরাফেরা করে এই এক আবর্তে। তার কারণ, রাজনৈতিক দল কখনও সমাজকে, বা তার কাঠামোকে অস্বীকার করতে পারে না... যা বিজেপি বাংলায় করেছে। শুধুমাত্র ক্ষমতা দখলের লোভে ঘুণ ধরিয়েছে সমাজে। ধর্মীয় মেরুকরণ তো তাদের এজেন্ডা! উত্তরপ্রদেশ, বিহার, বা রাজস্থান... সর্বত্র এই একই অঙ্কে তারা দিনের পর দিন ভোটের ময়দানে ঘুঁটি সাজিয়েছে। সফল বলতেই হবে... না হলে এতগুলো রাজ্যে তারা ক্ষমতায় থাকতে পারত না। কিন্তু গেরুয়া শিবির হয়তো বুঝেছিল, বাংলায় শুধু এই মেরুকরণের রাজনীতি চলবে না। তাই টাকার খেলা... লোভ। যার পাঁচ হাজার উপার্জন করতে মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে হয়, তাকেই মাসে মাসে ৫০ হাজার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি। আরও লাগলে? ব্যবস্থা হয়ে যাবে। ফলটা খুব সুখকর হয়নি। হচ্ছেও না। আঙুল ফুলে আচমকা যারা কলাগাছ হয়েছিল, তাদের অন্তরে বাসা বেঁধেছিল এক অদ্ভুত মোহ... সরকারে এলে আরও কত কী না আসবে! কিন্তু না এলে? এরা বানিয়া পার্টি। পাই পাইয়ের হিসেব বুঝে নেবে। কাজ না হলে টাকার আমদানিও বন্ধ। এবার কিন্তু সেটাই হতে চলেছে। যারা এই কয়েক মাস বিজেপির কথায় নেচেছিল, তারা আজ পুনর্মুষিকোভব। অথচ লাইফ স্টাইলটা পৌঁছে গিয়েছে অন্য উচ্চতায়। এখন কিন্তু ফিরে যাওয়া অসম্ভবের শামিল। যারা ওই লোভের কলে পা বাড়ায়নি, বরং তারা আজ অনেকটা স্বস্তিতে। আর যারা টোপটা গিলেছিল, তাদের ব্যবহার করে ছুড়ে ফেলে দিচ্ছে বিজেপি। বাংলায় আজ প্রমাণিত—বিজেপি হাওয়া বলে কিছু নেই। ছিল না। তাহলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ২১৩টি আসন নিয়ে ক্ষমতায় ফিরতে পারতেন না। আপনারা এই বাস্তবটা জানতেন। তা সত্ত্বেও একটা শেষ চেষ্টা চালিয়েছিলেন। একের পর এক রাজ্যে পুর ও পঞ্চায়েত নির্বাচনে হার, গো-বলয়ের বাইরের রাজ্য থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া, কেন্দ্রীয় সরকারি নীতির ভরাডুবি... উপায় ছিল না নরেন্দ্র মোদির কাছে। অটলবিহারী বাজপেয়ির জমানায় যে বিজেপিকে ভারত দেখেছিল, তার ছিঁটেফোঁটাও এখন আর অবশিষ্ট নেই। সবটাই এখন প্যাকেজ। কীভাবে মার্কেটিং করতে হয়, মোদিজি সেটা খুব ভালো জানেন। তাই বারংবার ভ্রান্ত নীতি ও অপরিণামদর্শী পদক্ষেপ সত্ত্বেও দেশবাসী আপনার কাছে প্রত্যাশী। একবার, দু’বার, তিনবার... আমরা আশাহত হয়েছি। কিন্তু তারপরও ভেবেছিল, মোদিজি এবার আচ্ছে দিন আনবেন। কিন্তু ভোট রাজনীতির নামে মেরুকরণ, ঘৃণা ছড়ানো এবং সমাজের একটা অংশকে ইচ্ছেমতো ব্যবহার ছাড়া কী পেয়েছি আমরা? আপনি ভেবেছিলেন, বাংলা জয় করতে পারলে আরও একবার আপনার হাতে এসে যাবে সেই জাদুদণ্ড... আরও একবার মোহাবিষ্ট হবে মানুষ। ফের স্বপ্ন দেখবে ‘আচ্ছে দিনে’র। নাঃ, তা হয়নি। বাংলা বুঝেছে, এর সবটাই ভাঁওতা। ভোটযন্ত্র তারই প্রমাণবাহী। আর দুঃখজনক বিষয় হল, আপনি তো এবার দাবিও করতে পারবেন না যে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ভোটে রিগিং করেছেন! এক লক্ষাধিক কেন্দ্রীয় বাহিনী, কোভিডের মধ্যেও আট দফার ভোট, এবং ‘জো হুজুর’ কমিশন... আহা, তারপরও মানুষের মন পেলেন না! একটু আগে যদি বুঝতেন, এখানে গেরুয়া হাওয়া বলতে কিছুই নেই, তাহলে বাংলা একটু স্বস্তি পেত।
লোকে বলবে, হাওয়া যদি নাই থাকে, তাহলে বিজেপি মাত্র তিনটি আসন থেকে ৭৭টিতে পৌঁছল কীভাবে? তাঁরা ভুলে যাচ্ছেন, ক্ষমতার অলিন্দে শাসক থাকলে বিরোধীও থাকবে। ১০ বছর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষমতায় আছেন। এই পর্বে বিরোধী বলতে কারা ছিল?—মূলত বাম এবং কংগ্রেস। একুশের ফলের পর পরিষদীয় রাজনীতি থেকে তারা নিশ্চিহ্ন। বিরোধী বলে এখন রাজ্যে একটিই দল—বিজেপি। অর্থাৎ, বিরোধী হিসেবে বাংলার মানুষ বাম এবং কংগ্রেসের অপদার্থতা আর মেনে নিতে পারেনি। তাই তাদের ভোটব্যাঙ্কের সিংহভাগই সরে গিয়েছে গেরুয়া শিবিরে। অর্থাৎ, এতদিন যাহা ছিল সিপিএম-কংগ্রেস, এখন তাহাই বিজেপি হয়েছে। এই ফল সিপিএম এবং কংগ্রেসের কাছে লজ্জার। কিন্তু বিজেপির কাছেও গর্বের নয়! বাংলার মানুষ বিজেপিকে শাসক হিসেবে দেখতে চায়নি। এটাই সারসত্য। বিরোধী আসনে বসে আগে নিজেদের কর্মদক্ষতার প্রমাণ দিতে হবে। তারপর বাংলা ভেবে দেখবে, আপনাদের শাসকের আসনে বসানো যায় কি না। আর হ্যাঁ, এখন শোনা যাচ্ছে, বিজেপির প্রায় ২৫-৩০ জন বিধায়ক এবং জনাচারেক এমপি নাকি তৃণমূলে আসতে আগ্রহী? সেইমতো তাঁরা তৃণমূলের শীর্ষস্তরে তদ্বির পর্যন্ত শুরু করে দিয়েছেন? তাহলে তো এবার দলবদলের উল্টো হাওয়া বইবে! মোদি ঝড় যে শেষ!